১৯৯৬ : শ্বেত-বিদ্যুতের সামনে অরক্ষিত সুলতান
‘মহারাজা অফ বিজিয়ানাগ্রাম’ বা ‘বিজয় আনন্দ’ বা ‘ভিজি’ ছিলেন ১৯৩৬ সালে ভারতের দ্বিতীয় ইংল্যান্ড সফরের অধিনায়ক। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অধিনায়ক ছিলেন সুলতান জারাওয়ানি। ৬০ বছর আগে পরে ধনী ক্রিকেটপ্রেমী এবং নিজের ক্রিকেট-সামর্থ্যে অতি-আত্মবিশ্বাসী দুজন মিলেছিলেন এক বিন্দুতে।
ইংল্যান্ড ভারতকে যেমন ক্রিকেট শিখিয়েছিল, তেমনি ক্রিকেটে শ্রেণিকরণটাও রেখে গিয়েছিল। ইংল্যান্ডে যেমন শুধু ‘জেন্টলম্যান’রাই অধিনায়ক হতেন, পেশাদাররা নয়, তেমনি ভারতেও অধিনায়ক হতেন রাজকীয় বংশের কেউ। ভারতে ভিজির প্রাসাদের ভেতর নিজস্ব মাঠ ছিল, সেখানে খেলে গিয়েছিলেন জ্যাক হবস, হারবার্ট সাটক্লিফরাও। ক্রিকেটের প্রতি ভিজির ভালবাসার কমতি ছিল না, তবে নিজের ক্রিকেট-সামর্থ্যের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসটা ছিল হাস্যকর।
ভিজির আগে ভারতের প্রথম ইংল্যান্ড সফরে অধিনায়ক ছিলেন পরবান্দরের মহারাজা, ভিজিকে সেবার করা হয়েছিল সহ সহকারি অধিনায়ক। তবে অধিনায়কত্ব না পেয়ে তিনি সে সফরে যাননি, গেলেন পরেরবার। শুরুতেই শৃঙ্খলার অজুহাতে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো লালা অমরনাথকে।
ইংল্যান্ড সফরে বেশিরভাগ ম্যাচে নিজেকে বাইরেই রেখেছিলেন পরবান্দরের মহারাজা। বিজিয়ানাগ্রামের মহারাজা সেটা করেননি। প্রতি ম্যাচেই নেমেছেন, এমনকি বিপক্ষ দলের বোলারকে দামি উপহার দিয়ে ফুলটস করিয়ে নেওয়ার কাহিনীও প্রচলিত আছে। তার ক্যারিয়ার শেষ হয়েছিল ৩ টেস্টে ৮.২৫ গড়ে ৩৩ রানে। তবে সেসব রানেও আছে বিপক্ষ বোলারের ‘কৃতজ্ঞতা’।
ভিজির সেই সফরের ৬০ বছর পর অবশ্য আরেকজন ধনী ক্রিকেটার জারাওয়ানি বোলারের কৃতজ্ঞতা পাননি। মরতে বসেছিলেন উলটো।
জারাওয়ানি ক্রিকেটের প্রেমে পড়েছিলেন পাকিস্তানে পড়তে গিয়ে। ক্রিকেট-সামর্থ্য তেমন না থাকলেও ছিল টাকা। ১৯৯৪ সালে আইসিসি ট্রফিতে সংযুক্ত আরব আমিরাত দলকে খেলাতে প্রয়োজনীয় ফি-ও তিনি দিয়েছিলেন বলে বলা হয়। সে টুর্নামেন্টে ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আরব আমিরাত, তিনি ছিলেন অধিনায়ক। আমিরাত পেয়েছিল বিশ্বকাপের টিকেট। সে বছরই তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে একটি উইকেট নিয়েছিলেন তার লেগস্পিনে। সে উইকেট ছিল শচীন টেন্ডুলকারের। হয়তো জারাওয়ানির ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি সেটাই।
আরব আমিরাতের ক্রিকেট দল ছিল অভিবাসী দিয়ে ভর্তি। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা থেকে যাওয়া পরবাসীদের থেকে বেছে নেওয়া হয়েছিল ক্রিকেটারদের। তবে অধিনায়ক ছিলেন জারাওয়ানি। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে জারাওয়ানি ছাড়া আমিরাতে জন্ম নেওয়া ক্রিকেটার ছিলেন আর একজন- সাইদ-আল-সফর। তাকে করা হয়েছিল সহ-অধিনায়ক। অবশ্য টুর্নামেন্টে তিনি খেলেছিলেন একটি ম্যাচেই।
আরব আমিরাতের বিশ্বকাপ শুরু হলো রাওয়ালপিন্ডিতে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। গ্যারি কারস্টেনের বিশ্বকাপ রেকর্ড ১৮৮ রানে ভর করে দক্ষিণ আফ্রিকা তুললো ৩২১ রান, জারাওয়ানি ১০ ওভারে ৬৯ রান দিয়ে নিলেন ১ উইকেট।
৬৮ রানে ৬ উইকেট যাওয়ার পর নামলেন ব্যাটিংয়ে। সামনে অ্যালান ডোনাল্ড, শ্বেত-বিদ্যুত। তবে জারাওয়ানির মাথায় হেলমেট নেই, বদলে একটা কালো রঙের ফ্লপি হ্যাট। ডোনাল্ড তখন সময়ের অন্যতম দ্রুততম ব্যাপার, তার সামনে হ্যাট মাথায় কাউকে দেখে নিশ্চয়ই তিনি খুশি হবেন না। সতীর্থরাও তাতিয়ে দিলেন তাকে। প্যাট সিমকক্স গিয়ে ডোনাল্ডকে বলেছিলেন, ‘আল, এ কিন্তু সেটাই চাইছে’।
ডোনাল্ড জানতেন সিমকক্স কিসের কথা বলছেন। জারাওয়ানি কী চাইছেন। দিলেন সেটাই।
শর্ট লেংথে পড়ে বলটা উঠলো। জারাওয়ানি ডাক করার তেমন চেষ্টা করলেন না। এরপর দ্রুম। একদম মাথার মাঝখানে লাগলো বলটা। এতোটা জোরে লাগলো, বলটা গিয়েছিল ডিপ পয়েন্টের দিকে। ডোনাল্ড ভাবলেন, সুলতানকে বোধহয় মেরেই ফেললেন তিনি। জারাওয়ানি অবশ্য সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না তেমন, বলের তোপে যা একটু নড়ে গেলেন। দক্ষিণ আফ্রিকানরা ছুটে এলেন, তবে কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে হ্যাটটা তুলে নিয়ে আবার শুরু করলেন ব্যাটিং।
ছয় বল পর ব্রায়ান ম্যাকমিলানের বলে হ্যান্সি ক্রনিয়েকে ক্যাচ দিয়ে ইনিংস শেষ হয়েছিল তার, শূন্য রানেই। ম্যাচশেষে ছুটতে হয়েছিল হাসপাতালে।
সে বিশ্বকাপের পর আর খেলা হয়নি জারাওয়ানির। ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ৭ ওয়ানডেতে ২৬ রান নিয়ে, ৪.৩৩ গড়ে। বলা হয়, ক্যারিয়ারে রানের চেয়ে বেশি দামী গাড়ি ছিল তার। বোলিংয়ে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন ৫১.৪০ গড়ে। ব্যাটিং আর বোলিংয়ের গড়টা একটু অদলবদল করলে আদতেই তিনি হয়ে উঠতে পারতেন ক্রিকেটের সুলতান।
সেটা হয়নি। জারাওয়ানি হয়ে আছেন সেই ক্রিকেটার, যিনি ডোনাল্ডকে খেলতে নেমেছিলেন হেলমেট ছাড়া। যিনি নিজেকে হয়তো ভেবেছিলেন ভিভ রিচার্ডস। আর ডোনাল্ড ভেবেছিলেন, ক্রিকেট মাঠে একজনকে হত্যা করেছেন তিনি।
এরপর কী ঘটেছিল-
সে ম্যাচে ৭২ রানে ৮ উইকেট যাওয়ার পর পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া আরশাদ লাইক ও ভারতে জন্ম নেওয়া শৌকাত ডুকানওয়ালার দৃঢ়তায় আরব আমিরাত গিয়েছিল ১৫২ রান পর্যন্ত, দুজন মিলে ৯ম উইকেটে অবিচ্ছিন্ন থেকে তুলেছিলেন ৮০ রান। বিশ্বকাপের পর জারাওয়ানিকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল আমিরাত ক্রিকেট বোর্ড। তারা ক্রিকেটের কিছুই জানেন না, এমন মন্তব্য করেছিলেন জারাওয়ানি।