১৯৯৬ : কেনিয়ার টানে পতন ক্যারিবীয় সাম্রাজ্যের
ইউসুফ করিম। মোম্বাসায় একটা স্পোর্টস শপ আছে তার। তবে সে দোকানে মানুষ শুধু কেনাকাটা করতে আসে না, অনেকে আসে শুধু ইউসুফকে দেখতে। একবার হাতটা মিলিয়ে যেতে। ইউসুফ টেনিসে মোম্বাসার ট্রিপল ক্রাউন টুর্নামেন্ট জিতেছিলেন ২৫ বার। এমসিসির বিপক্ষে খেলার পর কাউন্টি খেলার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। আর তার ব্যাটিংয়ে শোনা যাচ্ছিল ফিসফাস, “এ যদি অন্য দেশে জন্মাত…”। ইউসুফ পরে মোম্বাসার কোর্টের হ্যান্ড অফ কিং হয়েছিলেন। তার নামে রাস্তা আছে সেখানে।
ইউসুফের এক ছেলের নাম আসিফ। বাবার মতো টেনিস খেলেছেন তিনিও। কেনিয়ার হয়ে ডেভিস কাপ খেলেছিলেন, বিয়ন বোর্গ জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিলেন, ফ্রেঞ্চ ওপেনের জুনিয়র পর্যায়েও খেলেছেন। তবে টেনিসের ইতি ঘটেছিল ১৯৯২ সালে। সেদিন কেনিয়া ওপেনে সিঙ্গেলস ও ডাবলসে ফাইনাল ছিল তার, সঙ্গে ক্লাবের হয়ে একটা ক্রিকেট ম্যাচ। আসিফ তিনটিই খেলতে চাইলেন।
প্রথমে টস করে গেলেন সিঙ্গেলটা খেলতে। হারলেন সেখানে। ক্রিকেট ম্যাচে ফিরলেন। হারলেন। ডাবলস খেলতে গেলেন। দেরি হয়ে গেছে বলে ততক্ষণে ম্যাচটা জিতিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রতিপক্ষকে। এরপর থেকে আসিফ খেলেছেন শুধুই ক্রিকেট।
১৯৯৬ বিশ্বকাপের আগে কেনিয়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তেমন খেলেনি। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তারা ছিল পূর্ব আফ্রিকার অংশ, তানজানিয়া, উগান্ডা ও জাম্বিয়ার সঙ্গে। কেনিয়ার প্রথম বিশ্বকাপে এক স্টিভ টিকোলো ছাড়া কেউই পেশাদার ছিলেন না। আসিফরা খেলতেন দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতেই।
পঞ্চম ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পুনেতে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ততদিনের দুইবারের চ্যাম্পিয়ন, তিনবারের ফাইনালিস্ট। অবশ্য রিচি রিচার্ডসনের অধিনায়কত্ব নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে তখন। আর ব্রায়ান লারা পারলে মুম্বাইয়ের থিকথিকে ভীড়েই হারিয়ে যেতে চান সেই দলে খেলার চেয়ে। প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে জয়ের পর ভারতের সঙ্গে হেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আর কলম্বোতে নিরাপত্তার অজুহাতে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে খেলেনি। তবে বাকি দুই ম্যাচে একটি জয় তাদের কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার পথটা পরিস্কার করে দিতে পারতো।
কেনিয়া পাটনা থেকে দিল্লীতে এলো বিমানে। এরপর মুম্বাইয়ে। সবশেষে বাসে করে পুনে। পরদিন ম্যাচ, তারা পুনেতে পৌঁছালেন সন্ধ্যারও পর। অনুশীলন দূরের কথা, মাঠটাই দেখা হলো না। পরদিন গিয়ে পুনের সবুজ উইকেট দেখে তাদের প্রথম চিন্তা ছিল, “আজ আমাদের মেরেই ফেলবে!”
এমনিতে কেনিয়ানরা ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমর্থক। ম্যাচের আগের দিনই ঠিক করা ছিল, ম্যাচশেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের একটা ডিনারের আমন্ত্রণে যাবেন কেনিয়ানরা। পরিচিত হবেন ক্রিকেটের বড় বড় নামের সঙ্গে।
কেনিয়া ৮১ রানে হারালো ৬ উইকেট। হিতেশ মোদির সঙ্গে ৭ম উইকেটে থমাস ওডোয়োর ৪৪ ও ৯ম উইকেটে আসিফের ২৯ রানের জুটির পরও ১৬৬ রানেই আটকে গেল তারা। ইনিংসে সর্বোচ্চ ৩৭ রান এলো অতিরিক্ত থেকে।
ইনিংস বিরতিতে কেনিয়ানরা কৌতুকে মাতলেন। এ রান করতে কতো ওভার নেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২৫ ওভার, ৩০ ওভার। ম্যাচ তাড়াতাড়ি শেষ হলে তারা ঘুরতে বের হবেন, দেখবেন পুনে শহরটা।
শুরুতেই দুই উইকেট হারালো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে লারার একটা মোটামুটি ইনিংসই বদলে দিতে পারতো সব। কিন্তু লারার ওপর সেদিন যেন ভর করেছিল কেমন বেখেয়ালিপনা। দারুণ কাভার ড্রাইভে শুরু করেছিলেন, তবে এরপর খেলছিলেন জোরের ওপর শট। দুইবার ব্যাট চালিয়ে মিস করলেন, হতে পারতেন রান-আউটও।
আসিফ স্লিপে ফিল্ডিং করছিলেন। পাশে উইকেটকিপার তারিক ইকবাল। চোখে একটা সাদারঙা রোদচশমা, মাথায় হেডব্যান্ড নিয়ে তাকে দেখাচ্ছিল কোনও ব্যান্ড-মেম্বারের মতো, ভুল করে যিনি চলে এসেছেন ক্রিকেট মাঠে। তারিকেরও সেদিন কী হয়েছিল, করছিলেন হাস্যকর সব মিস। তার পারফরম্যান্স এমনই ছিল, অনেক দিনের বন্ধু আসিফও তার মুখের দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছিলেন।
এরপর ঘটল অদ্ভুত কিছু। রজব আলির অফস্টাম্পের বাইরের বলে ব্যাট চালালেন লারা। প্রথমে মনে হলো, বলটা দুই পায়ের মাঝে গিয়ে লেগেছে তারিকের। আদতে সেটা গ্লাভসবন্দী করেছিলেন তিনি।
লারার উইকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ঠেলে দিল খাদের দিকে। হুড়মুড় করে সেদিকে ছুটলেন ক্যারিবীয়রা, আগুন দেখে যেমন এগিয়ে যায় পতঙ্গ। তারা থমকে গেল ৯৩ রানে। মরিস ওদুম্বে ১০ ওভারে দিলেন ১৫ রান, নিলেন ৩ উইকেট। কেনিয়ার অখ্যাত শৌখিন এক অফস্পিনার নাভিশ্বাস তুললেন ক্যারিবীয়দের। রজব ৭.২ ওভারে ১৭ রানে নিলেন ৩ উইকেট। ক্যামেরন কাফিকে বোল্ড করে শেষটা করলেন তিনিই। এর আগে টানা ৮ ওভার বোলিং করে আসিফ নিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের নবম উইকেট।
আগে থেকেই ঠিক ছিল বলে সে রাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ডিনারটা বাদ দিতে পারেনি। কেনিয়ানরা গিয়েছিলেন সেখানে। যাদের নাম কেউ শোনেনি, তাদের কাছেই হেরে যাওয়াটা হয়তো তখনও আঘাত করছিল ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের। তবে তাতে আসিফদের বয়েই গেছে। সে রাতে ঘুমটা হয়নি তাদের, উদযাপনের চোটে।
আর ওদিকে মোম্বাসায় ইউসুফের দোকানে ততক্ষণে জমে গেছে ভীড়। তারা কোর্টের হ্যান্ড অফ কিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেননি সেদিন, এসেছিলেন বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দেওয়া একজন ক্রিকেটারের বাবার সঙ্গে দেখা করতে।
এরপর যা ঘটেছিল-
ওয়েস্ট ইন্ডিজ অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে গিয়েছিল, এরপর লারার দারুণ ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে গিয়েছিল সেমিফাইনালে। সেখানে গিয়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার নতুন উদাহরণ তৈরি করেছিল তারা, ২০৭ রান তাড়ার সময় ১৬২ রানে ২ উইকেট থেকেও ম্যাচ হেরে। কেনিয়ার সঙ্গে ম্যাচের ছয়দিন পর অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন রিচার্ডসন। কেনিয়ার পরের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে গ্রুপের শেষে থেকেই বিদায় নিয়েছিল।
আসিফ করিম ১৯৯৯ বিশ্বকাপের পর অবসরে গিয়েছিলেন, তবে বোর্ডের অনুরোধে ফিরেছিলেন ২০০৩ সালে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তার ৮.২-৩-৭-৩ এর বোলিং ফিগার হয়ে আছে কেনিয়ার ক্রিকেটের অন্যতম সেরা স্বর্ণালী পারফরম্যান্স।