• বিশ্বকাপের ক্ল্যাসিক মুহুর্ত
  • " />

     

    ১৯৯৬ : এক বলে 'আমির' সোহেল, পরের বলে 'রাজা' প্রসাদ

    ১৯৯৬ : এক বলে 'আমির' সোহেল, পরের বলে 'রাজা' প্রসাদ    


    ভারত-পাকিস্তান। বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল। ব্যাপারটা ভেবে নিতে পারেন এরপর। সঙ্গে যোগ করুন, পাকিস্তান ভারতে খেলতে আসছে ৭ বছর বিরতি দিয়ে। যখন এই দুই দেশ খেলে, দেশের সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে ফুটপাতের দোকানদার এতে যুক্ত হয়। অবশ্য ফুটপাতের দোকানদারের দোকানটাও বোধহয় বন্ধ থাকে সেদিন, রাস্তায় বেখেয়ালে বের হলেও হয়ত স্তব্ধতা জানান দিবে, কিছু একটা চলছে। 

    বেঙ্গালুরু তখন শুধু ভারতের নয়, বিশ্বেরই অন্যতম বড় ‘তথ্য প্রযুক্তির’ শহর। ভারতের ‘সিলিকন ভ্যালি’, ‘তথ্য প্রযুক্তির রাজধানী’। তবে সেসব ভুলে যান। এ দিনটা ব্যবসার জন্য নয়। এ দিনটা ক্রিকেট মাঠে একটা যুদ্ধের। চিন্নাস্বামীতে সেদিন ৫৫ হাজার মানুষ। কমেন্ট্রিতে টনি গ্রেগকে মনে হবে রকস্টার, যিনি মাতিয়ে তুলছেন স্টেডিয়ামকে, অথচ তার কথা মাঠের কেউ শুনতে পারছেন না। তবে যখন গ্রেগের কন্ঠ ছাড়া আর কিছু শুনছেন না টেলিভিশনে, মানে ব্যাপারটা যখন মিউজিক ছাড়া খালি গলায় গাওয়ার মতো, তখন বুঝবেন ভারতের বিপক্ষে কিছু হয়েছে। শুধু টনি গ্রেগ কেন, রিচি বেনো বা রবি শাস্ত্রি বা সুনীল গাভাস্কার বা ইমরান খানেরও একই অবস্থা। 

    এক বল আগে শাস্ত্রি যখন একটা চারের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, চিন্নাস্বামী স্তব্ধ। এক বল পর যখন শাস্ত্রির কন্ঠ দর্শকের কন্ঠে মিলিয়ে গেল, তখন নিশ্চিতভাবেই একটা উইকেট পেল ভারত। সেই অ্যাকশন-প্যাক ম্যাচের এরকম দুই বলই হয়ে আছে বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তানের লড়াইয়ের চিত্র। পাকিস্তান হয়ত হুমকি দিয়েছে, চোখ রাঙিয়েছে, তবে শেষ উল্লাসটা ভারতের। মিঁয়াদাদ হয়তো কিরন মোরেকে ব্যঙ্গ করেছেন, শেষটা সুবিধার হয়নি। আমির সোহেল ভেঙ্কটেশ প্রসাদের ওপর আধিপত্য দেখাতে চেয়েছেন, মুখ ভার করে ফিরতে হয়েছে। অন্তত ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তানের লড়াই হয়ে আছে এমনই।

    ম্যাচের আগমুহুর্তে চোটের কারণে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন পাকিস্তান অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম, যে চোট হয়ে আছে ১৯৯৮ ফুটবল বিশ্বকাপ ফাইনালে রোনালদোর রহস্যজনক অসুস্থতার মতো বিতর্কিত। ওয়াসিমের বদলে পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দিলেন আমির সোহেল। 

    নভোজ্যাত সিং সিধুর ৯৩ রানের পরও ধীরগতির মিডল-অর্ডার ভুগিয়েছিল ভারতকে। এরপর এসে ঝড় শুরু করেছিলেন অজয় জাদেজা। ২৫ বলে ৪৫ করেছিলেন তিনি, ভারত গিয়েছিল ২৮৭ রান পর্যন্ত। ওয়াকার ইউনিস দুই ওভারে দিয়েছিলেন ৪০ রান। জয়ের জন্য বলের চেয়ে কম রান লাগতো পাকিস্তানের, তবে দুই ওপেনার সাইদ আনোয়ার ও সোহেল ব্যাটিং করতে লাগলেন লক্ষ্যটা ৩৫০- এমন স্টাইলে। ১০ ওভারে উঠলো ৮৪। 

    চিন্নাস্বামির ৫৫ হাজার দর্শক প্রথম ইনিংসে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন শব্দের, সেই তারাই মেরে গেলেন চুপ। চোখে-মুখে বিমর্ষ একটা ভাব তাদের, পাকিস্তানের সঙ্গে একটা পরাজয় উঁকি দিচ্ছে তাদের। একটা ব্রেকথ্রু দরকার, সেটা এনে দিলেন জাভাগাল শ্রীনাথ, তাকে তুলে মারতে গিয়ে অনীল কুম্বলের হাতে ধরা পড়লেন আনোয়ার, ৩২ বলে ৪৮ রান করে। 

    সোহেল থামলেন না শীঘ্রই। তার ওপর ভর করেছে উন্মত্ত কিছু। ১৫তম ওভারের প্রসাদকে ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে কাভার দিয়ে চার মারলেন একটা। শাস্ত্রি তখন মিউজিক ছাড়া লিরিক পড়ছেন। রিপ্লে দেখালো, সোহেল তার সঙ্গী ইজাজের দিকে এগিয়ে আসার আগে পিচের মাঝপথে কথা বলছেন প্রসাদের সঙ্গে। প্রসাদ শুধুই শ্রোতা। কিছু জবাব দেওয়ার নেই। সোহেল ডানহাতে ব্যাটটা উঁচিয়ে প্রসাদকে দেখালেন, বলটা কোনদিকে গেছে- “যা, ওখান থেকে আন!” এরপর আঙুল দিয়ে চোখে দেখালেন, যেন দেখছেন তিনি।  

    প্রসাদ চুপটি মেরে পরের বলটা করতে গেলেন, যেটাতে সোহেলকে জবাব দিবেন তিনি। মোটামুটি একই লেংথে করলেন, তবে এবার আরেকটু ভেতরের দিকে। ফ্রন্টফুট সরিয়ে সোহেল উড়িয়ে মারতে চাইলেন, উলটো উড়লো তার অফস্টাম্প। প্রসাদ সময় নিলেন না, ফলোথ্রু শেষ হওয়ার আগেই হাতটা উঁচিয়ে সোহেলকে দিলেন বিদায়- “এবার তুই যা, ****”। 

    শাস্ত্রি আবার বলা শুরু করেছেন, সোহেল কিভাবে মনযোগ হারালেন। তবে তার কথা তখন মিলিয়ে যাচ্ছে চিন্নাস্বামীর চিৎকারে। হয়ত সবচেয়ে বেশি চিৎকারটা করছিলেন প্রসাদই। 

     

     

    এরপর একদিকে জাভেদ মিঁয়াদাদ আঁকড়ে ধরে থাকলেও মাঝের ওভারগুলিতে স্পিনারদের চাপে খেই হারিয়েছে পাকিস্তান। প্রসাদ শেষ পর্যন্ত নিয়েছিলেন ৪৫ রানে ৩ উইকেট। আর সোহেল অনেক দিন পর বলেছিলেন, “জাভেদ (মিঁয়াদাদ) আমাদের শিখিয়েছিল, কোনও বোলার সমস্যা করলে তার ফোকাসটা নাড়িয়ে দিতে। তবে ভেঙ্কি (প্রসাদ) ফোকাসটা ধরে রেখেছিল, আমি যখন বাউন্সার আশা করছিলাম।” 

    এরপর যা ঘটেছিল- 
    আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মিঁয়াদাদের সেটিই শেষ ম্যাচ ছিল। ভারত পরে ইডেনে সেমিফাইনালে হেরেছিল শ্রীলঙ্কার কাছে।