১৯৯৬ : নন্দনে ক্ষোভের আগুন আর কাম্বলির ক্রন্দন
টনি গ্রেগ নিশ্চিত ছিলেন রিপ্লে দেখানোর আগেই। সনাথ জয়াসুরিয়ার লেগস্টাম্পের বলটা সামনে বাড়িয়ে খেলতে গিয়ে পায়ে লেগেছিল শচীন টেন্ডুলকারের। রান নেওয়ার জন্য হোক বা মোমেন্টাম সামলাতে, ক্রিজ ছেড়ে বেড়িয়ে গিয়েই ভুলটা হলো। রমেশ কালুভিতরানা ব্যাটিংয়ে সেদিন কিছু করতে পারেননি, উইকেটকিপিংয়ে ভুল হলো না তার। টিভি আম্পায়ারের লাইটের দিকে তাকিয়ে সবাই, টেন্ডুলকারের চোখমুখই বলে দিচ্ছিল তিনিও আশা ছেড়ে দিয়েছেন। একটু আগেই উচ্চকিত ইডেনে নেমে এলো সারা-বাংলার নিস্তব্ধতা। ৬৫ রান করে আউট টেন্ডুলকার। ৯৮ রানে ২য় উইকেট হারালো ভারত।
ইডেন গার্ডেনস। সেমিফাইনাল। ১৯৯৬ বিশ্বকাপ।
কোয়ার্টার ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়েছিল ভারত, উল্লাসও শুরু হয়ে গিয়েছিল তাদের। যেন বিশ্বকাপ জেতা সময়ের অপেক্ষা শুধু। পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক আমির সোহেলও লাহোরের ফাইনালের জন্য ভারতকে সেমিফাইনালের আগেই শুভকামনা জানিয়ে গেলেন।
কলকাতায় ভারত পেল স্বপ্নের শুরু। ১ রানেই কালুভিতরানা ও জয়াসুরিয়াকে ফেরালেন জাভাগাল শ্রীনাথ। এরপর অরবিন্দ ডি সিলভার জাদু। এমন নয়, তিনি ক্ষ্যাপাটে বা কিছু হয়ে উঠেছিলেন। খেলতে লাগলেন একের পর এক অর্থোডক্স শট। এমন সব শট, যা আপনাকে ভুলিয়ে দিতে পারে ম্যাচের পরিস্থিতি, আশেপাশের সবকিছু।
শ্রীলঙ্কার ৮৫ রানের মাথায় ৪র্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়েছিলেন ডি সিলভা, একাই করেছিলেন ৬৬ রান। এর মধ্যে ৫৬ রানই তিনি করেছিলেন বাউন্ডারি থেকে, সবই চার। মনে হবে অনন্তকাল ধরে তিনি ছড়িয়ে যাচ্ছেন ব্যাটিং-আনন্দ, অথচ খেলেছিলেন মাত্র ৪৭ বল। ডি সিলভার ভিতে দাঁড়িয়ে রোশান মহানামার ৫৮, অর্জুনা রানাতুঙ্গার ৩৫, হাসান তিলকারত্নের ৩২ রানের পর চামিন্দা ভাসের ১৬ বলে ২৫ রানের ক্যামিওতে শ্রীলঙ্কা তুললো ২৫১ রান। কলকাতায় তখন মার্চের ভ্যাপসা গরম, কঠিন কন্ডিশনে রিটায়ার্ড হার্ট হয়েছিলেন তিলকারত্নে।
নভোজ্যাত সিং সিধু চেয়েছিলেন প্রথমে ব্যাটিং করতে, তবে টসে জিতে ভারত নিয়েছিল ফিল্ডিং। রানতাড়ায় শ্রীলঙ্কাকে সুযোগ না দিতে হয়েছিল এমন সিদ্ধান্ত, অথচ ইডেনে এর আগের ৪টি দিবা-রাত্রির ম্যাচের তিনটিতেই জিতেছিল প্রথমে ব্যাটিং করা দল। সিধু ফ্লাডলাইটের আলোয় টিকলেন না, ভাসকে ক্যাচ দিলেন দলের রান ৮ হওয়ার পরই।
এরপর টেন্ডুলকারের শুরু। সঞ্জয় মাঞ্জরেকার শুধু সঙ্গ দিয়ে গেলেন তাকে। কাভার ড্রাইভ, স্ট্রেইট ড্রাইভ, ফ্লিক, প্যাডল সুইপ- টেন্ডুলকার শটের পসরা সাজিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কাও বুঝে গিয়েছিল, জয়ের চিন্তা করার আগে ফেরাতে হবে তাকে। সেই তার উইকেটটাই তারা পেয়ে গেল যেন না চাইতেই।
ভারতের ব্যাটিং লাইন-আপে নিউক্লিয়াস ছিলেন টেন্ডুলকার। সেটা ধ্বংস করে দিতেই যেন বেরিয়ে পড়লো ফাঁপা অংশটা। আজহারউদ্দিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফিরতি ক্যাচ দিলেন কুমার ধর্মসেনাকে। মাঞ্জরেকার রাউন্ড দ্য লেগে বোল্ড হলেন জয়াসুরিয়ার বলে, একই ভাবে ফিরলেন অজয় জাদেজা, ১১ বলে কোনো রান না করে। জাদেজা-নয়ন মঙ্গিয়ার আগে পাঠানো জাভাগাল শ্রীনাথ রান-আউট। মঙ্গিয়া আকাশে তুললেন বল, আশিস কাপুর দিলেন ক্যাচ।
৯৮ রানে ১ উইকেট ছিল ভারতের, এরপর ২২ রান তুলতে নেই ৭ উইকেট। ইডেনের দর্শকরা টেন্ডুলকারের ব্যাটিংয়ের সময় গর্জন করছিলেন, এরপর স্তব্ধ হয়ে দেখলো এই হরর-শো। এরপর হয়ে উঠলো বিক্ষুব্ধ। স্ট্যান্ডে জললো আগুন। মাঠের মধ্যে ছুটে ছুটে যাচ্ছিল বোতল।
ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েড ১৫ মিনিটের মতো বিরতি নিয়েও শুরু করতে পারলেন না ম্যাচ, জিতিয়ে দেওয়া হলো শ্রীলঙ্কাকে। এর আগে অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিরপত্তার কারণে খেলতে যায়নি বলে ‘ওয়াকওভার’ পেয়েছিল শ্রীলঙ্কা, এবার তারা জিতল দর্শকদের কারণে মাঠের পরিস্থিতি খেলার উপযুক্ত না থাকায়। এক দর্শক প্ল্যাকার্ডে লিখলেন, "কংগ্রাচুলেশন শ্রীলঙ্কা। উই আর স্যরি।"
উদ্বাহু শ্রীলঙ্কানরা বেরিয়ে এলেন ফাইনালে যাওয়ার উল্লাস করতে করতে, আর ওদিকে তখন ভেঙে পড়েছেন ভিনোদ কাম্বলি। পাঁচে নেমেছিলেন, একপাশ থেকে শুধু যাওয়া-আসা দেখেছেন সতীর্থদের। তবে তার মতো স্ট্রোকমেকারও হয়তো জেতাতে পারতেন না সে ম্যাচটা, অবশ্য সে সুযোগটাও তাকে দিল না ইডেন গার্ডেনস।
শেষ পর্যন্ত ‘ঘরের মাটি’র সে বিশ্বকাপে ভারতের ছবি হয়ে থাকলো সেটিই- কাম্বলির কান্না। নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে না পারা এই ব্যাটসম্যানেরও হয়ত ক্যারিয়ারের প্রতীক হয়ে আছে সে ছবিটা।
এরপর কী ঘটেছিল-
অন্য সেমিফাইনালেও ধসের মুখে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফাইনালে শ্রীলঙ্কা জিতেছিল রুপকথার কাব্য লিখে। ২০১১ সালে এসে বিশ্বকাপ জিতেছিলেন টেন্ডুলকার। ইডেনের সেই ম্যাচের পর আর ৩৫ ওয়ানডে খেলে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল কাম্বলির।