১৯৯৬ : মোহালিতে অবাক মতিভ্রম
চোকার। দক্ষিণ আফ্রিকার কথা ভাবা শুরু করে দিয়েছেন তো?
১৯৯৬ বিশ্বকাপে এই ‘চোকিং’য়ের কাজটা করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকেই কোয়ার্টার ফাইনালে হারিয়ে আসা দল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ। যদি জেতা ম্যাচ হেলায় হেরে আসার ফাইল তৈরি করতে বলা হয়, সে ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং হবে এক নম্বরের কেস-স্টাডি। ২০৭ রানতাড়ায় ১৬৫ রানে ২ উইকেট নিয়েও অল-আউট হয়ে ম্যাচটা হেরে গিয়েছিল ক্যারিবীয়রা। মোহালিতে তাদের মতিভ্রমের ব্যাখ্যা হয়তো আজও দিতে পারবেন না কেউ।
কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রায়ান লারার ৯৪ বলে ১১১ রানে দক্ষিণ আফ্রিকাকে পিষ্ট করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, তবে তাদেরকে যেন তখনও তাড়া করে ফিরছিল পুনের ভূত, কেনিয়ার সঙ্গে সেই হার। অবশ্য ম্যাচের আগে সেটা মাথায় ছিল না কারও, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে ছিল ১৯৮৩ সালের পর আবার ফাইনাল খেলার সুযোগ। মোহালির পেস-সহায়ক উইকেটে ব্যাটিং নিয়ে শুরুতেই কার্টলি অ্যামব্রোস ও ইয়ান বিশপের তোপে পড়লো অস্ট্রেলিয়া। মার্ক ওয়াহ, রিকি পন্টিং এলবিডব্লিউ অ্যামব্রোস। স্টিভ ওয়াহ, মার্ক টেইলর বোল্ড বিশপ। অস্ট্রেলিয়া ১৫ রানে ৪ উইকেট।
স্টুয়ার্ট ল হয়তো অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে অনেক বড় দুর্ভাগা একজন, তবে সেদিন তার ভাগ্যটা পক্ষে ছিল। শুরুতে কট-বিহাইন্ড হয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন বিশপ নো করায়। মাইকেল বেভান ঠান্ডা মেজাজের আরেক নাম, মোহালির গরমেও থাকলেন ‘কুল’। দুজনের জুটি ১৩৮ রানের। এরপর ইয়ান হিলির ২৮ বলে ৩১ রানের ক্যামিও। অস্ট্রেলিয়া ২০৭।
ফাইনাল থেকে তাদের দূরত্ব তখনও যোজন যোজন। তার ওপর আছে মোহালির শিশির, শেন ওয়ার্নরা বল গ্রিপই করতে পারছিলেন না ঠিকমতো। উলটো বল ব্যাটে আসছিল দারুণ। কোর্টনি ব্রাউন তাড়াতাড়ি ফিরলেও শিবনারাইন চন্দরপলের সঙ্গে ব্রায়ান লারার ৬৮ ও রিচি রিচার্ডসনের ৭২ রানের জুটি অস্ট্রেলিয়াকে ছিটকে দিয়েছিল ম্যাচ থেকে।
২৭তম ওভারে ঘটলো একটা অদ্ভুত ঘটনা, রিচার্ডসনের জোরের ওপর করা সুইপ গিয়ে লাগল স্কয়ার লেগে দাঁড়ানো আম্পায়ার বিসি কুরের মাথায়। নিশ্চিত চার হয়ে গেল দুই। তবে তখনও ৯৯ রানে ২ উইকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজের, ‘অলুক্ষণে’ কিছু মাথায় আসেনি কারও।
গ্লেন ম্যাকগ্রাকে এরপর তুলে মারতে গেলেন চন্দরপল। মিড-অনে ক্যাচ দিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এরপর জিমি অ্যাডামস ও কিথ আথারটনের আগে পাঠালো রজার হার্পার ও ওটিস গিবসনকে। ব্যাপারটা কি তখনোই আঁচ করতে পেরেছিল তারা? হতে পারে।
এরপর চললো তুলকালাম। হার্পার অফস্টাম্পের বাইরে সরে গিয়ে খেলতে গেলেন ম্যাকগ্রাকে, এলবিডব্লিউ। গিবসন সরে গেলেন লেগে, ওয়ার্নের বলে। কট-বিহাইন্ড। জিমি ‘প্যাডামস’ অ্যাডামস সুইপ করলেন। এলবিডব্লিউ। আথারটন পা থেকে শুরু করে সবকিছু সরিয়ে নিয়ে শুধু হিলির কাছে ধরা পড়লেন। বিশপ ওয়ার্নের ফ্লিপারে বোকা বনার আগে দারুণ কাভার ড্রাইভ করেছিলেন, তবে সেটা সুপারম্যানের মতো ঠেকিয়ে এক রান বাঁচিয়েছিলেন পন্টিং।
ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে এই উইকেটগুলির কথা ভাবুন, ভেসে উঠবে বিভৎস এক চিত্র। প্রশ্ন জাগবে, হচ্ছেটা কী!
অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্ষ্যাপাটেপনা সেখানেই শেষ নয়। তা চললো শেষ ওভারেও। ফ্লেমিংয়ের ওভারে প্রয়োজন ছিল দশ। এতক্ষণ ওপাশে দাঁড়িয়ে সব দেখেছেন রিচার্ডসন। প্রথম বলেই মারলেন চার। তবে দ্বিতীয় বলে চুরি করতে গেলেন সিঙ্গেল, এমনকি হিলিকেও সামনে দৌড়ে এসে বলটা কুড়িয়ে লাগাতে হলো স্টাম্পে। অ্যামব্রোস রান-আউট।
এলেন ওয়ালশ। ওয়ালশ যখন ব্যাটিং করেন, সবচেয়ে স্বস্তিতে থাকেন প্রতিপক্ষরা, আর স্নায়ুচাপে ভোগেন তার সতীর্থরা। হলো সেরকমই। ফ্লেমিংয়ের বলটা কই খেলতে গেলেন কে জানে, হলেন বোল্ড। তখনও অস্ট্রেলিয়াকে ছুঁতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রয়োজন ছিল ৫ রান।
যে ম্যাচটা হারার জন্য রীতিমত সাধনা করতে হয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজ করলো সেটাই, যেন খুব সহজেই। চোকার বললে এরপরও দক্ষিণ আফ্রিকার কথা ভাববেন আগে?
১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন আপনাকে বলে উঠবে, ‘হ্যালো’!
এরপর কী ঘটেছিল-
ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া হেরে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কার কাছে, তবে সেই সেমিফাইনাল যেন হয়ে আছে সেই অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম মূলমন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ- হারার আগে হারছে না তারা। আর এরপরের পাঁচটি বিশ্বকাপেও আর সেমিফাইনালই খেলতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ।