২০০৩ : কালো আর্মব্যান্ডের সাহসী প্রতিবাদ
জানতেন, ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে। জানতেন, দেশ ছাড়তে হতে পারে। শুধু তাই নয়, জীবনেরও হুমকি আছে। তবুও তারা সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন। হারারের এক ক্যাফেতে বসে, ২০০৩ বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার মাসখানেক আগে। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা, এক শ্বেতাঙ্গ আর এক কৃষ্ণাঙ্গ জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটার ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১০ তারিখে সকাল ৯.৩০-এ ক্রিকেট মাঠে দেখিয়েছিলেন এক অন্যরকমের প্রতিবাদ। দুইটা আর্মব্যান্ড আর একটা বিবৃতি দিয়ে।
নামিবিয়ার সঙ্গে ম্যাচটা ছিল জিম্বাবুয়ের ইতিহাসের প্রথম আয়োজনকৃত বিশ্বকাপ ম্যাচ। হারারে স্পোর্টস ক্লাবে জিম্বাবুয়ে সে ম্যাচ জিতেছিল। তবে সব ছাপিয়ে গিয়েছিল ফ্লাওয়ার-ওলোঙ্গার সেই প্রতিবাদ! ২২তম ওভারে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ব্যাটিং করতে নামলেন, হাতে কালো আর্মব্যান্ড। ওলোঙ্গা ড্রেসিংরুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তখন, তার হাতেও একই আর্মব্যান্ড। প্রেসবক্সে সাংবাদিকদের কাছে ততোক্ষণে পৌঁছে গেছে বার্তা, ‘আমরা এর মাধ্যমে শোক প্রকাশ করছি, আমাদের প্রিয় জিম্বাবুয়ের গণতন্ত্রের মৃত্যুর। আমরা এমন করছি জিম্বাবুয়েতে মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ণকারীদের কাছে একটা নীরব আবেদন করতে। আমরা প্রার্থনা করি, আমাদের এ ক্ষুদ্র পদক্ষেপ আমাদের জাতির মতৈক্য ও মর্যাদা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করবে।’
অনুমিতভাবেই ঝড় বয়ে গেল সংবাদমাধ্যমে। সবার নজর ছিল বলেই হয়তো ফ্লাওয়ার-ওলোঙ্গার ‘ক্ষতি’ করতে পারলো ক্ষমতাধরেরা। তবে ওলোঙ্গাকে একাদশ থেকে বাদ দেয়া হলো সাথে সাথেই, টিম-বাস থেকেও নামিয়ে দেয়া হয়েছিল তাকে। ফ্লাওয়ারের সঙ্গেও এমন কিছু করা হতো, যদি না অন্য সব ক্রিকেটার একসাথে ম্যাচ বয়কটের হুমকি না দিতেন। ওলোঙ্গাকে তখনকার জিম্বাবুইয়ান তথ্যমন্ত্রী আখ্যায়িত করেছিলেন ‘আঙ্কেল টম’ (যে কৃষ্ণাঙ্গ হীনমন্যতায় ভুগেন) আর ‘শ্বেতাঙ্গের মুখোশ পরা কৃষ্ণাঙ্গ’ হিসেবে। পরে অবশ্য এক ম্যাচের জন্য তাকে দলে নেয়া হয়েছিল এটা বুঝাতে, তার বাদ পড়াটা ‘রাজনৈতিক’ কোনো ব্যাপার ছিল না।
ফ্লাওয়ার-ওলোঙ্গার প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়লো দর্শকদের মাঝেও। জিম্বাবুয়ের পরের ম্যাচগুলোতে কেউ কালো আর্মব্যান্ড পরে এলেন, কেউ নিয়ে এলেন প্ল্যাকার্ড।
এ ‘জুটি’র সঙ্গে ছিলেন আরেকজন, ডেভিড কলটার্ট। পেশায় আইনজীবি ও মানবাধিকারকর্মী (পরে জিম্বাবুয়ের ক্রীড়ামন্ত্রী হয়েছিলেন) কলটার্ট বেশ কয়েকবার হুমকির সম্মুখীন হয়েছিলেন বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়েই।
বিশ্বকাপের আগে থেকেই খেলা-রাজনীতির তিক্ত মিশ্রণে নীল হয়েছিল জিম্বাবুয়ে। ফ্লাওয়ার-ওলোঙ্গা জিম্বাবুয়ের বিশ্বকাপ উৎসব মাটি করেননি, বরং মনে করিয়ে দিয়েছিলেন কী দুর্দশার মধ্যে বিশ্বকাপটা হয়েছিল তাদের দেশে! তাদের ক্রিকেট আর দেশকে বদলে দেয়ার একটা ‘ক্ষুদ্র’ সুযোগ তারা পেয়েছিলেন। সেটা গ্রহণ করেছিলেন তারা। তাদের কালো আর্মব্যান্ডকে তাই তুলনা করা হয় ১৯৬৮ সালের মেক্সিকো অলিম্পিকের টমি স্মিথ আর জন কার্লোসের ‘ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’-এর সাথে।
‘আমরা একাই পৃথিবী বদলাতে পারি না। তবে সবাই মিলে যদি সবচেয়ে শক্তিশালী সিদ্ধান্তটা নেই, তবে আমরা পরিবর্তন আনতে পারি।’ বিবিসিকে পরে বলেছিলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। আর ওলোঙ্গা বলেছিলেন, ‘(এমন কিছু করলে) আমাদের মূল্য দিতে হয়। কিন্তু আপনি যখন আয়নায় তাকিয়ে নিজের একটা স্বচ্ছ বিবেকের প্রতিচ্ছবি দেখেন, বুঝে নিতে হয় এর পুরস্কারটা।’
এরপর কী ঘটেছিল-
জিম্বাবুয়ে সুপার সিক্সে উঠেছিল সেবার। কেনিয়ার সঙ্গে সুপার সিক্সের ম্যাচটিই হয়ে আছে জিম্বাবুয়ের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হেনরি ওলোংগার শেষ ম্যাচ। আর অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার অবসর ঘোষণা করেছিলেন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচের আগে।ওলোঙ্গাও পেয়েছিলেন মৃত্যুহুমকি, পাড়ি জমিয়েছিলেন ইংল্যান্ড। কাউন্টি ক্লাব এসেক্সের সঙ্গে আগেই চুক্তি ছিল ফ্লাওয়ারের, তিনিও থিতু হয়েছিলেন সেখানেই। পরে তিনি হয়েছিলেন ইংল্যান্ডের কোচ, তাদের অন্যতম সফল কোচ ধরা হয় তাকে।
*১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ প্রথম প্রকাশিত