• ফুটবল, অন্যান্য
  • " />

     

    হেয়ার স্কুলের মাঠ থেকে জগন্নাথের পাখি সেন : বাংলায় ফুটবলের হাতেখড়ি যেভাবে

    হেয়ার স্কুলের মাঠ থেকে জগন্নাথের পাখি সেন : বাংলায় ফুটবলের হাতেখড়ি যেভাবে    

    উপমহাদেশে ফুটবল খেলাটা ব্রিটিশদের হাত ধরেই এসেছিল। আর উপমহাদেশের ফুটবলের হাতেখড়ি হয়েছিল এই বাংলাতেই। কেমন ছিল সে সময়ের ফুটবল? ফুটবল খেলাটা এখানে এতো জনপ্রিয়ই বা হলো কী করে? ঠিক প্রথম ভারতবর্ষে প্রথম ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়, তার নিখুঁত দিন-ক্ষণ সেভাবে জানা যায় না। ১৮৬০ সালে রাগবি আর ফুটবল আলাদা খেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তখনো ফুটবলের নিয়মকানুন আধুনিক ফুটবলের মত পরিপক্ক হয়নি। সেই ১৮৬০ সালেই ভারতবর্ষে খেলতে আসে রয়েল ইঞ্জিনিয়ার্স আর্মি। তারা তখন শখেই ফুটবল খেলত। সেই দলের খেলার মূলমন্ত্রই ছিল বিমল আনন্দ বিতরণ। অবশ্য খোদ ইংল্যান্ডেও তখন ফুটবল ছিল নিছক একটা বিনোদনই। পেশাদারিত্বের নাম গন্ধও ছিল না। নেটফ্লিক্সের ‘দ্য ইংলিশ গেম’ দেখে থাকলে তখনকার ফুটবলের অবস্থা আপনার জানাই।

    পরবর্তীতে রয়েল ইঞ্জিনিয়ার্স ইংল্যান্ডেই খ্যাতনামা ফুটবল দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭২-তে প্রথম এফএ কাপের ফাইনালেও ওঠে তারা। খেলাটি হয়েছিল কেনিংটনের ওভাল স্টেডিয়ামে। যেটি এখন ক্রিকেটের অন্যতম বিখ্যাত ভেন্যু। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের (বোল্টন ওয়ান্ডারার্স নয়) কাছে হেরে অবশ্য শিরোপা আর জেতা হয়নি তাদের। তবে ৩ বছর পর রয়েল ইঞ্জিনিয়ার্স প্রথমবারের মত এফএ কাপে বিজয়ী হয়।

    বিনোদন দেওয়া ও নেওয়ার ভেতর অবশ্য সীমাবদ্ধ ছিল না ফুটবল। ব্রিটিশরা যেখানেই গেছে সঙ্গে করে করে গেছে চর্মগোলক। ভারতবর্ষের ফুটবলের সঙ্গে পরিচিতিটা ওই রয়েল ইঞ্জিনিয়ার্স দলের কাছ থেকেই। 


    রয়েল ইঞ্জিনিয়ার্স আর্মি ফুটবল দল, ১৮৭২


    কলকাতায় ভারতবর্ষে প্রথম ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭৮-এ। ইংরেজ কোম্পানি ট্রেডস অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করে ট্রেডস ক্লাব। সেখানে যদিও ভারতীয়রা খেলার সুযোগ পেত না। খেলত মূলত বিলেতিরাই। এরও আগে অবশ্য 'ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব' নামে এক দল ছিল বাংলায়। কিন্তু সে ক্লাবে ঠিক ফুটবল নয়, খেলা হত রাগবি। তাও অবশ্য ভুলে। ইচ্ছে ছিল ফুটবল খেলার, সেটা হয়ে গিয়েছিল রাগবি!  

    বাংলা তথা ভারতবর্ষের ফুটবলের পথিকৃৎ বলা হয় শ্রী নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারীকে। ফুটবলের জন্য সর্বস্ব বিকিয়েছিলেন ভদ্রলোক। ১৮৭৮-তে কলকাতা হেয়ার স্কুলের ক্লাস সিক্সের পড়ার সময় থেকে ফুটবলের সঙ্গে তার প্রেম। বন্ধুদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে বল কিনে এনেছিলেন এক ইংরেজের দোকান থেকে। খেলা শুরু হয়েছিল স্কুলের মাঠেই। হেয়ার স্কুলের ঠিক পাশেই কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ। কলেজের ছেলেরাও এসে ভিড় জমাতো। মাঠের এলোপাথাড়ি বল গুঁতোনোর এই খেলাতেও দর্শকের অভাব হত না! 

    প্রেসিডেন্সির ছেলেদের সাথে একদিন খেলা দেখতে গিয়েছিলেন কলেজের ব্রিটিশ অধ্যাপক বি. ভি. স্ট্যাকও। তিনিই ভুলটা ভাঙিয়ে দিলেন, “তোমরা যা খেলছ এটা তো ফুটবল না, রাগবি।” মজার ব্যাপার হলো যে বলে খেলা হচ্ছিল সেটাও ছিল রাগবি বল। পরে অধ্যাপক স্ট্যাক ছেলেদের একটি ফুটবল কিনে উপহার দেন। ইংল্যান্ডের ফুটবল এসোসিয়েশনে প্রণয়ণ করা ফুটবলের নিয়মকানুনগুলোও শিখিয়ে দেন।  

    সেই নগেন্দ্র প্রসাদ স্কুল ছেড়ে প্রতিষ্ঠা করেন আরেক ফুটবল দল। নাম দেন ‘ওয়েলিংটন ক্লাব’। নগেন্দ্র প্রসাদ আগাগোড়া তখন থেকেই ফুটবলে বুঁদ হয়ে থাকা এক তরুণ। শোভাবাজার ক্লাব নামে আরও একটি দল সে বছরই গড়ে ওঠে হাতে। ওই ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব করতেই আইএফএ (ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন) এর প্রথম সভায় যোগ দিয়েছিলেন নগেন্দ্র প্রসাদ।  

    ভদ্রলোকের জীবন এতোটাই ফুটবলময় যে সেটা সিনেমার পান্ডুলিপির জন্য অতি রসালো বস্তু। সম্প্রতি কলকাতার চলচ্চিত্র পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। নগেন্দ্র প্রসাদের জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন তিনি। 
     


    নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী


    আইএফএ শিল্ড ভারতবর্ষের প্রাচীনতম ফুটবল টুর্নামেন্ট। প্রতিষ্ঠার বছর ১৮৯৪ সালেই এর প্রথম আসর বসে। ১৯১০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ-ভারতের বিভিন্ন  সামরিক ঘাঁটির ফুটবল দলগুলোই নিয়মিত চ্যাম্পিয়ন হত এই টুর্নামেন্টে। সেই ধারা মোহনবাগান ভাঙল ১৯১১ সালে। বরিশালের ছেলে শিবদাস ভাদুড়ির অধিনায়কত্বে প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে আইএফএ শিল্ড জয় করে। ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে ২-১ গোলে হারানোর দিনটা আসলে পুড়ো বাংলাকেই নাড়িয়ে দিয়েছিলেন নতুন করে। 

    মোহনবাগানের এই জয় ছাপিয়ে গিয়েছিল ফুটবলও। ফুটবল তখন ভারতীয়, বিশেষত বাঙ্গালিদের কাছে ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেরই নামান্তর। ব্রিটিশরা খেলতো বুট পায়ে, আর বাঙালিরা নাঙ্গা পায়ে। গায়ে গতরেও ব্রিটিশরা ছিল বড়সড়। কিন্তু বাঙালিরা ব্রিটিশদের প্রতিরোধ করতো অদ্ভুত সব টেকনিক দিয়ে। যুদ্ধে তো আর পারা যাবে না! ফুটবল মাঠে তো রক্ত মাংসের এগারো বনাম এগারো! সময়ের সঙ্গে ফুটবলই হয়ে উঠেছিল ইংরেজদের শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির 'কোল্ড ওয়ার'। আর এই ‘যুদ্ধই’ ফুটবলকে রাতারাতি জনপ্রিয়তা পাইয়ে দিয়েছিল বাংলায়।

    মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড বিজয়ে প্রায় পুরো কৃতিত্বটা এক হিসেবে পূর্ব বাংলারই। কেননা, দলের এগারোজন খেলোয়াড়ের মধ্যে দশজনই ছিলেন পূর্ববঙ্গের  'বাঙাল'। ফুটবলের সঙ্গে বাংলার সম্পর্কটা তাই রক্তের। 

    *** 


    (১৯১১ সালের আইএফএ শিল্ড বিজয়ী মোহনবাগান ফুটবল দল। সর্বডানে বসা অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ি)


    ঢাকার ফুটবলে ভাদুড়ি পরিবারের ভূমিকা বেশ বড়। শিবদাস ভাদুড়ির ভাই রামদাস ভাদুড়ি ঢাকার ওয়েলিংটন ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠাতা। এই ক্লাবের নামই পরে হয়, ওয়ারি ক্লাব। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি আইএফএ শিল্ডে প্রথম খেলার সুযোগ পেয়েছিল ১৯১৪ সালে। যতদূর জানা যায়, পূর্ববাংলার ফুটবলের শুরু হয় ঢাকা কলেজের মাঠে। এক ব্রিটিশ অধ্যাপক এখানেও রেখেছেন বড় ভূমিকা। অল্প সময়ের মধ্যেই ফুটবল ঢাকায়ও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গড়ে ওঠে ঢাকা স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশন। এই ঢাকা স্পোর্টিং এসোসিয়েশনকে প্রাদেশিক সংগঠন হিসেবে মর্যাদা দিয়েছিল ইন্ডিয়ান ফুটবল এসোসিয়েশন। 

    *** 

    ফুটবলের গোড়ার দিকে ইংলিশ ক্লাব কোরিন্থিয়ান একরকম বিল্পব ঘটিয়েছিল। ফুটবলের স্পোর্টসম্যানশিপের ধারণাটাই আসলে প্রবর্তন করেছিল তারা। তাদের গভীর বিশ্বাস ছিল কোরিন্থিয়ান ক্লাবের কেউ কখনও প্রতিপক্ষকে ফাউল করতে পারে না। তাই প্রতিপক্ষ পেনাল্টি পেলে কোরিন্থিয়ান ক্লাব গোলরক্ষক সরে যেতেন এক পাশে। প্রতিপক্ষকে নির্বিঘ্নে গোল পেতে দিতেন। আর নিজেরা পেনাল্টি পেলে বল মারতেন বারপোস্টের ওপর দিয়ে উড়িয়ে। ফুটবল বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ায় বড় অবদান এই ক্লাবের। রিয়াল মাদ্রিদ পর্যন্ত এই ক্লাবের দেখাদেখি নিজেদের জার্সির রঙ বেছে নিয়েছিল সাদা। আর ব্রাজিলের করিন্থিয়াস তো নামটাই ধার করে নিয়েছিল এই ক্লাবের কাছ থেকে।  

    ১৯০০ শতকের শুরুর দিকে নিয়মি বিশ্বভ্রমণ করতো কোরিন্থিয়ান। ১৯১০ সালে সফর ছিল ব্রাজিলে। ফ্লুমিনেন্সকে দুই খেলায় হারায় ১০-১ আর ৮-১ গোলে হারায় ইংলিশ ক্লাবটি। সাও পাওলো ক্লাব কোরিন্থিয়ানদের কাছে পরাজিত হয় ৮-২ গোলে। কোরিন্থিয়ানদের খেলায় মুগ্ধ হয়ে সাও পাওলো ক্লাব তাদের নামই পরিবর্তন করে ফেলে। নতুন নাম হয় ‘স্পোর্ট ক্লাব কোরিন্থিয়ান পলিস্তা’। যা সাও পাওলো কোরিন্থিয়ান হিসেবেই সারা বিশ্বে পরিচিত। ব্রাজিল ফুটবল দলে অসংখ্য ফুটবলার উঠে এসেছেন এই ক্লাব থেকে। এর মধ্যে রয়েছেন সক্রেটিস, রোনালদো ফেনোমেনন, আদ্রিয়ানো, দিদা সহ অনেকে। দুই আর্জেন্টাইন কার্লোস তেভেজ আর হ্যাভিয়ের মাশ্চেরানোও ইয়োরোপে আসার আগে সাও পাওলো ক্লাবের হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন। 

    ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরাজয়, ১১-৩ গোলের। সেটিও কোরিন্থিয়ান দলের বিপক্ষেই। ১৯০৪ সালের রেকর্ডটা এখনও টিকে আছে।  

    বিলেতের সেই কোরিন্থিয়ান ক্লাব ভারত এসেছিল ১৯৩৭ এ। এর আগে বার্মা ও চীনে সব ম্যাচ জিতে দারুণ ছন্দে চ্ছিল তারা। কলকাতায়ও প্রথম ম্যাচে সহজ জয় পেয়ে কলকাতা মোহামেডানের সঙ্গে ড্র করেছিল তার। 

    সারা দুনিয়ার দলগুলোকে নাকানিচুবানি খাওয়ানো সেই কোরিন্থিয়ান দল জিততে পারেনি কেবল ঢাকায় এসে। ঢাকা স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশনের কাছে ১-০ গোলে হেরে ফিরেছিল তারা। গোল করেছিলেন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র পাখি সেন। দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তারিখ ২১ নভেম্বর, ১৯৩৭। যে দল ব্রাজিলেও কোনও ম্যাচ হারেনি, গোলের বন্যা বইয়ে দিয়ে ইংল্যান্ডেও জিতত নিয়মিত, তারাই ঢাকা থেকে ফিরল খালি হাতে! এজন্যই হয়তো ম্যাচের পরে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কোরিন্থিয়ান দলের অধিনায়ক পি ক্লার্ক বলেছিলেন, "বাংলার রয়েল বেঙ্গল টাইগারের নাম শুনেছিলাম, এবার চোখে দেখলাম।"

     

    তথ্যসূত্র

    ১. http://www.thefa.com/competitions/thefacup/more/finals
    ২. খান, শামসুজ্জামান, দুনিয়া মাতানো বিশ্বকাপ, বাংলাএকাডেমী, ১৯৮৭
    ৩. https://www.anandabazar.com/entertainment/dev-is-going-to-play-footballer-nagendra-prasad-sarbadhikari-in-his-next-film-dgtl-1.1080118
    ৪. http://www.indianfootball.de/team/1911ifashield.html
    ৫. http://www.corinthian-casuals.com/corinthian-tours.html
    ৬.  http://www.soccer365.com/the-story-behind-the-real-madrid-home-jersey/
    ৭. http://www.corinthian-casuals.com/trivia.html