জেদি লিডসকে খালি হাতে ফেরাল সালাহর হ্যাটট্রিক
ফুলটাইম
লিভারপুল ৪-৩ লিডস ইউনাইটেড
অ্যানফিল্ডে লিডস ইউনাইটেড গোঁ ধরে বসেছিল। চ্যাম্পিনরা এগিয়ে যায়, লিডস ফেরত আসে। এই তালে খেলা চলল তিনবার। গোল হলো ৬ বার। ১৬ বছর পর প্রিমিয়ার লিগে ফিরে মার্সেলো বিয়েলসা আরেকবার নিজের জাত চেনাচ্ছিলেন। ডাগ আউটে ইউর্গেন ক্লপও তাতে ভড়কে গিয়েছিলেন হয়ত। অবশ্য এই লিভারপুল যে বদলায়নি তার প্রমাণও মিলল ৮৮ মিনিটে। আগের মৌসুমে বারবার শেষ মুহুর্তে প্রতিপক্ষের হাসি কেড়ে নিয়েছিল লিভারপুল। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। লিডসের ৩০ মিলিয়ন দামে কেনা রদ্রিগো মরেনো ৮৮ মিনিটে বোকার মতো বক্সে এক ফাউল করলেন ফাবিনহোকে। সেখান থেকে মোহামেদ সালাহ দ্বিতীয়বারের মতো পেনাল্টি থেকে সফল। তাতে হ্যাটট্রিকও পূরণ হয়েছে লিভারপুল ফরোয়ার্ডের। চতুর্থবারে পিছিয়ে পড়ে তখন আর সমতায় ফেরা হয়নি লিডসের। লিভারপুলের বিপক্ষে লিডসের লড়াই থেমেছে খালি হাতেই। তবে তার আগে সাত গোলের দুর্দান্ত ম্যাচের সাক্ষী হয়েছে অ্যানফিল্ড।
প্রিমিয়ার লিগে নতুন মৌসুমের প্রথম দিন সব আলো ছিল এই ম্যাচ ঘিরে। ইউর্গেন ক্লপ আর বিয়েলসা দুইজনই তাদের ফুটবলীয় দর্শনের জন্য বিখ্যাত। লিভারপুল চ্যাম্পিয়ন, তাদের সামর্থ্য নিয়ে সংশয় ছিল না। প্রশ্ন ছিল লিডসকে ঘিরে। বিয়েলসা আর শেষ পর্যন্ত আপোস করেননি। অ্যানফিল্ডে তার দল খেলেছে আক্রমণাত্মক ফুটবল। তার সুফল শেষ পর্যন্ত পেতে পেতেও আর পায়নি লিডস।
ম্যাচের শেষটার মতো শুরুটাও করেছিলেন সালাহ। ওই দুইবারই তিনি গোল করেছেন পেনাল্টি থেকে। রদ্রিগোর মতো প্রথম পেনাল্টিও লিভারপুলকে উপহার দিয়েছিলেন নতুন আসা কেভিন কখ। চতুর্থ মিনিটে কখের অবশ্য তেমন কিছু করার ছিল না। বক্সের বাইরে থেকে করা শট তার উরুতে লেগে পরে ছুঁয়েছিল হাত। জার্মান ডিফেন্ডার সেদিক থেকে অভাগাই। সালাহ তখন সোজাসুজি রকেট গতির শটে এগিয়ে দিয়েছিলেন লিভারপুলকে।
প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার দিন পর প্রিমিয়ার লিগে ফেরা লিডস তখনও ধাতস্থ হয়ে উঠতে পারেনি। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পিছিয়ে পড়ার পর অবশ্য হালও ছাড়েনি তারা। বিয়েলসার ৪-১-৪-১ ফরমেশন ভেঙে চুরে নানান রূপ নেওয়া শুরু করেছিল ম্যাচের দশ মিনিট না যেতেই। ১২ মিনিটেই তাতে ধন্ধে পড়ে গেল লিভারপুল। কেলভিন ফিলিপসের লং বল বামপ্রান্তে রিসিভ করে, কাট করে ঢুকেছিলেন জ্যাক হ্যারিসন। অ্যালেক্সান্ডার আর্নল্ড ছিলেন তার সামনে, পাত্তা পাননি। এরপর বক্সের বাইরে থেকে দারুণ এক শটে অ্যালিসনকে পরাস্থ করেন হ্যারিসন।
প্রিমিয়ার লিগের তরুণ দল হিসেবে এরপর লিডসের আনাড়িপনাও ফুটে উঠেছে রক্ষণে। কর্নার থেকে ভার্জিল ভ্যান ডাইক সহজেই কখকে ফাঁকি দিয়ে ফ্রি- হেডারে গোল করে ম্যাচের ২০ মিনিটেই আবার এগিয়ে দিয়েছিলেন লিভারপুলকে। সেই ভ্যান ডাইক দশ মিনিট পর অবশ্য লিডসকে উপহার দিয়েছেন আরেক গোল। বক্সের মাথায় বল ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হয়ে প্যাট্রিক ব্যামফোর্ডকে বল দিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ভ্যান ডাইকের ভুলের সুযোগ নিয়ে ব্যামফোর্ড তার আগের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন অ্যালিসনের মাথার ওপর দিয়ে বল তুলে দিয়ে। এর খানিকক্ষণ আগে অ্যালিসনের সঙ্গে ওয়ান অন ওয়ানে ব্যর্থ হয়েছিলেন ব্যামফোর্ড।
ম্যাচের প্রথম আধঘন্টায় ৪ গোল। ক্লপ-বিয়েলসার লড়াই তখন প্রত্যাশামতোই চলছে। ৩৩ মিনিটে তাতে আরেকটু আঁচ বাড়িয়ে দিলেন সালাহ। সেটপিস থেকে বল ক্লিয়ার করতে পারেনি লিডস। বক্সের ভেতর সালাহ বল পেয়ে গিয়েছিলেন ফাঁকায়। ওখান থেকে গোল করতে হলে টপ কর্নারে বল জড়াতে হত। দারুণ ফার্স্টটাচে বল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর সালাহ হাতে সময়ও পেয়েছিলেন নিখুঁত হওয়ার জন্য। বাম পায়ে বল মেরেছিলেনও জায়গামতো। ৩৩ মিনিটে স্কোরলাইন, লিভারপুল ৩-২ লিডস।
প্রথমার্ধে লিডসের মিডফিল্ডে ফিলিপস ছিলেন দারুণ। দুর্দান্ত সব লং বল যুগিয়ে দলকে আক্রমণে সাহায্য করছিলেন ইংলিশ মিডফিল্ডার। দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য খানিকটা চুপসে গিয়েছিলেন তিনি। তবে লিডস লিভারপুলকে দুশ্চিন্তায় ফেলে গেছে বারবার।
লিভারপুল হাইপ্রেসে খেলতে অভ্যস্ত। লিডসও তাদের বিপক্ষে খেলেছে একই ধাঁচে। রক্ষণাত্মক খেলার চেষ্টাও করেনি তারা। হাইপ্রেসেই তৃতীয়বারের মতো লিডসে ফিরিয়ে এনেছিল ম্যাচে। লিভারপুলের অ্যাটাকিং থার্ডে বল উদ্ধার করার পর ডানদিক থেকে হেল্ডার কস্তা ক্রস ফেলেছিলেন বক্সে। মাতেউস ক্লিখ সেই বল দুর্দান্ত এক টাচে রিসিভ করে সেখান থেকেই ভলি করেছিলেন। ৬৬ মিনিটে তাই আরও একবার ম্যাচে ফিরেছিল লিডস।
দ্বিতীয়ার্ধের লম্বা একটা সময় লিভারপুলকে উলটো বল পেতে হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়েছে। বল পজেশনেও তখন এগিয়ে ছিল লিডস। লিভারপুল অবশ্য রক্ষণে ভুল করলেও আক্রমণে ছিল ধারালোই। নিয়িমিতই সুযোগ তৈরি করে যাচ্ছিলেন সালাহ-মানেরা। তবে ক্লপ খানিকটা সতর্ক হয়েই ৫৮ মিনিটে নাবি কেইতার জায়গায় ফাবিনহোকে মাঠে নামিয়েছিলেন। ফাবিনহো আর রদ্রিগোর একটি মুহুর্ত পরে ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিয়েছে।
লিডসের স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড রদ্রিগো মাঠে নেমছিলেন ৬২ মিনিটে। তেমন একটা বলের নাগাল পাননি তিনি বাকি সময়ে। বিয়েলসা তাকে গোলের আশাতেই নামিয়েছিলেন। কিন্তু ৮৮ মিনিটে তিনিই নিজের বক্সের ভেতর ফাবিনহোকে ফাউল করে পেনাল্টি দিয়ে বসেন লিভারপুলকে। সালাহও তখন হ্যাটট্রিক পূরণ করে দলের জয় নিশ্চিত করেন।
এর আগে প্রথম গোলের পরই দারুণ এক রেকর্ড গড়েছিলেন সালাহ। ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এরপর ২০২০ এও লিগের প্রথম দিনে গোলের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন তিনি। টেডি শেরিংহাম ১৯৯২-১৯৯৫ সাল পর্যন্তই টানা চার মৌসুম প্রথম ম্যাচে গোল করেছিলেন। সালাহ বসেছেন তার পাশে। মিশরিয় ফরোয়ার্ড ম্যাচের শুরুর দিকে গোল করার পরই অবশ্য লিভারপুল সমর্থকেরা জানতেন এই ম্যাচে জিতবেন তারা। লিগে আগের ৩৪ ম্যাচে সালাহ যতবার গোল করেছেন, ততোবার জিতেছে লিভারপুল। সেই সংখ্যাটা এখন বেড়ে হলো ৩৫। ২০০৮-২০১১ পর্যন্ত টানা ৩৪ ম্যাচ একই ধারায় গোল করে দলকে জেতানোর ভূমিকা রেখেছিলেন ওয়েইন রুনি। সালাহ সেই রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছেন।
সালাহর কীর্তিতে বিয়েলসা প্রিমিয়ার লিগের প্রথম ম্যাচ থেকে খালি হাতে ফিরেছেন বটে, তবে লিডসের এই খেলা বাকি যে কোনো দলকে আরেকটু সতর্কই করে দেওয়ার কথা। চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে এমন বুক চিতিয়ে লড়াই করতে পারলে বাকিরা বাদ যাবে কেন!