• অস্ট্রেলিয়ার ইংল্যান্ড সফর ২০২০
  • " />

     

    মরগানের 'অল-ইন' গেম, 'অল-আউট' অস্ট্রেলিয়া

    মরগানের 'অল-ইন' গেম, 'অল-আউট' অস্ট্রেলিয়া    

    শেন ওয়ার্ন পোকার ভালবাসেন। 

    পোকার নাকি গলফ-- ক্রিকেটের বাইরে এ দুটির একটি বেছে নিতে বললে হয়তো ওয়ার্ন বলবেন-- সম্ভব নয়। দুই সন্তানের মাঝে কাকে বেশি ভালবাসেন, এমন প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায় নাকি! ওয়ার্ন পোকার, গলফকে সন্তান বলেছেন, এমন জানা নেই। তবে হ্যাম্পশায়ার আর রাজস্থান রয়্যালসের তুলনা করতে গিয়ে বলেছিলেন এমন। এই দুই ঘরোয়া দলেই ওয়ার্ন অধিনায়কত্ব করেছেন। ওয়ার্ন অস্ট্রেলিয়াকে পূর্ণমেয়াদে নেতৃত্ব না দেওয়া সেরা অধিনায়ক। সে আক্ষেপ অস্ট্রেলিয়ার আছে কিনা, কে জানে। ওয়ার্নের আছে। তবে হ্যাম্পশায়ার বা রাজস্থানে গিয়ে অধিনায়কত্ব না করতে পারার আক্ষেপ তো কিছুটা হলেও ঘুচেছিল তার। ওয়ার্ন অধিনায়কত্ব ভালবাসেন। 

    ২৩২ রানের লক্ষ্য, অর্ধেক ওভার শেষে ২ উইকেটে ১২১ রান অস্ট্রেলিয়া। অইন মরগান আনলেন জফরা আর্চারকে। অ্যারন ফিঞ্চ ও মারনাস ল্যাবুশেনের জুটি জমে গেছে। শুরুতে আর্চার যেমন বোলিং করেছেন, তাতে তাকে দিয়ে আরও ওভার দুয়েক করানো যেতো কিনা, সে আলোচনা চলছে কমেন্ট্রিতে। আর্চারের পর ক্রিস ওকস। নতুন বলের জুটিকে ফিরিয়ে আনলেন মরগান। তার উইকেট প্রয়োজন। দুজনের বাকি ১০ ওভার, ৫ ওভারে দুজন মিলে দিলেন ২২ রান। পরের ওভারও করতে এলেন ওকস। 

    ওয়ার্ন পোকারের ভাষায় বলছিলেন, মরগান ‘অল-ইন গেম’ খেলছেন। 

    নিপড-ব্যাক ডেলিভারিটা মিস করে গেলেন ল্যাবুশেন। মরগান নিলেন রিভিউ। টিভি আম্পায়ার বল-ট্র্যাকিং দেখার সময় ইমপ্যাক্ট ইন-লাইন হওয়ার পরই স্টাম্প-মাইকে চিৎকার শোনা গেল ইংলিশদের। বল হিট করবে, এতে তাদের সংশয়ই ছিল না রিপ্লে দেখার পর। 

    তবে মরগান ল্যাবুশেনের উইকেট পেয়েও থামলেন না। আর্চারকে তার ৯ম ওভারে আনলেন। আর্চার লেংথ হিট করলেন, মিচেল মার্শের ব্যাট হিট করে বল লাগলো স্টাম্পে। ‘নকড’ইম ওভার’, ওয়ার্ন চিৎকার করে উঠলেন। এমন চিৎকার আরও দুইবার করে উঠলেন ওয়ার্ন, পরের ৩ ওভারের মাঝে। 

    ফিঞ্চকে ফেরাতে হবে, ইংল্যান্ডের আশা থাকবে তখন। ওয়ার্ন গুণতে লাগলেন, আর্চার-ওকসের কয় বল বাকি। ভুলও করে ফেললেন একবার, ওকসের এক ওভার বাদ পড়ে গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের সেসব বল পার করতে বলছিলেন কমেন্ট্রিতে। তবে ল্যাবুশেনের পর মার্শ বা ফিঞ্চের পর গ্লেন ম্যাক্সওয়েল-- কেউ ওয়ার্নের কথা শুনতে পেলেন না, শুনলেনও না।
     


    ইংল্যান্ডের পেস আক্রমণ


    অল-ইন গেম খেলে মরগান ১০ ওভারে দুই স্ট্রাইক বোলারকে দিয়ে তুললেন ৪ উইকেট। ১২১ রানে ২ উইকেট থেকে অস্ট্রেলিয়া ১৫০ রানে ৬ উইকেট। ফিরে আসছিল প্রথম টি-টোয়েন্টির ভূত। 

    তবে মরগানের হিসাব বাকি ছিল। এবার আর অল-ইন খেলার উপায় নেই, খেলতে হবে শেষ পর্যন্ত। কার্ডের নতুন ডিল হয়ে গেছে। 

    ওয়ানডেতে মাঝের ওভারগুলিতে উইকেটের প্রয়োজন হলে লিয়াম প্লাঙ্কেটকে ডাকতেন তিনি আগে, তবে দারুণ বিশ্বকাপের পরও তাকে রেখে সামনে এগিয়েছে ইংল্যান্ড। প্লাঙ্কেটের শূন্যস্থান পূরণ হয়নি। মাঝের ওভারগুলিতে অবশ্য মরগানের ভরসা কম নেই রশিদের ওপর।

    আর্চার-ওকসের পর এবার তার দিকে ভিড়লেন তিনি। বোলিংয়ে দিনটা তখনও সুবিধার যায়নি রশিদের, যদিও ব্যাটিংয়ে ইংল্যান্ডকে লড়াই করার মতো স্কোর এনে দেওয়ার কৃতিত্ব টম কারানের সঙ্গে তার। প্রায় ১০ ওভার বাকি থাকতে ১৪৯ রানে ৮ উইকেট ছিল না ইংল্যান্ডের। শেষ ৫৯ বলে ইংল্যান্ড তুলেছে ৮২, শেষ ৪ ওভারে ৫৩ রান। 

    মরগানকে এখন অঙ্ক কষতে হবে। রশিদের বাকি ৪, কারান ভাতৃদ্বয়ের ১১। অল-আউট-এর আক্রমণাত্মক গেম খেলার পর এবার ভার বহনের পালা। সে ভারে আছে চাপ। নিজের ৮ম ওভারে প্যাট কামিন্সের হাতে ছয় খেলেন রশিদ। তার সঙ্গে আরেকদিক থেকে করছিলেন টম কারান। 

    এক পর্যায়ে পরিস্থিতি এমন, একদিক থেকে টানা ৬ ওভার বোলিং করতে হবে স্যাম কারানকে। ১৯ টেস্ট খেলে ফেলেছেন, তবে ছোট কারানের এটি মাত্র ৪র্থ ওয়ানডে। শেষ খেলেছিলেন এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে, এরপর মনুষ্য পৃথিবীতে একটা মহামারিও চলে এসেছে স্যাম কারান আরেকটি ওয়ানডের খেলার আগে। 

    কারান অবশ্য এ স্পেলে প্রথম ওভারে চমক দেখালেন। তিনি বোলিং করতে গেলে লেংথে করে ফেলবেন, এ আশঙ্কা ছিল। ক্রিস ওকস এসে বলেছিলেন, সেটাই দরকার। এ উইকেটের মূল অস্ত্রই লেংথ হিট করে স্টাম্পে বোলিং করা। 

    প্যাট কামিন্সের পর মিচেল স্টার্ক-- পরপর দুই বলে দুজনকে ফেরালেন কারান, দাঁড়িয়ে গেলেন হ্যাটট্রিকের সামনে। ক্যামেরায় ধরা পড়া জাস্টিন ল্যাঙ্গারের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, এদিন তিনি ড্রেসিংরুমে কী বলবেন, সেটা শুধু ‘দ্য টেস্ট’-এর পরের সিজনেই জানা যাবেন (যদি বের হয়)!

    অ্যাডাম জ্যাম্পা এলেন। অ্যালেক্স ক্যারি তখনও নিজের অল-ইন বা অল-আউট খেলার কথা ভাবছেন না। ক্যারির সময় ফিল্ডার ছড়ানো থাকে, জ্যাম্পার সময় ক্লোজ হয়ে আসে। ক্যারি সিঙ্গেল নেন, এরপর জ্যাম্পা বল হজম করেন। ওল্ড ট্রাফোর্ডে ক্ষণিকের জন্য হাজার বছরের পুরোনো দৃশ্য হয়ে গেল সেটি। তবে কারান ড্রাইভিং লেংথে বল করেন না-- টমও না, স্যামও না। মরগান চান, তার বোলাররা পরিকল্পনায় অটুট থাকুক। 

    জ্যাম্পা চাপ নিতে না পেরে ফিরে যান। ক্যারি তখনও অপেক্ষায়। টম কারানের ওভার শেষ হয়, ক্যারি রশিদকে টার্গেট করবেন। রশিদ আসেন, অবশেষে ক্যারি একটা চার মারেন। তার দীর্ঘ সময় ধরে খেলা ইনিংসের ৩৪তম বলে গিয়ে। ৫৭ বলের বাউন্ডারি-খরা কাটে অস্ট্রেলিয়ার। এরপর কারানের লেংথ বলে লং-অফে পাঠান আরেকটি চারের জন্য। 

    শেষ বলে ১২ বলে প্রয়োজন ২৭। একটা বড় ওভার দরকার অস্ট্রেলিয়ার নিশ্চিতভাবেই। ক্যারি যাকে টার্গেট করতে চাচ্ছিলেন, সেই রশিদের শেষ ওভার। 

    ওল্ড ট্রাফোর্ডে যে পিচে খেলা হচ্ছিল, সেটি ব্যবহৃত উইকেট, নতুন ব্যাটসম্যানের জন্য মোটেই সুবিধার নয়। তবে মাঠে একদিকের বাউন্ডারি ছোট। রশিদ ব্রায়ান স্ট্যাথাম প্রান্ত থেকে নিজের শেষ ওভার করতে এলেন, ক্যারির জন্য লেগসাইডের বাউন্ডারি থাকলো ছোট। লং-অন বাউন্ডারির দিকে তাক করতে পারেন, এই ভেবে সেখানকার ফিল্ডার বদলালেন মরগান। আর্চার ১০ ওভার বোলিং করেছেন, তাকে সরিয়ে আনলেন নিজের অন্যতম সেরা ফিল্ডার বেইরস্টোকে, যদিও বেইরস্টো এ ম্যাচেও একটা মিসফিল্ড করে চার দিয়েছেন। কয়েক ম্যাচ ধরে ইংল্যান্ডের ফিল্ডিং কুৎসিত। 

    এই সিরিজের আগে শেষ বিশ্বকাপে দেখা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ইংল্যান্ডের। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে লড়াই করলেও পেরে উঠলো না ইংল্যান্ড, তৃতীয় টি-টোয়েন্টি থেকেই মোমেন্টাম যেন অস্ট্রেলিয়ার দিকে। আর্চার-ওকসের স্পেল চলার সময় এ নিয়েই আলোচনা করছিলেন ওয়ার্ন। 

    তবে একসময় হাতের নাগালে থাকা ম্যাচটা জেতার জন্য তখন অস্ট্রেলিয়াকে করতে হবে দারুণ কিছু। ক্যারিকে করতে হবে বিশেষ কিছু। শেষ ওভারেও রশিদ অবধারিতভাবেই গুগলির দিকে ঝুঁকলেন। ডেভিড লয়েডের ভাষায়, বোলিং করার আগেই তিনি জানেন গুগলি হতে যাচ্ছে। তেমনই এক গুগলিতে ক্যারি ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে নাগাল পেলেন না। উইকেটের পেছনে জস বাটলার ভুল করলেন না। কমেন্ট্রিতে ওয়ার্ন থাকলে বলতেন, ‘দ্যাটস আ গুড রং-আন’। এ দিন ৫১ পূর্ণ করেছেন তিনি। জন্মদিনে অস্ট্রেলিয়ার জয় চেয়েছিলেন, ওকস-আর্চার-মরগানদের প্রশংসা করার সঙ্গে সঙ্গে। 

    তবে মরগান অল-ইন গেম খেলে সেটা হতে দিলেন না। ২০১৫ সালের পর দেশের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজ হারেনি ইংল্যান্ড, সে রেকর্ডটা এদিনই প্রায় ভেঙেই গিয়েছিল। সেই প্রায় থেকে সেই রেকর্ডটা টিকে গেল অন্তত আরেক ম্যাচ, অথবা আরও বেশি।