• " />

     

    যার বাঁ পায়ের কাছে লুটাতো পৃথিবী

    যার বাঁ পায়ের কাছে লুটাতো পৃথিবী    

    নব্বইয়ের জুলাই। নাপোলির সান পাওলো স্টেডিয়াম। টাইব্রেকারে দলের চতুর্থ শট নিতে আসছেন ঘরের ছেলে। তবে ভুল জার্সিতে, আর্জেন্টিনার হয়ে। আগের ম্যাচেই টাইব্রেকারে শট মিস করেছেন। কী ভীষণ স্নায়ুচাপ! আর চারদিকে গ্যালারিভরা দ্বিধাগ্রস্থ দর্শক যারা কীনা ম্যাচের একশ’ বিশ মিনিট পরেও বুঝে উঠতে পারছে না কার জন্য চেঁচাবে। নিজের দেশ নাকি এই পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি গড়নের ভিনদেশী লোকটার জন্য? যে এতকাল দু’হাত ভরে দিয়ে গেল তাদের, আজ বুঝি সব ফিরিয়ে নিবে? বিধাতা এমন রাতের জন্য নিজ হাতে লিখে রাখেন এসব স্ক্রিপ্ট! 

    তবে সেসময় নাপোলির লোকজনের কাছে বিধাতা মানে এই লোকটাও। যিশু খ্রিস্টের ছবির পাশে আঠা দিয়ে লাগানো থাকত তারও ছবি। ইতালির অভিজাত এলাকার কাছে চিরকালের অচ্ছ্যুৎ নাপোলিকে একাই বানিয়েছেন ইতালির সম্রাট, পরিয়েছেন ইউরোপ সেরার মুকুট। শহরের কবরস্থানের পাশে তাই ব্যানার ঝুলত মৃতদের উদ্দেশ্যে, ‘তোমরা জানোও না কী মিস করেছ!’  

    নাপোলির আগে অবশ্য জয় করা হয়ে গিয়েছিল দুনিয়াও- ছিয়াশিতে, প্রাসাদের নগরী মেক্সিকান সিটিতে। সাদামাটা এক দলকে নিয়ে একাই শিরোপা জেতানোর গল্প কেবল পাওয়া যায় রূপকথায়, গল্পে, সিনেমাতে। সেটাকে মর্ত্যে নামিয়ে আনলেন তিনি। পুরো ফাইনালেই আটকে ছিলেন ম্যাথিউসের কঠিন শৃংখলে; দুই গোলের লিড হারানোর পর হঠাৎই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলেন যেন। মার্কারদের ছিটকে ‘কিলার পাস’ বাড়িয়ে দিলেন বুরুচাগাকে। হাতে নিলেন দুনিয়ার তাবৎ ফুটবলারদের সবচেয়ে আরাধ্য ট্রফিটা।   


    সেমিতেও ছিল তার একারই ম্যাজিক। শিফোর বেলজিয়ামকে বারো মিনিটের মধ্যে দু’বার ঘোল খাওয়ালেন একাই। তবে এসবও যেন নস্যি লাগছিল ঠিক আগের ম্যাচটার জন্য। অমর-অক্ষয় সেই ম্যাচ! 

    ফকল্যান্ড যুদ্ধের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল বুকেই। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে তাই মাঠকেই বেছে নিলেন সবচেয়ে মোক্ষম জায়গা হিসেবে। বিশ্বকাপ তো বটেই, ফুটবল ইতিহাসেরই সবচেয়ে নিন্দিত আর নন্দিত দুই গোল এক ম্যাচেই, তাও একজনের কাছ থেকেই। ভাবা যায়? 

    ছিয়াশির সেই টুর্নামেন্ট এদেশে আবার রঙিন টিভির প্রথম বিশ্বকাপ। মেক্সিকান ঢেউয়ের মত তাই এখানে আছড়ে পড়ল তার ক্যারিশমা। আর্জেন্টিনা থেকে সাড়ে দশ হাজার মাইল দূরে সাড়ে দশ কোটি মানুষকে আবেগে ভাসালেন তিনি। চিরকালের বঞ্চিত-শোষিত বাঙালি মনে মনে এমন একজনকেই যেন খুঁজছিল দেবতার আসনে বসানোর জন্য, যে কীনা তাদের মতনই মার খাবে, অথচ শেষে একাই দুমড়ে মুচড়ে দিবে সব প্রতিপক্ষকে। মধ্যবিত্ত জীবনের সব না-পাওয়া যেন ঘুচে যাবে ওই চর্মগোলককে চুম্বকসম করা পায়ের জাদুতে। 

    সেই প্রজন্মের তাই সবারই গল্প আছে লোকটাকে ঘিরে। সেসব গল্প কখনো হাসায়, আবার কখনো কাঁদায়, কখনো অবিশ্বাসের ঢেউ তুলে মনে। কারও এলাকায় প্রথম টিভি, কারও প্রথম খেলা দেখা বাবার সাথে, কারও প্রথম জার্সি কেনা, কারও আবার ফুটবল চেনার আগেই লোকটাকে চিনে ফেলা। পুসকাস-ক্রুইফ-মেসিদের হৃদয়ভাঙ্গা জার্মানদের সাথে নব্বইয়ের ফাইনালে বিতর্কিত সেই ম্যাচে হারার পর তার চোখের জল তাই বুক ভাসিয়ে নেয় তেপান্তর পাড়ি দিয়ে। 

    লোকটার জন্যই এই বদ্বীপ তাই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দু’ভাগ হয়ে গেল। সেলেসাও সাপোর্টাররা প্রকাশ্যে দুয়ো দিলেও গোপনে ঠিকই জানত, তার মত আর কেউ নেই। তুরিনের আল্পস স্টেডিয়ামে পুরো ম্যাচ প্রায় নিশ্চুপ থেকে মূহুর্তের ম্যাজিকে ক্যানিজিয়াকে বাড়ানো সেই পাসের পর আরও ভালভাবে জানল তারা। 

    এত খ্যাতির ভার কাঁধে নিয়ে সহজে ঘোরা যায়না। অনেক চাপ। এমন চাপ যে ওই জায়গায় নিজে না থাকলে কোনো অক্ষরের সাধ্য নাই সে ভার বোঝানোর। উদ্দামতার লাগামও তাই টেনে ধরা দায় হয়ে যায় কোনও কোনও সময়। কেউ আবার চায় কেবল নিজের মত করে ভোগ কিংবা উপভোগ করে নিতে এই ক্ষণিক জীবনটাকে।    

    সেই লোকটাও তাই বেপথু হলেন। আত্মবিধ্বংসী এলোমেলো পথে টেনে নিয়ে গেলেন নিজেকে, আরও বহু প্রকৃতিদত্ত প্রতিভাবান লোকের মতই। ড্রাগ-অ্যালকোহল-পার্টি-নারীর পঙ্কিল পথে হাঁটলেন। মাঠ থেকে নিষিদ্ধ হলেন। বারবার সার্জনের ছুরির নিচে নিজেকে সঁপে দিলেন। কিছু করতে ইচ্ছে হলেই বোধ হয় দু’বার ভাবতেন না। জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিজের মর্জিমত নেড়েচেড়ে দেখতেই বা ক’জন পারে! ‘মানুষ’ হিসেবে  এসব ‘ভুল’ তাই জীবনেরই অংশ। নাকি আমরা মানুষরাই তাকে ভুল বুঝতাম? 

    বুয়েনস আইরেসের বস্তিতে জন্ম ছিল তার। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স-বোকা জুনিয়র্স ঘুরে ইউরোপ মাতাতে এরপর গেলেন বার্সেলোনা আর নাপোলিতে। ইতিহাসে দু’বার রেকর্ড ট্রান্সফার ফি-তে দলবদল করার নজির নাই আর কারও। বলের উপর অবিশ্বাস্য নিয়ন্ত্রণ, এইটুকু শরীরের ছন্দমধুর অথচ ক্ষিপ্র গতি, আর বাঁ পায়ের জাদুতে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, এশিয়া আর এই ছোট্ট ব-দ্বীপকেও। 

    দিনশেষে তাই ফুটবলই ধন্য হয়। ‘বিউটিফুল গেম’ আরও বিউটিফুল হয় এমন একজনকে পেয়ে। 

    তিনি ছিলেন জাদুকর, একই সাথে বিদ্রোহী, খানিকটা খ্যাপাটে। সবাই কিছু না কিছু করতে চায় তার মত। কেউ তার মত ড্রিবলিং আর বল কন্ট্রোল করতে চায়, কেউবা একাই দলকে বাইশ ক্যারেট সোনা মোড়ানো ট্রফিটা পাইয়ে দিতে চায়, ইউরোপের অখ্যাত এক ক্লাবকে একাই সেরা বানাতে চায়, আবার মধ্যমাঠ থেকে বল নিয়ে ছয়জনকে কাটিয়ে গোল দিতে চায় কেউ কেউ, কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছেমত জীবন কাটাতে চায় কেউবা। কিন্তু স্বপ্ন-জাদু-বিদ্রোহ-পাপ-বিজয়-পতন সবকিছু মিলিয়ে একজন হতে পারে ওই একজনই। যার নাম ডিয়েগো আরমেন্ডো ম্যারাডোনা, যার বাঁ পায়ের কাছে লুটাতো পুরো পৃথিবী…