• আফ্রিকান নেশন্স কাপ
  • " />

     

    বাংলাদেশে ব্যর্থ সেইন্টফিট আফকনে লিখছেন গাম্বিয়ান রূপকথা

    বাংলাদেশে ব্যর্থ সেইন্টফিট আফকনে লিখছেন গাম্বিয়ান রূপকথা    

    বাংলাদেশের ফুটবল যারা নিয়মিত অনুসরণ করেন, তাদের কাছে টম সেইন্টফিটের নামটা চেনা ঠেকতে পারে। জাতীয় দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন একটা সময়, কিন্তু ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে চলে যেতে হয় দ্রুতই। সেই সেইন্টফিটই এবার আফ্রিকান নেশনস কাপে জন্ম দিচ্ছেন রূপকথার, গাম্বিয়াকে নিয়ে পাচ্ছেন অভাবনীয় সাফল্য।

    ছয় বছর আগে বাংলাদেশের সেই সময়টা যত দ্রুত সম্ভব ভুলে যেতে চাইবেন সেইন্টফিট। মালদ্বীপের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে ৫-০ গোলের হার, এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইয়ে খর্বশক্তির ভুটানের কাছে বিধ্বস্ত। ভুটানের কাছে সেই ভরাডুবির পর ১৬ মাস আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে ব্রাত্য হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ। সেইন্টফিটকে সরে যেতে হয়েছিল সেই ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে।

    সেই অধ্যায়ের পর দুজনের পথ দুদিকে গেছে বেঁকে। বাংলাদেশও ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সেইন্টফিট খুঁজে নিয়েছেন নতুন ঠিকানা। বাংলাদেশের পর ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো আর মাল্টা ঘুরে থিতু হয়েছেন গাম্বিয়াতে। আর পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট এই দেশটিই তার কোচিং ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ বিন্দু। 

    চলতি আফ্রিকান নেশন্স কাপের মূল পর্বে প্রথমবারের মতো খেলতে গিয়েই বাজিমাৎ করেছে গাম্বিয়া। ইতোমধ্যে নিশ্চিত করেছে কোয়ার্টার ফাইনালে নিজেদের জায়গা। অথচ এর আগে কখনো নেশন্স কাপের বাছাইপর্বই পেরোতে পারেনি দলটি। 

    কোচ হিসেবে যা করেছেন, খেলোয়াড় হিসেবে তার কাছাকাছি অর্জনও নেই সেইন্টফিটের। যৌবনে ফুটবল খেলেছেন। হাঁটুর লিগামেন্ট ছয়বার ছেঁড়ার পর আর ফুটবল খেলার সাহস পাননি। তাই কোচিং শুরু করেন ২৪ বছর বয়সে। ট্যাকটিকসে তার হাতেখড়ি জন্মভূমি বেলজিয়ামের নিচের সারির এক ক্লাবে। পরে কোচিংয়েই সঁপে দিয়েছেন মনপ্রাণ।

    টমের বয়স এখন ৪৮। জীবনের অর্ধেকই তার কেটে গেছে এদেশ থেকে ওদেশ ঘুরে। আফ্রিকায় দুই বছর কাটিয়েছেন তো, ইউরোপের কোনো এক ক্লাবে চলে গেছেন পরের বছর। যদিও ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়টা কেটেছে আফ্রিকা মহাদেশেই। গাম্বিয়া, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, টোগোসহ মোট সাতটি আফ্রিকান দেশ খেলেছে তার অধীনে। তার আফ্রিকান মিশন শুরু নামিবিয়ার হয়ে। ২০০৯ সালে তাদের হয়ে ড্র করেছিলেন আফ্রিকান পরাশক্তি দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে, দেশটিকে তাদের ফিফা ইতিহাসে সর্বোচ্চ র‍্যাংকিংয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও টিকতে পারেননি সেখানে বেশিদিন। ভবঘুরে জীবনই ছিল তার নিয়তি। 

    সেই ভবঘুরে জীবন আপাতত স্থির হয়েছে আটলান্টিক সমুদ্রসীমার পাশে গড়ে ওঠা ছোট্ট দেশ গাম্বিয়াতে। ২০১৮ সালে দেশটির দায়িত্ব নেন। তখন পর্যন্ত আফকনের মূলপর্বে খেলা তো দুরাশা; পাঁচ বছরেও বাছাইপর্বের কোনো ম্যাচই জিতেনি দেশটি। তার আগে শেষ জয়টি এসেছিল ২০১৩ সালে। এমন এক দলের হয়ে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখাও ছিল খানিকটা পাগলামি।

    পাগলামির মাত্রাটা কতখানি, সেটা স্পষ্ট হয় গাম্বিয়া দলের প্রতি তার নিবেদনের গল্প শুনলে। প্রথমেই গাম্বিয়ার দ্বৈত নাগরিকত্বের ফুটবলারদের খুঁজে বের করেছেন । রাজি করিয়েছেন দেশের হয়ে খেলতে। দলের ফুটবলারদের যাবতীয় খরচাও বহন করেছেন নিজের গাঁটের পয়সা দিয়েই। 

    নিবেদনের গল্পটা শুনুন টমের মুখে, ‘কোনো আশাই ছিল না সত্যি বলতে। ফিফা র‍্যাংকিংয়ের  ১৭২ নম্বর দলকে যদি আফকনের স্বপ্ন দেখান, মানুষ তো আপনাকে পাগল বলবেই। ইউরোপজুড়ে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি, নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে। আমাদের ফেডারেশনের অনেক সীমাবদ্ধতা। সেটা মেনে নিয়েই আমি এগিয়েছি। আমার সামনে কেবল দুটো রাস্তা খোলা ছিল। হয় ঘরে বসে থাকা, নইলে নিজের তাগিদেই কিছু করা। পয়সার নেশা আমার কোনোকালেই ছিল না।’

    অমন পাগলাটে আর নিবেদিতপ্রাণ কোচ পেয়ে গাম্বিয়াও বদলে যেতে শুরু করে। ২০১৮ সালে তার অধীনে প্রথম ম্যাচটাই এর প্রমাণ। রিয়াদ মাহরেজের মতো তারকার দল আলজেরিয়ার বিপক্ষে ১-১ সমতায় থেকে ম্যাচ শেষ করে টমের গাম্বিয়া। সেদিন জনতার ঢল নেমেছিল গাম্বিয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্স স্টেডিয়ামে। 

    সেই ফুল হাউজ শো’র কথা মনে করে এখনো স্মৃতিকাতর হন টম, ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স স্টেডিয়ামের দর্শক ধারণক্ষমতা ২৫,০০০। কিন্তু সেদিন খেলা দেখতে এসেছিল ৪৫,০০০ দর্শক। ফ্লাডলাইটের মাথায়, স্কোরবোর্ডের ওপর; কোথায় ছিল না তারা! দর্শকদের চাপে দেড় ঘন্টা দেরিতে শুরু হওয়া সেই ম্যাচে রিয়াদ মাহরেজদের ১-১ গোলে আটকে রেখেছিলাম।’


    টমের জীবন কেটে গেছে নানান দেশ ঘুরে। গাম্বিয়ার ফুটবলাররাও খানিকটা তেমনই। কেউ মায়ের সূত্রে গাম্বিয়ান তো কেউ আবার পৈতৃক সূত্রে। কারো কারো জন্মভূমি গাম্বিয়া হলেও বসতি ইউরোপে।  

    উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ইবু তোরের কথা। ইংল্যান্ড জন্ম, খেলেছেন এভারটনের হয়ে। পৈতৃকসূত্রে পাওয়া নাগরিকত্ব কাজে লাগিয়ে খেলেছেন গাম্বিয়ার হয়ে। দলটির রাইটব্যাক সাইদি ইয়াংকোর গল্পটাও এমনই। জন্ম সুইজারল্যান্ডে, খেলছেন গাম্বিয়ার হয়ে। অবশ্য খাঁটি গাম্বিয়ান ফুটবলার যে স্কোয়াডে নেই, ব্যাপারটা তেমনও নয়। মুসা  ব্যারো-অ্যাবলি জ্যালোরা বেড়ে উঠেছেন গাম্বিয়ার আলো-হাওয়া মেখেই।

    ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা একেকজনকে নিয়ে গাম্বিয়া দলটা যেন ফুটবলের এক বারোয়ারি মেলা। আর তাদের একসূত্রে গেঁথেছেন টম সেইন্টফিট। দ্বারে দ্বারে ঘুরে সবাইকে একাট্টা করেছেন একই তাবুর নিচে। দলটাও গড়ে উঠেছে তার নিপুণ হাতের ছোঁয়ায়। মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে; সর্বত্রই কিছু নিয়ম বেধে দিয়েছেন ফুটবলারদের। গুরুর আদেশও শিষ্যরা মেনে চলছেন। এর ফলাফলটা তো সবাই দেখতেই পাচ্ছেন আফকনের খেলায়।

    দলটার শুধু কোচই নন, অভিভাবকও বটে। এই তো দিন দুয়েক আগেই প্রেস কনফারেন্সে এক হাত নিয়েছেন আফকন আয়োজকদের। করোনা মহামারীর এই সময়েও এক কক্ষে ছয়জন করে থাকতে হচ্ছে ফুটবলারদের। 

    তবে মাঠের পারফর্ম্যান্সে তার প্রভাব পড়েনি। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে মুসার একমাত্র গোলে গিনিকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে গাম্বিয়া। মালির সাথে ড্র করলেও, প্রবল প্রতাপে উড়িয়ে দিয়েছে সাবেক আফকন চ্যাম্পিয়ন তিউনিসিয়াকে। সামনে তাদের প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ক্যামেরুন। 

    গিনির সাথে যেভাবে খেলেছে তার শিষ্যরা, সেই সাহসিকতা আর পারফর্ম্যান্স ধরে রাখলে ক্যামেরুনও জোর ঝাঁকুনি খেতে পারে। সেই ঝাঁকুনিতে নতুন একটা অধ্যায়ও যুক্ত হতে পারে আফ্রিকার ফুটবল ইতিহাসে। ফলাফল পক্ষে গেলে মুসা ব্যারো আর তাদের কোচের নাম গাম্বিয়ানরা যে সোনার হরফে বাঁধিয়ে রাখতে চাইবেন, সেটা বলাই যায়। যদিও এখন পর্যন্ত সবই সম্ভাবনা।

    আফকনে এখন পর্যন্ত অপরাজিত গাম্বিয়া। প্রথমবার খেলতে এসে টানা চার ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড এতদিন ছিল মাদাগাস্কারের দখলে। সেখানে ভাগ বসিয়েছে টম সেইন্টফিট আর তার শিষ্যরা। এই রেকর্ড তারা  ধরে রাখতে চাইবেন, সেটা বলে না দিলেও হচ্ছে। 

    আপাতত আফকনে চোখ থাকলেও, টম সেইন্টফিটের নজর আরো ওপরে। গাম্বিয়াকে নিয়ে বিশ্বকাপে যেতে চান তিনি। স্বপ্ন দেখতে তো বাধা নেই। স্বপ্নটা আকাশছোঁয়া হলেও বাস্তবতা মাথায় আছে তার, ‘আমার লক্ষ্য বিশ্বকাপে যাওয়া। বাস্তববাদী বলেই আমি জানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স কিংবা আর্জেন্টিনার মতো দলে কোচিং করতে পারব না।’

    দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো সেই মানুষটা কোথাও গিয়ে দুই বছরের বেশি থাকেননি, থাকতে পারেননি। হয়তো বনিবনা হয়নি সংশ্লিষ্ট  ক্লাব বা ফেডারেশনের সাথে, নয়তো মাঠের ফুটবল তার হয়ে কথা বলেনি। 

    তবুও ফুটবলকে ভালোবেসে টিকেট কেটে চড়ে বসেছেন পরবর্তী ফ্লাইটটায়। নতুন গন্তব্যে পৌছেছেন, গুছিয়ে উঠতে চেয়েছেন। কখনো কখনো পারলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারেননি। 

    আফ্রিকান সাফারিতে হয়তো নতুন কোনো দেশ হবে তার ঠিকানা। কে জানে, সেখানে গিয়ে হয়তো নতুন কোনো রূপকথার জন্ম দেবেন এই বেলজিয়ান জিপসি।