• আফ্রিকান নেশন্স কাপ
  • " />

     

    মানেদের শাপমোচন ও যেভাবে কান্নায় শেষ হলো সালাহর আফকন

    মানেদের শাপমোচন ও যেভাবে কান্নায় শেষ হলো সালাহর আফকন    

     

    সেনেগাল ০(৪)-(২)০ মিশর


    দিনের শুরুতে এফএ কাপের ম্যাচটি জিতে ইয়ুর্গেন ক্লপ ও তার শিষ্যরা অপেক্ষা করছিলেন আরেকটি ম্যাচের জন্য। কয়েক শত মাইল দূরে দলের দুই প্রাণভোমরা যে নামবে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে। ক্যামেরুনের পল বিয়া স্টেডিয়ামে আফ্রিকান ফুটবলের শীর্ষ দুই তারকা, মোহামেদ সালাহ ও সাদিও মানে অ্যানফিল্ডের বন্ধুত্বটা কিছু সময়ের জন্য হয়তো ভুলে যেতেই চাইছিলেন।

    ফাইনালে পরিষ্কার ফেভারিট ছিল সেনেগালই। গত আসরেও ফাইনাল খেলা অলিও সিসের দল তারকায় পূর্ণ। এডওয়ার্ড মেন্ডি, কালিদু কুলিবালি ও মানেদের স্কোয়াড তর্কসাপেক্ষে মহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী দল। সেনেগালের একাদশের প্রায় সব খেলোয়াড়ই এসেছে ইউরোপের সম্ভ্রান্ত সব ক্লাব থেকে।সে

    নেগালকে বলা হয় তেরেঙ্গার সিংহ। ফাইনালটা তারা সিংহের মতোই শুরু করে। প্রথম মিনিট থেকেই চালাতে শুরু করে আক্রমণ। যার ফলে ম্যাচের তৃতীয় মিনিটেই এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় তারা। লেফট উইং থেকে ক্ষিপ্র গতিতে মিশরের বক্সে ঢুকে পড়ে ফুলব্যাক সালিও সিস। অগত্যা তার উপর স্লাইড ট্যাকেল করে বসেন মিশরের সেন্টারব্যাক মোহামেদ আবদেলমোনেম। ভুল টাইমিংয়ের সেই ট্যাকেলের জন্য পেনাল্টি পায় সেনেগাল। পেনাল্টি নেওয়ার জন্য তৈরি হন মানে।

    রেফারি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপর সালাহকে দেখা যায় গোলকিপার মোহামেদ আবুগাবালের কাছে চলে যেতে। লিভারপুল সতীর্থের পেনাল্টি কোনদিকে যেতে পারে, তা নিয়েই হয়তো পরামর্শ দিচ্ছিলেন। নাটকীয়ভাবে তাদের সেই শলাপরামর্শে ব্যাঘাত ঘটান স্বয়ং মানে। আবুগাবালকে হাতের ইশারায় গোলের ডানপাশটা দেখিয়ে দেন।

    তবে মানের পেনাল্টি শট ডানদিকে যায় না৷ যায় গোলের বাম দিকটায়। আর সেদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষিপ্রগতির শটটি ফিরিয়ে দেন পেনাল্টি ফেরানোকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলা আবুগাবাল।

    সপ্তম মিনিটে এই সুযোগ হাতছাড়া করে মোটেও হতাশ হয়ে যায়নি সেনেগাল। তারা অব্যাহত রাখে তাদের আক্রমণাত্মক ফুটবল। দুই উইং দিয়ে ঘন ঘন বল ঢুকাতে শুরু করে মিশরের বক্সে।

    ম্যাচের ১৮ ও ২৩ মিনিটে রাইট উইং থেকে দুটি নিখুঁত ক্রস করেন ইসমাইলা সার। দুটি বলেই পা ছোঁয়াতে ব্যর্থ হন বক্সে থাকা মানে।

    প্রথমার্ধে সেনেগালের হাতে ম্যাচের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকলেও মিশর যে একেবারেই কোনো সুযোগ তৈরি করেনি, তা না। ম্যাচের ২৮তম ও ৪৩তম মিনিটে দুইবার নিজের পায়ের জাদু দেখিয়েছেন সালাহ। মাঠের ডানপাশ থেকে ড্রিবল করে, বেশ কয়েকজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে শট করেন এই লিভারপুল তারকা। তবে দুবারই তার শট ফিরিয়ে দেন চেলসি কিপার মেন্ডি।

    দ্বিতীয়ার্ধেও শুরু থেকেই আক্রমণ শুরু করে সেনেগাল। কিন্তু গোলের দেখা পায় না। দলের দ্বিতীয় কিপার হিসেবে টুর্নামেন্ট শুরু করা আবুগাবাল এদিনও অক্ষত রাখেন তার গোললাইন।

    আন্ডারডগ হিসেবে টুর্নামেন্ট শুরু করা মিশরে সালাহ ব্যতীত কোনো তারকা না থাকলেও তারা এই টুর্নামেন্টে দেখিয়েছে বড় দলগুলোকে কীভাবে হারাতে হয়। আইভরি কোস্ট, মরক্কো, ক্যামেরুন; টুর্নামেন্টের হেভিওয়েট সব দলকে হারিয়ে ফাইনালে এসেছে তারা। প্রত্যেকটি ম্যাচই জিতেছে অতিরিক্ত সময়ে।

    তাই সেনেগাল ভালো খেললেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে হতে শুরু করে মিশরের পরিকল্পনা মতোই যেন এগুচ্ছে এই ম্যাচ। আসলেই তাই। টুর্নামেন্টের নকআউটের প্রতিটি ম্যাচেই ব্যাকফুটে খেলেছে মিশর। কোনোভাবে প্রাথমিক ৯০ মিনিট পার করে প্রতিপক্ষের ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছে অতিরিক্ত সময়ে। এবং ভালো খেলেও প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে প্রতিপক্ষরা।

    নির্ধারিত সময়ের খেলা যখন শূন্য শূন্যতে শেষ হয়, তখন আরেকটি অনুরূপ স্ক্রিপ্টই হয়তো দেখতে পাচ্ছিল নিরপেক্ষ দর্শকেরা।

    অতিরিক্ত সময়েও প্রাণপণে আক্রমণ করতে শুরু করে সেনেগাল। তবে এসব আক্রমণেও দেয়াল হয়ে দাঁড়ান আবুগাবাল। বিশ্বাস আরও শক্ত হতে শুরু করে, এ যেন গাবালেরই টুর্নামেন্ট।

    অতিরিক্ত সময়েরও শেষ বাঁশি বাজান রেফারি। শুরু হয় টাইব্রেকার।

    সেনেগালের প্রথম দুই শটে জায়গামতো ঝাঁপ দিলেও গোল ঠেকাতে ব্যর্থ হন আবুগাবাল। সতীর্থ আবদুলমোনেমের শট বারে লেগে ফিরে এলে সেনেগালের পরবর্তী কিকটি অবশ্য ঠিকই ফেরান তিনি। টানা দুই মিসের পর মিশরের বদলি খেলোয়াড় মারওয়ান হামদি গোল করলে সমতায় আসে টাইব্রেকার।

    উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, তখন মিশরের চতুর্থ কিক নিতে আসেন মোহামেদ লাশিম। তার দুর্বল শট ঠেকিয়ে দেন মেন্ডি। জাতীয় দলের হয়ে প্রথম শিরোপা জেতার স্বপ্নে বিভোর সালাহর চোখে নেমে আসে অন্ধকার। তিনি পেনাল্টির সুযোগ পাওয়ার আগেই যে ভেঙে যাচ্ছে সে স্বপ্ন।

    ম্যাচের শুরুতেও পেনাল্টি মিস করা এবং পরে দুটি সহজ সুযোগ মিস করা মানে আসেন সেনেগালের সর্বশেষ পেনাল্টিটি নিতে। পুরো জাতির কাছে ইতোমধ্যে নিজেকে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা মানে আর এবার জাতিকে হতাশ করেননি। তার বুলেটগতির পেনাল্টি জাল স্পর্শ করে। সূর্যসন্তান মানের পা থেকেই প্রথম মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জেতে তেরেঙ্গার সিংহরা।

    মানের মতো শাপমোচন হয় ম্যানেজার সিসেরও। ২০০২ সালে দলের প্রথম আফকন ফাইনালে যে তার পেনাল্টি মিসের জন্যই হেরেছিল সেনেগাল।

    ২০১৭ সালের পর আবার আফকনের ফাইনাল হারা সালাহর চোখের কান্না হয়তো হৃদয় ভেঙেছে কোটি ফুটবল ভক্তের। জাতীয় দলের শিরোপা জেতার অপেক্ষা আরও দীর্ঘ হলো এই কিংবদন্তির। অনেকটা যেন লিওনেল মেসির মতোই। তবে গতবছর মেসিও জিতেছেন সেই বহু আরাধ্য শিরোপা (২০২১ কোপা আমেরিকা)। ফুটবল ঈশ্বর হয়তো একইভাবে সালাহর উপরও সদয় হবেন একদিন।