• অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ ২০২২
  • " />

     

    কোভিড-সংকট, ম্যাচ স্বল্পতা কাটিয়ে যেভাবে 'ছোট কোহলিদের' বিশ্বজয়

    কোভিড-সংকট, ম্যাচ স্বল্পতা কাটিয়ে যেভাবে 'ছোট কোহলিদের' বিশ্বজয়    

    শেখ রশিদের হাতে ট্রফিটা, ধুল হাত বাড়িয়ে তার কাছে নিতে চাইছেন, রশিদ ছাড়ছেন না, ধুলও হাল ছাড়ছেন না। বিশ্বকাপ ট্রফি জিতেছে ভারত। উনিশ না পেরুনো ছেলেরা সেই ট্রফি নিয়ে মেতে উঠেছেন খেলায়। যার কাছেই ট্রফি যাচ্ছে, সে আর হাত বদল করতে চায় না। সতীর্থদের ট্রফি দিয়ে একপাশে আড়াল হয়ে যাওয়ায় আপাতত মন নেই ধুলেরও। ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক যেন নিজের কাছেই রেখে দিতে চান স্বপ্নের ওই ট্রফিটা। বাস্তবে দেখা দেওয়া যে ট্রফিটাই এতদিন তাদের স্বপ্নের ছিল। ধুলের সে স্বপ্নের পথে এক দুঃস্বপ্নও উঁকি দিয়েছিল বলেই হয়তো তার ‘ব্যাখা করতে পারার মতো নয়’ ধরনের আনন্দের মাত্রাটা, বেড়ে গিয়েছিলো আরও। 

    ফাইনালে যে একাদশ নিয়ে নেমেছিল ভারত, সেই একাদশ দিয়েই শুরু করেছিল বিশ্বকাপ যাত্রা। তার মানে সেটিকেই ভারতের সেরা একাদশ বলা যেতে পারে। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই একাদশ নিয়ে নেমে ৪৫ রানে জিতেছিল ভারত। অধিনায়ক ইয়াস ধুল ৮২ রানে রান আউট হলে শতক তার হয় না। ভিকি অস্টওয়ালের ৫ উইকেটে ভারত ১৮৭ রানে দক্ষিণ আফ্রিকাকে অলআউট করার আগে ২৩২ রানের পুঁজি পাওয়াতে আছে শেখ রশিদেরও ৩১ রান। 

    ভারতের দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। নিয়মিত কোভিড টেস্ট ভারত ক্যাম্পে নিয়ে এলো দুঃসংবাদ। ছয়জন ক্রিকেটারের ফল এলো কোভিড পজেটিভ। তাদের মধ্যে দুজন, অধিনায়ক ইয়াস ধুল ও সহ অধিনায়ক শেখ রশিদ। সেই সেরা একাদশ নিয়ে নামা তো দূরের কথা, ভারতের অবস্থা এখন এগারোজন হলেই হয় এমন। সতেরোজনের স্কোয়াডে ছয়জন আইসোলেশনে। ভালো খবর, অন্তত এগারোজন তো আছেন। প্রতিপক্ষ আয়ারল্যান্ড বলে ভারতের তবু কোন সমস্যাই হলো না। জিতে গেলো ১৭৪ রানের বিশাল ব্যবধানে। 

    পরের ম্যাচেও একই হাল। পজেটিভ থেকে নেগেটিভ হলেন মাত্র একজনই। হাতে থাকা বারোজনের মধ্যেই এগারোজন বেছে নিয়ে ভারত নামলো খেলতে। যদিও উগান্ডাকে হেসে খেলে উড়িয়েই দিলো তারা। আংক্রিশ রাঘুবংশির ১৪৪ ও রাজ বাওয়ার ১৬২ রানের ইনিংসে ৪০৫ রানের সংগ্রহে ফিল্ডিং করতে নেমে ৭৯ রানে উগান্ডাকে অলআউট করে ভারত জিতেছিল ৩২৬ রানে! সেসব অধিনায়ক ধুল দেখছিলেন চার দেয়ালে বন্দী হয়ে। তখন তার দিন কেটেছে হয়তো দিন গুণে গুণে। কিন্ত সেই গণনারও শেষ কোথায় সেটিও তো ছিল অজানা! 

    অবশেষে কোভিড মুক্ত হলো ভারত, কোয়ার্টার ফাইনালের আগেই। বাংলাদেশের বিপক্ষে রশিদ ফিরে ২৬ রান করলেন। আর বাংলাদেশের দেওয়া ১১২ রানের লক্ষ্য পেরিয়ে ভারত যখন মাঠ ছাড়ছে, একপাশে তখন ২০ রানে অপরাজিত ধুল। সেমিফাইনালে সেই দুজনের কাঁধেই পড়লো এক গুরুদায়িত্বের ভার। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে দুজন যখন সঙ্গ বাঁধলেন, ভারতের নেই ৩৭ রানেই দুই উইকেট। সেখান থেকে তারা ভারতকে নিয়ে গেলেন ২৪১ রানে। ১৩তম ওভারে শুরু হওয়া ২০৪ রানের সেই জুটি ৪৬তম ওভারে গিয়ে ভাঙ্গে ধুলকে আউট হতে হলে। 

    রশিদের স্ট্রেইট ড্রাইভ অজি পেসার নিসবেটের হাতে লেগে স্টাম্প ভেঙ্গে দেয় যখন, তখন ধুল ক্রিজ ছেড়ে বাইরে। রান আউট হয়ে ফেরার আগে যদিও ধুল পেয়ে গেছেন তার ‘না পাওয়া’ সেই সেঞ্চুরির দেখা। কিন্ত রশিদের তা আর পাওয়া হয় না, ১১০ রানে ধুল আউট হওয়ার পর সে ওভারেই পয়েন্টে ক্যাচ দিয়ে রশিদ ফিরে যান ৯৪ রানে। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে আপনি যে ‘ম্যাচিউর’ ইনিংসের খোঁজ করেন, তাদের দুজনেরই ইনিংস ছিল সেরকম। শুরুর ধাক্কা সামলে উঠে দ্রুতগতিতে রান তোলার কাজটাও করেছেন তারা দারুণভাবেই। ধুল ও রশিদ বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভবিষ্যতের সুপারস্টার তাদের ভাবা হলে ভুল হবে না। 

    হাসতে থাকুন, ইয়াস ধুল

    সেঞ্চুরি করে ধুল তিনজনের ছোট্ট একটা ক্লাবেও ঢুকে গেছেন, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভারতের অধিনায়কদের মধ্যে সেঞ্চুরি করেছেন যারা। যেখানে আছেন বিরাট কোহলি ও উন্মুক্ত চাঁদ। যে দুজনই আবার বিশ্বকাপটাও জিতেছিলেন, ২০০৮ সালে কোহলির পর ২০১২ সালেই চাঁদ। ধুলও তা জেতার লক্ষ্যে অ্যান্টিগায় নেমেছিলেন, ভারতের মতো প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডও অপরাজিত থেকেই ফাইনালে নেমেছিল। কিন্ত শুরুটা হলো ইংল্যান্ডের বিভীষিকাময়। টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বাজে শুরুটা তাদের দেখতে হলো ফাইনালে এসেই। এর আগে ৫ ম্যাচে একশের বেশি স্ট্রাইক রেটে ২০৩ রান করা ওপেনার বেথেল ফিরে গেলেন ২ রানেই। রাবি কুমারের সে ওভারেই ফিরে যান ২৯২ রান করে টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ইংল্যান্ড কাপ্তান টম প্রেস্টও। যে বলে আউট হয়েছিলেন, সে বলের আগেই ধারাভাষ্যে রোহান গাভাস্কার বলছিলেন, টুর্নামেন্টে একটিও শূন্যের দেখা পায়নি ইংল্যান্ড। বলতে না বলতেই প্রেস্টের সৌজন্যে তা হয়েই গেলো।

    একে একে ৬১ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে ইংল্যান্ড। সেই ইংল্যান্ডকে এরপর ১৮৪ তে নিয়ে থামেন জেমস রু। বাঁহাতি এ ব্যাটসম্যানের আদর্শ বেন স্টোকস, জার্সির পেছনের নাম্বারটাও তাই ‘৫৫’। খেলেছেনও ‘স্টোকসীয়’ এক ইনিংস। চতুর্থ ওভারে ১৮/২ স্কোরে নেমে ৯৫ রানে আউট হয়েছেন ৪৪তম ওভারে গিয়ে। ধারাভাষ্যকাররা ম্যাচের আগে অ্যান্টিগার সে পিচকে বলছিলেন ব্যাটিং স্বর্গ, সেখানে বিপদের মহাসাগরে পড়া ইংল্যান্ড অন্তত লড়ে যাওয়ার মতো এক স্কোর পেয়েছিল রু এর সুবাদে। 

    যা ডিফেন্ড করতে নেমে আংক্রিশকে শূন্য রানেই ফিরিয়ে দিয়ে ইংল্যান্ড জয়েরই বীজ বুনে ফেলেছিল। আরেক ওপেনার হারনুরকে ৪৯ রানে ফিরিয়ে দেওয়ার পর তৈরি হলো সেই জুটি। রশিদ ফিফটি ছুঁয়েই আউট হয়ে গেলেন, ১৭ রানে ধুলও তার পথ অনুসরণ করলেন কিছুক্ষণ পরেই। ৯৭ রানে চার উইকেটের মধ্যে রশিদ-ধুল জুটিকে ফিরিয়ে দিয়ে ইংল্যান্ড ফিরে এসেছিল ম্যাচে। ৩১ রানে পাঁচ উইকেট নিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ড গড়ার পর ৩৫ রান করলেন রাজ বাওয়া। প্রেস্ট-রেহানের স্পিন ম্যাচে ইংল্যান্ডের ক্ষীণ সম্ভাবনা বাঁচিয়ে রাখলেও নিশান্ত সিন্ধুর ব্যাট ভারতকে চাপে পড়তে দেয়নি কখনোই। শেষ তিন ওভারে ভারতের প্রয়োজন ছিল ১৪ রান, প্রথম বলে চার মেরে সিন্ধু ফিফটি ছুঁয়ে ফেলার পর ব্যাক টু ব্যাক ছয়ে ধীনেশ বানা বিশ্বকাপ নিজেদের করে নেন।

    করোনার প্রকোপে এমনিতেই অনূর্ধ্ব-১৯ দলেরা খুব বেশি খেলার সুযোগ পায়নি। তার উপর ভারতকে ধাক্কা দিয়েছিল ধুল-রশিদের কোভিড পজেটিভ হওয়া। উনিশ বছরের তরুণদের মুখোমুখি হতে হয়েছে কঠিন এক সময়েরই। সেই সময় পেরিয়ে এখন ভারতের স্বপ্নের সময় বাঁচার পালা! বিশ্বকাপ জেতার পর আংক্রিশ যেমন বলছিলেন, ‘জীবনে এরকম অনূভুতি হয়নি কখনো'! সদা হাস্যোজ্জ্বল ধুল জানিয়েছিলেন, তাদের উদযাপনের শুরু আইসক্রিম দিয়ে। যে স্বপ্নের লক্ষ্যে কত ত্যাগ, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ডায়েটের বেড়াজালে প্রিয় ‘আইসক্রিম’ না খেতে পাওয়া ধুলদের ঘরে ঘরে যাবে আইসক্রিম!

    ক্রিকেট শুরুর সময় থেকেই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের যে লক্ষ্য থাকে, সেটি পূরণের পর উপভোগের সময়ই তো এখন ধুলদের! তবে সামনের দিন সম্পর্কেও নিশ্চয়ই জানা আছে ধুলের। লক্ষ্যের শেষ যে এই বিশ্বকাপেই শেষ নয়। ধুলের মতো অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে আরও যে দুই ভারতীয় অধিনায়ক সেঞ্চুরি করেছেন, তাদের একজন বিরাট কোহলি, আর আরেকজন উন্মুক্ত চাঁদ, অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের পর যাদের গতিপথ হয়ে গিয়েছে সম্পুর্ণ বিপরীত। সম্ভাবনায় ভাবা ধুল, রশিদ, কিংবা রাজ বাওয়াদের উপরই আসলে তাই নির্ভর করছে তাদের পরবর্তী জীবনের গতিপথ।