গ্রুপ 'ডি' প্রিভিউ: 'ডার্ক হর্স' ডেনমার্ক, ফ্রেঞ্চদের শিরোপা রক্ষায় চিন্তা 'অপয়া' ইতিহাস
বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের এবারও নজর থাকবে সোনায় মোড়ানো বিশ্বকাপে। সেই লক্ষ্যে এবার তাদের গ্রুপে মুখোমুখি হতে হবে টুর্নামেন্টের অন্যতম নজরকাড়া দল ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া ও তিউনিসিয়ার। এক নজরে এই গ্রুপটার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আসা যাক।
অস্ট্রেলিয়া
২০০৬ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব পার করে রাউন্ড অফ সিক্সটিনে ইতালিয়ানদের শিরদাঁড়ায় কাপন ধরিয়ে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। টট্টির শেষ মুহূর্তের পেনাল্টিতে সেবার স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার পর অস্ট্রেলিয়া অবশ্য বিশ্বকাপে কোনোবারই নিজেদের মেলে ধরতে পারেনি তারা। তবে সেই চিত্র পালটে দেবার জন্য বিশ্বকাপের টিকেট কাটতে অস্ট্রেলিয়াকে পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর, বিশাল এক পথ। বাছাইপর্ব ম্যারাথন পাড়ি দেওয়ার পর হাঁসফাঁস করতে থাকা অস্ট্রেলিয়া কাতারের টিকেট পেয়েছে প্লেঅফে পেরুর বিপক্ষে জয় দিয়ে। কণ্টকাকীর্ণ সেই পথ পাড়ি দিয়ে অজিরা গতবারের মত এবারও গ্রুপে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছে ফ্রান্স ও ডেনমার্ককে, সেই সাথে এবার তাদের গ্রুপে আছে তিউনিসিয়া। আর স্বপ্ন বুনার মূল কারিগর হিসেবে দলের কোচ হিসেবে এবার আছেন তাদের কিংবদন্তী গ্রাহাম আর্নল্ড। বিশ্বকাপের জন্য সঠিক কম্বিনেশনের খোঁজে আর্নল্ড বাজিয়ে দেখেছেন ৪৮ জনকে। বিশ্বকাপের জন্য কাতারের প্লেনে চড়া অস্ট্রেলিয়ানরা যে বহু বছর ধরে একসাথে খেলছেন সেটা বলার তাই খুব একটা সুযোগ নেই। তবে বিশ্বমঞ্চে আলো ছড়ানোর মত বেশ কিছু খেলোয়াড় আছেন সেই দলে।
শক্তি
বড় তারকার অভাব পুষিয়ে দিতেই আর্নল্ড দলের মাঝে বপন করেছেন সাম্যের বীজ। সেই সাথে অস্ট্রেলিয়া দলে রয়েছে অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের দারুণ মিশেল। দলে অ্যারন মুই, ম্যাট রায়ানদের মত সাবেক প্রিমিয়ার লিগ মাতানো খেলোয়াড়দের সাথে রয়েছেন মার্টিন বয়েলের মত অভিজ্ঞ। সেই সাথে উথতি তারকা আয়ার মাবিল, এইডিন রুস্টিচরাও দলকে দিয়েছেন ভিন্ন মাত্রা। অস্ট্রেলিয়ার মিডফিল্ড বরাবরের মত পরিকল্পনামাফিক খেলার সামর্থ্য রাখে, সেই সাথে রক্ষণভাগটাও শারীরিকভাবে সফল ও বাতাসে দক্ষ। অস্ট্রেলিয়া তাই বিশ্বকাপেও এই দুই বিভাগে নিজেদের শক্তি কাজে লাগিয়েই পরিকল্পনা সাজাবে।
দুর্বলতা
সকারুসদের স্কোয়াডে সেই অর্থে নেই কোনও দক্ষ গোলদাতা। ডি-বক্সে গোল ক্ষুধা দেখানোর মত ধূর্ত, ক্ষিপ্র ফরওয়ার্ড রয়েছেন; মাবিলদের মত গতির ঝড় তোলার সক্ষমতা রয়েছে অজিদের। তবে সেই অর্থে ‘ক্লিনিকাল ফিনিশার’ নেই দলে। কঠিন এক গ্রুপে সকারুসদের জন্য সেটাই যোগাতে পারে আর্নল্ডের চিন্তার খোরাক।
ডেনমার্ক
গত ইউরোর সেমি-ফাইনালিস্ট ডেনমার্ককে এবার অনেকেই দেখছেন টুর্নামেন্টের ‘ডার্ক হর্স’ হিসেবে। ভারসাম্যপূর্ণ এক স্কোয়াড নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই দুর্দান্ত খেলে আসা ডেনমার্ক এবার সামর্থ্য রাখে নিজেদের দিনে যেকোনো বড় দলকেই কাবু করার। শুধু গত ইউরো নয়, এবারের বাছাইপর্বও দাপটের সাথেই পার করেছে ড্যানিশরা। সেই সাথে গ্রুপ প্রতিপক্ষ ফ্রান্সকে কয়েক মাস আগেই পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ বিলিয়েছেন ড্যানিশরা। গত বিশ্বকাপে টাইব্রেকারে স্বাগতিক রাশিয়ার বিপক্ষে স্বপ্নভঙ্গের স্মৃতি ভুলে নতুন করে ইতিহাস রচনা করতে মুখিয়ে থাকবেন তারা। গত ইউরোতে ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের জীবনের শঙ্কায় মূর্তিমান যেই আতঙ্ক ড্যানিশদের পেয়ে বসেছিল, সেই শঙ্কাকে শক্তি বানিয়ে তো তারা ছুটে চলেছেন গত কয়েক বছর ধরেই। আর সেই এরিকসেনও যে ভস্ম থেকে জেগে উঠেছেন ফিনিক্স পাখির মতই। সেই শক্তিকে পুঁজি করে এবারের বিশ্বকাপে ডেনমার্ক তাক লাগিয়ে দিলেও অবাক হওয়ার খুব একটা অবকাশ নেই।
শক্তি
বাছাইপর্বে ২৭ গোল দিয়েছেন এরিকসেনরা, তবে স্মাইকেলের নেতৃত্বে এই দল এবার গড়েছে অনন্য এক কীর্তি - বাছাইপর্বে স্মাইকেলের গোলবারে ঢোকেনি একটি গোলও! দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ফুলহামের ইওয়াকিম অ্যান্ডারসনের সাথে গত ইউরোতে আলো ছড়ান সিমোন কিয়েরের সমন্বয়ে গড়া রক্ষণভাগ সম্ভবত আসরের সবচেয়ে শক্তিশালী রক্ষণভাগের একটি। ইয়ানিক ভেস্টেগার্ডের মত ডিফেন্ডার, বা পিয়েরে এমিল হয়বিয়ার মত পাশবিক শক্তি সম্পন্ন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের সাথে দুই প্রান্তে গতির ঝড় তোলার মত রয়েছে উইংব্যাক বা উইঙ্গার হিসেবে খেকা মিকেল ডামসগার্ড বা ইওয়াকিম মায়েলের মত দারুণ (বাছাইপর্বে ডেনমার্কের সর্বোচ্চ গোলদাতা) খেলোয়াড়। সেই সাথে থমাস ডেলেনি, ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনদের নিয়ে গড়া মিডফিল্ডও সমীহ জাগানিয়া।
দুর্বলতা
ক্যাসপার উইলমান্ডের কপালে ভাঁজ ফেলতে পারে ইয়ুফ্রে পলসন, ক্যাসপার ডলবার্গদের ফর্মহীনতা। ডেনমার্কের মিডফিল্ড বা উইংব্যাকদের গোল বের করার সামর্থ্য হয়ত আছে। তবে বিশ্বকাপের মত বড় মঞ্চে ধারাল স্ট্রাইকারের অভাবটা তাদের ভোগাতে পারে।
ফ্রান্স
বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা এবারও শিরোপার অন্যতম দাবীদার। জিদানের জাদুতে বিশ্বকে মোহাবিষ্ট করে ঘরের মাঠে প্রথম শিরোপা জেতা ফ্রান্স যে ২০ বছর পর রাশিয়াতে দ্বিতীয়বারের মত এই স্বর্গীয় আনন্দে শামিল হতে পেরেছিল, সেই অর্জনের মূল কারিগরদের অনেকেই এবারও রয়েছেন দলে। ২০১৮ সালের এমবাপে ওই অনভিজ্ঞতা নিয়েও যেভাবে বিশ্ব মঞ্চে নিজের নাম ঘোষণা করেছিলেন, পরিণত এমবাপে এবার কী করতে পারেন সেই আতঙ্কে দিন পার করতে হচ্ছে বেশিরভাগ প্রতিপক্ষকেই। সেই সাথে দলে এবার আছেন ব্যালন ডি’অর জয়ী করিম বেনজেমা। ২০০২ বিশ্বকাপের মত বিশ্বজয়ের পরের আসরেই গ্রুপ রাউন্ডে মাথা নিচু করে বিদায় নেওয়ার ফাঁড়া কাটাতে বেনজেমা-এমবাপের এই যোগসাজশ মাঠেও ফ্রান্সকে তুলে ধরতেই হবে। তারকায় ঠাসা এক স্কোয়াড নিয়ে কাতারে পা রাখা ‘লে ব্লুজ’-দের জন্য শিরোপা ছাড়া অন্য কোনও ফলাফল হয়ত ব্যর্থতা হিসেবেই গণ্য হবে এবারও।
শক্তি
বরাবরের মতই ফ্রান্সের শক্তির জায়গা তাদের আক্রমণভাগ। এমবাপে-বেনজেমার চিন্তায় বেশীরভাগ রক্ষণভাগ দিনপাত করলেও আঁতোয়াঁ গ্রিজমানের কথা ভুলে গেলে চলবে না। ২০১৬ ইউরোর সর্বোচ্চ গোলদাতা গত বিশ্বকাপেও ছিলেন যৌথভাবে দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা। বার্সার হয়ে দুঃসহ সময় পার করার পর প্রিয় অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে ফিরে ফর্মে ফেরার ইঙ্গিতটাও দিয়ে রেখেছেন। সেই সাথে বিশ্বকাপের স্বাদ আস্বাদন করা অলিভিয়ের জিরুও মিলানের হয়ে এবার রয়েছেন দারুণ ফর্মে, আর উইংয়ে রয়েছে উসমান ডেম্বেলে, কিংসলে কোমানের মত ক্ষুরধার সব অস্ত্র। ফ্রান্সের আক্রমণভাগ এবারও তাই হয়ত বেশীরভাগ রক্ষণভাগের ঘুম হারাম করেই ছাড়বে।
দুর্বলতা
ফ্রান্সের মূল দুর্বলতা এবার সন্দেহাতীতভাবে তাদের মিডফিল্ড। ইনজুরির কারনে বিশ্বকাপ থেকে পগবা, কান্তেরা ছিটকে পড়ায় এবার দায়িত্ব সামলাতে হবে চুয়ামেনি, কামাভিঙ্গাদের মত অনভিজ্ঞদের। মাদ্রিদের এই জোড়া নিজেদের দিনে দুর্দান্ত খেলোয়াড় হলেও কান্তে, পগবাদের অভিজ্ঞতার অভাবটা তারা বিশ্বকাপের মত আসরে কতটা পুরণ করতে পারবেন সেটাই হবে দেখার মত। সেই সাথে রক্ষণভাগেও ভারানের ফর্ম, কোনাটের লম্বা ইনজুরি থেকে ফেরাটাও হতে পারে শঙ্কার কারণ। সেই সাথে বরাবরের মত অধিক সন্ন্যাসীতে গাঁজন যাতে নষ্ট না হয় সেটার দিকেও নজর রাখতে হবে দিদিয়ের দেশমকে।
তিউনিসিয়া
১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সালে টানা তিন বিশ্বকাপ খেলার পর বিশ্বমঞ্চে ‘কার্থেজ ঈগল’রা ফিরেছিলেন শেষ আসরে। তবে এই চার আসরে তাদের জয়ের খাতায় টিক পড়েছে মোটে একবার। গত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে কাঁপিয়ে দেওয়ার পর অবশ্য শেষ ম্যাচেও ড্র করে নতুন যুগের সম্ভাবনার ছাপ রেখেছিল আফ্রিকার দলটি। প্লে-অফে মালিকে হারিয়ে বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়া তিউনিসিয়ার সাম্প্রতিক ফর্ম অবশ্য খুব একটা আশাজাগানিয়া নয়। এবারের আফকনেই দলটি বিদায় নিয়েছিল শেষ আটের মঞ্চ থেকেই। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের গ্রুপে তিউনিসিয়া এবার তাই হয়ত বাড়ি ফেরার আগে বলার মত কোনও জয় নিয়ে ফিরতে পারলেই নিজেদের সৌভাগ্যবান ভাববে।
শক্তি
তিউনিসিয়ার শক্তি তাদের দলের বোঝাপাড়া। কোচ জালেল খাদরি এই দায়িত্বে নতুন মুখ হলেও খাজরির মত দারুণ কিছু খেলোয়াড় নিয়ে এই দলটা বেশ কিছুদিন ধরেই একসাথে খেলে আসায় পরিকল্পনার প্রয়োগের সক্ষমতা রাখে।
দুর্বলতা
শীর্ষ পর্যায়ে ফুটবল খেলার অভিজ্ঞতা এই দলের তেমন নেই। দলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তরুণ তুর্কি হ্যানিবাল থাকলেও বড় টুর্নামেন্টগুলোর চাপের সম্মুখীন তেমন হওয়া হয়নি। বিশ্বকাপের মত আসরে তাই তিউনিসিয়ার কাছে অনেক প্রশ্ন রাখতে পারে অন্য দলগুলো।
প্রেডিকশন: পরের রাউন্ডে প্রথম ও দ্বিতীয় হিসেবে জায়গা করে নিবে ডেনমার্ক ও ফ্রান্স। যথাক্রমে পরের দুই স্থান দখল করবে অস্ট্রেলিয়া ও তিউনিসিয়া।