• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    প্রিমিয়ার লিগই কি নতুন সুপার লিগ?

    প্রিমিয়ার লিগই কি নতুন সুপার লিগ?    

    সুপার লিগ নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে দুই স্প্যানিশ পরাশক্তি, রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা জোর গলায় এর প্রচারণা চালাচ্ছে। প্রিমিয়ার লিগের দলগুলো অবশ্য এ ব্যাপারে বেশ নীরব। প্রথমবার যখন সুপার লিগ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল, তখন ভক্তদের তোপের মুখে শীর্ষ ছয় ক্লাব প্রতিজ্ঞা করেছিল এরকম বিদ্রোহী লিগে ভবিষ্যতে আর যোগ না দেওয়ার। সেটা একটা কারণ।  

    তবে মূল কারণ অন্য। অর্থ, মেধা ও জনপ্রিয়তায় বাকি সব লিগকে ছাপিয়ে যাওয়া প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো এখন নিজেরাই দাবি করতে পারে, ‘আমরাই সুপার লিগ’। ফুটবল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিকভাবে প্রিমিয়ার লিগের একচ্ছত্র আধিপত্যকে থামাতেই রিয়াল-বার্সা এখন সুপার লিগের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। 

    এই প্রবন্ধে আমরা সুপার লিগ প্রবক্তাদের বর্তমান চিন্তাধারা এবং সুপার লিগ আলোচনায় প্রিমিয়ার লিগের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করব। 

     

    প্রিমিয়ার লিগের ছায়ায় বাকি সব লিগ 

    সর্বশেষ ট্রান্সফার উইন্ডোতে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো মোট খরচ করেছে ৮১৫ মিলিয়ন ডলার, যা ইউরোপের পাঁচ লিগে হওয়া মোট দলবদল খরচের ৭৯ শতাংশ। চলতি মৌসুমে সিরি আর সব ক্লাব মিলিয়ে মোট নেট খরচ (কেনা বিয়োগ বিক্রি) করেছে ৮৫ মিলিয়ন ইউরো, যা বোর্নমাউথের চেয়ে দুই মিলিয়ন বেশি। অথচ বোর্নমাউথ প্রিমিয়ার লিগের দরিদ্রতম দলগুলোর একটি। শুধু এই মৌসুম না, আমরা যদি গত পাঁচ মৌসুমে ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর নেট খরচের হিসাব দেখি- 

     

     

    শীর্ষ ১২ ক্লাবের মধ্যে প্রিমিয়ার লিগের বাইরের ক্লাব আছে মাত্র দুটি। এর মধ্যে জুভেন্টাসের এই তালিকায় আসার যাত্রাটি কিছুটা বিতর্কিত, কেননা মিথ্যে হিসাব দেখানোর জন্য ইতোমধ্যে শাস্তি ভোগ করছে ক্লাবটি। আর বার্সা এসেছে বেশ কিছু অর্থনৈতিক লিভারের সহায়তায়। এরপরও তাদের নেট খরচ ফুলহামের চেয়ে কম, যারা এরমধ্যে দুই মৌসুম খেলেছে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ডিভিশনে।  

     

    এই অর্থনৈতিক অসাম্য যে বাকি ইউরোপকে কোণঠাসা করে দিচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো এত অর্থ পাচ্ছে কোথা থেকে? ফুলহামের মতো ক্লাব কীভাবে রিয়াল, বার্সার চেয়ে বেশি খরচ করছে? 

     

    প্রিমিয়ার ‘মানি’ লিগ 

    গত মাসে লা লিগা সভাপতি হাভিয়ের তেবাস প্রিমিয়ার লিগের বিপক্ষে ‘অর্থনৈতিক ডোপিং’-এর অভিযোগ তুলেছেন। তার দাবি- ম্যান সিটি, নিউক্যাসলের মতো ক্লাবগুলো অস্বাভাবিক পরিমাণে অর্থ ঢালছে দলবদল বাজারে, যা অ্যাথলেটদের পারফরম্যান্স-বর্ধক ডোপের মতোই। প্রিমিয়ার লিগের ডোপিংয়ের জন্য পুরো ইউরোপীয় দলবদল বাজারেই মুদ্রাস্ফীতি নেমে এসেছে বলে দাবি তেবাসের। 

    তেবাসের এই দাবি ঠিক ভুল না। সাম্প্রতিক সময়ে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো সবচেয়ে উচ্চবিত্ত মালিকদের আকর্ষণ করছে। ম্যানচেস্টার সিটি ও নিউক্যাসল ইউনাইটেড, দুই ক্লাবই এখন মধ্যপ্রাচ্যের তেল-ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের অধীনে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডও অচিরেই নাম লিখাতে পারে সেই দলে। চেলসি ও আর্সেনালের মালিকানা মার্কিনীদের হাতে থাকলেও এই দুই ক্লাবও খরচ করছে ফেয়ার প্লের ধার না ধেরেই। কিন্তু দলবদল বাজারে মুদ্রাস্ফীতির দায় শুধু এই দলগুলোকে দিলে চলে না। 

    পিএসজি এক মৌসুমে দলে ভিড়িয়েছিল নেইমার ও কিলিয়ান এমবাপেকে, মোট ৪০০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে। একই মৌসুমে (২০১৭-১৮) বার্সেলোনাও শুধু ফিলিপ কুটিনহো ও উসমান ডেম্বেলের পিছনে খরচ করেছিল ২৫০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি। অনেকের মতে, দলবদল বাজারে মুদ্রাস্ফীতি নামা শুরু হয়েছিল তখনই। আর তেবাসের ডোপিং-তত্ত্বকে আমলে নিলেও ফুলহাম কীভাবে রিয়াল-বার্সার চেয়ে বেশি খরচ করছে, সেই রহস্যের সমাধান হয় না। সেটা বুঝতে হলে আমাদের তাকাতে হবে তাদের আয়ের হিসাবের দিকে।   

     

    আয়ের হিসাব 

    সব ফুটবল ক্লাবই পাঁচটি নির্দিষ্ট উৎস থেকে আয় করে থাকে। সেগুলো হচ্ছে- 

    • ম্যাচের দিনে স্টেডিয়াম থেকে আসা আয় 

    • ব্রডকাস্ট বা টিভি ডিল থেকে আসা আয়

    • কমার্শিয়াল আয়, যা আসে মার্চেন্ডাইজ ও স্পন্সরশিপ থেকে

    • খেলোয়াড় বিক্রি থেকে আয় 

    • বিভিন্ন প্রতিযোগিতা (লিগ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ) থেকে আয় 

    এই পাঁচটি আয়ের উৎসের মধ্যে প্রিমিয়ার লিগ যে জায়গায় সবার চেয়ে এগিয়ে, সেটি হচ্ছে টিভি সত্ত্ব। 

    গত দশকে লা লিগার স্বর্ণযুগ, বা এর আগের দশকে ইতালিয়ান ফুটবলের স্বর্ণযুগ চলাকালেও প্রিমিয়ার লিগের টিভি সত্ত্ব ছিল বাকিদের চেয়ে বেশি মূল্যবান। আর বর্তমানে এই ব্যবধানটা অনেক বেশি বেড়েছে। 

    গত মৌসুমে টিভি সত্ত্ব থেকে প্রিমিয়ার লিগ আয় করেছে ৩.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। লা লিগার আয় এর অর্ধেকের চেয়েও কম, ১.৫ বিলিয়ন ডলার। সিরি আর ১.২৬ বিলিয়ন। 

    টিভি সত্ত্ব থেকে আসা আয় ভাগ করাতেও তফাৎ রয়েছে লিগগুলোর মধ্যে। স্পেনে শীর্ষ তিন দল (রিয়াল, বার্সা, অ্যাটলেটিকো) একাই নিয়ে নেয় মোট আয়ের এক তৃতীয়াংশ। অপরদিকে প্রিমিয়ার লিগে এই অর্থ ভাগ হয় অনেকটা সমাজতান্ত্রিকভাবে। 

    টিভি থেকে আসা আয়ের ৫০ শতাংশ লিগের ২০ ক্লাবের মধ্যে সমানভাবে ভাগ হয়। ম্যাচ সম্প্রচারের জন্য ফ্যাসিলিটি ফি হিসেবে দেওয়া হয় ২৫ শতাংশ। আর বাকি ২৫ শতাংশ ক্লাবগুলোর মাঝে ভাগ হয় মেরিট হিসেবে, মৌসুম শেষে টেবিলে যার যার অবস্থান অনুযায়ী। অর্থাৎ মোট আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ সব ক্লাব পাচ্ছে সমানভাবেই। 

    বর্তমান মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগ টেবিলের সর্বনিম্ন ক্লাব টিভি সত্ত্ব থেকে পাবে ১২০ মিলিয়ন ইউরো। সিরি আর শীর্ষ ক্লাবগুলোও এর ধারেকাছে আয় করবে না। গত মৌসুমে টিভি সত্ত্ব থেকে ইতালিয়ান ক্লাবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় করেছে ইন্টার মিলান, ৮৪ মিলিয়ন ইউরো। জুভেন্টাস ও এসি মিলান আয় করেছে ৭৭ মিলিয়ন করে। 

    তবে লা লিগার শীর্ষ দলগুলোর আয় এমন শোচনীয় না। রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা বিগত মৌসুমে টিভি সত্ত্ব থেকে আয় করেছে ১৬০ মিলিয়ন ইউরো করে, যা প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন ম্যান সিটির (১৭৪) কাছাকাছি। কিন্তু লিগের নিচের ১০ ক্লাব টিভি থেকে পায় ৫৫ মিলিয়ন ইউরোর চেয়েও কম। 

    বিষয়টা সার্বিকভাবে দেখলে, টিভি সত্ত্ব থেকে যেই লিগ বেশি আয় করছে, স্বাভাবিকভাবেই বৈশ্বিকভাবে যেই লিগের খেলা বেশি মানুষ দেখছে। যার মানে সেই লিগের এবং লিগের ক্লাবগুলোর দামী স্পন্সরশিপ চুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাচ্ছে। জার্সি ও অন্যান্য মার্চেন্ডাইস বিক্রিতেও এগিয়ে থাকবে তারাই। এবং সার্বিক আয় ও জনপ্রিয়তা যেহেতু বেশি, প্রতিভাবান খেলোয়াড় ও কোচদের এখানে ভিড় করার সম্ভাবনাও বেশি। 

    এবং হচ্ছেও তাই। লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েও গত মৌসুমে নিউক্যাসলের সঙ্গে বিডিং যুদ্ধে হেরেছে ইন্টার মিলান। তাদের প্রধান সেন্টার-ব্যাক টার্গেট সিভেন বটম্যানকে প্রায় দ্বিগুণ অর্থ দিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে নিউক্যাসল। গত মৌসুমে লা লিগার সবচেয়ে প্রশংসিত ম্যানেজারদের মধ্যে ছিলেন উনাই এমেরি ও জুলেন লোপেতেগি। ভিয়ারিয়ালকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিতে নিয়ে গিয়েছিলেন এমেরি, সেভিয়াকে নিয়ে ‘টপ থ্রি’র ঠিক পিছনে গিয়ে থেমেছিলেন লোপেতেগি। কিন্তু এ মৌসুমে দুই প্রতিভাবান কোচই দায়িত্ব নিয়েছেন প্রিমিয়ার লিগে রেলিগেশন লড়াইয়ে থাকা দুই দলের (অ্যাস্টন ভিলা ও উলভস)। 

    চলতি মৌসুমে দলবদল বাজারে যত তরুণ প্রতিভা ছিল- আর্লিং হালান্ড, ডারউইন নুনেজ, এনজো ফার্ন্দান্দেজ, মিখাইলো মুদ্রিক, জোয়াও ফেলিক্স, কোডি গাকপো- প্রায় সবাই ভিড় করেছেন প্রিমিয়ার লিগে। এই ধারা চলতে থাকলে কয়েক মৌসুমের মধ্যে বাকি সব লিগকে ছাড়িয়ে আরেক উচ্চতায় উঠে যাবে প্রিমিয়ার লিগ। সেই উচ্চতাকে আপনি ‘সুপার লিগ’-ও বলতে পারেন। 

     

    ভবিষ্যৎ কী? 

    প্রিমিয়ার লিগের এই অর্থনৈতিক সক্ষমতা যে ইউরোপের বাকি লিগগুলোকে কোণঠাসা করে দিচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইউরোপীয় ফুটবলের বর্তমান গতিপথ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভীত দুই ক্লাব স্বাভাবিকভাবেই রিয়াল ও বার্সা। এবং সবচেয়ে ভীত লিগ লা লিগা। 

    লা লিগা ও স্পেনের পরাশক্তিদের বর্তমান মানসিকতা নিয়ে স্প্যানিশ ফুটবল বিশারদ গুইলেম বালগ সিবিএসকে বলেন, “প্রিমিয়ার লিগ ক্লাবগুলোর খরচ করা সামর্থ্য নিয়ে আসলে স্পেনের দলগুলো ভীত। তাদের ভয়, এভাবে চলতে থাকলে একসময় সকল ফুটবলীয় প্রতিভা প্রিমিয়ার লিগেই চলে যাবে। এবং এটাকে কীভাবে থামানো যায়, তা নিয়েই এখন বিতর্ক চলছে।

    বিতর্কের এক অংশে রয়েছেন হাভিয়ের তেবাস। তার পরিকল্পনা হচ্ছে- টিভি সত্ত্বের মতো লা লিগার অর্থনৈতিক ডিলগুলো আরও উন্নত করা। এবং প্রিমিয়ার লিগের অর্থনৈতিক ডোপিং থামানো।” 

    এই পরিকল্পনায় সমস্যা হচ্ছে, টিভি সত্ত্ব যতই উন্নত করুক না কেন লা লিগা, তারা প্রিমিয়ার লিগকে ধরতে পারবে না। আর ডোপিং থামাতে ভেঙে যাওয়া ‘ফেয়ার প্লে’ সিস্টেমকে চাঙা করারও কোনো ইচ্ছা কারোর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। বর্তমানে ইউয়েফায় সবচেয়ে ক্ষমতাধর দলগুলোর একটি পিএসজি। ক্লাবটির সভাপতি নাসের আল-খেলাইফি ইউয়েফার কার্যনির্বাহী কমিটির একজন প্রধান চরিত্র, ইউয়েফা ক্লাবগুলোর এসোসিয়েশন ইসিএর (ইউরোপিয়ান ক্লাব এসোসিয়েশন) সভাপতিও তিনি। তাই নতুন ফিনান্সিয়াল ফেয়ার প্লের চিন্তা আপাতত বাদ দিতে পারি আমরা। 

    রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনাও জানে এভাবে হবে না। ‘সেজন্যই বিতর্কের অপর অংশে থাকছে ইউরোপিয়ান সুপার লিগ,’ বলেন বালগ। 

    “সুপার লিগ মাঠে গড়ালে রিয়াল-বার্সার মৌসুমে ৩৪০ মিলিয়ন করে পাওয়ার কথা। তখন হয়তো প্রিমিয়ার লিগের সঙ্গে কিছুটা ভারসাম্য রাখতে পারবে তারা।” 

    রিয়াল, বার্সার উদ্বেগ সত্য হলেও এটাও সত্য প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব ব্যতীত কোনো ইউরোপিয়ান সুপার লিগ মাঠে গড়ানো প্রায় অসম্ভব। এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর সে পথে হাঁটারও কোনো কারণ নেই। কেননা, প্রিমিয়ার লিগই তো সুপার লিগ।