• ক্রিকেট, অন্যান্য
  • " />

     

    খোঁড়া পা নিয়ে যেভাবে গ্যাবার নায়ক শামার জোসেফ

    খোঁড়া পা নিয়ে যেভাবে গ্যাবার নায়ক শামার জোসেফ    

    শামার জোসেফ; ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই অখ্যাত পেসারের নাম দুই সপ্তাহ আগেও সেভাবে কেউ শোনেনি। তবে টেস্ট ক্রিকেটে আসার পর যা যা করলেন, সেটাই যথেষ্ট তার নামটা চারপাশে ছড়িয়ে দিতে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অভিষেক রাঙিয়েছিলেন প্রথম বলেই উইকেট আর ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়ে। আজ গ্যাবাতে চোটাক্রান্ত পায়ের আঙুল নিয়েই বল করেছেন, একাই সাত উইকেট নিয়ে ইতিহাস গড়েছেন। তার বোলিং বীরত্বে দীর্ঘ ২৭ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে রুদ্ধশ্বাস এক টেস্ট জিতল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। 

    গ্যাবায় দিবারাত্রির টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংসে মিচেল স্টার্কের ইয়র্কার গিয়ে সোজা আঘাত করে জোসেফের ডান পায়ে। চোট নিয়ে রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। শংকা জেগেছিল, এই পেসারকে চতুর্থদিন পাবে কিনা ওয়েস্ট ইন্ডিজ। নিজেই বলেছেন, আজ গ্যাবা টেস্টের চতুর্থদিন তার মাঠে নামারই কথা ছিল না। 

    সেসব তুড়িতেই উড়িয়ে দিয়ে মাঠে নেমেছিলেন জোসেফ। উড়িয়েছেন অজিদেরও। দিনের তৃতীয় সেশনের আগেই শুরু হয়েছিল জোসেফের গোলাপি বলের তোপ। 

    একে একে ফিরিয়েছেন ক্যামেরন গ্রিন, ট্রাভিস হেড, মিচেল মার্শ, অ্যালেক্স ক্যারিদের। উইকেট সেট হওয়া স্টার্ক হাত খুলে খেলছিলেন। জোসেফ নেন তার উইকেটও। ডিনার ব্রেকের পর সমীকরণ ছিল সহজ; ম্যাচ জিততে উইন্ডিজের চাই দুই উইকেট, অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ২৯ রান। গ্যাবা টেস্টের উত্তেজনার পারদ তখন তুঙ্গে। নব্য ওপেনার স্টিভেন স্মিথ আলঝারি জোসেফকে স্কুপ শটে ছক্কা মেরে দলকে দুইশো পার করালেন।  

    ছক্কা মারার পরের ওভারেই আবার বোলিংয়ে আসেন টানা স্পেল করে যাওয়া জোসেফ। উইকেটে স্মিথের সাথে তখন ছিলেন জশ হ্যাজলউড; যাকে আড়ালে রেখেই খেলে যাচ্ছিলেন স্মিথ। প্রথম চার বল একা খেলে পঞ্চম বলে হ্যাজলউডকে স্ট্রাইকে পাঠিয়েছিলেন স্মিথ। হয়তো ভেবেছিলেন ওভারের শেষ দুটা বল সামলে নিতে পারবেন তিনি। পারেননি; জোসেফের দারুণ এক লেংথ বল ভেঙে দিল স্টাম্প। ইতিহাস গড়ে বাউন্ডারি লাইনের দিকে ছুটলেন জোসেফ, তার পেছনে বাকি সতীর্থরা। সেখানেই মাতলেন ২৭ বছর পর অজিদের মাটিতে টেস্ট জয়ের উল্লাসে। স্মিথ একাই ছিলেন অপরাজিত, যিনি শামার জোসেফের প্রথম টেস্ট উইকেট। এমন দারুণ বোলিংয়ের পর গ্যাবার দর্শকরা জোসেফকে অভিবাদন জানাতে ভুলেননি। সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে করতালির আওয়াজে তাকে যেন বরণ করে নিলেন সবাই। 

    অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে শেষ যেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট জিতেছিল, তখন শামার জোসেফের জন্মও হয়নি। ১৯৯৭ সালের সেই পার্থ টেস্টে সেঞ্চুরি করা ব্রায়ান লারা আজ ধারাভাষ্যে ছিলেন জয়ের মুহূর্তে। কার্টলি অ্যামব্রোস-কোর্টনি ওয়ালশ-ইয়ান বিশপরা দারুণ বোলিংয়ে সেই টেস্ট জিতিয়েছিলেন। এর দুই বছর পর জন্ম নেয়া জোসেফের আগুনঝরানো বোলিংয়েই ২৭ বছর আর ১৬ ম্যাচে জয়হীন থাকার পর ক্যারিবিয়ানরা হারাল অজিদের তাদের ঘরের মাঠেই। অ্যাডিলেডে প্রথম টেস্টে দশ উইকেটে হেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গ্যাবা টেস্টের এমন অভাবনীয় এক সমাপ্তি হবে, কে ভেবেছিল! 

    প্রথম ইনিংসে ৩১১ তে অলআউট ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কেমার রোচ-আলঝারি জোসেফের দুর্দান্ত বোলিংয়ের পর ২৮৯ রানে ইনিংস ঘোষণা করে অজিরা। জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৯৩ রানে আবার গুটিয়ে গেলে অজিদের লক্ষ্য দাঁড়ায় ২১৬। চতুর্থ ইনিংসে ৬২ রানে দুই উইকেট হারালেও জয়ের পাল্লা তাদেরই ভারী ছিল। 

    তবে শামার জোসেফের হাতে বল তুলে দেয়ার পরই বদলে যেতে থাকা দৃশ্যপট। প্রথম ওভারটা খরুচে করলেও নিজের দ্বিতীয় ওভারেই শুরু করেন তোপ দাগানো বোলিং। টানা দুই বলে উড়ান স্মিথ আর হেডের স্টাম্প। টানা দশ ওভারের স্পেলে চতুর্থদিন নিয়েছেন পাঁচ উইকেট। তার সেই স্পেলেই ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় অস্ট্রেলিয়া। সমতায় শেষ হওয়া দুই টেস্টের সিরিজে ১৩ উইকেট নিয়েছেন শামার জোসেফ। ম্যাচসেরা তো হয়েছেনই, জিতেছেন সিরিজ সেরার পুরস্কারও। 

    জোসেফ অস্ট্রেলিয়াতে এসেছিলেন বোধহয় ইতিহাস লিখতেই।  টেস্ট ক্রিকেটে নিজের প্রথম বলেই নিয়েছিলেন স্মিথের উইকেট। অ্যাডিলেডে পাঁচ উইকেট নেওয়া স্পেলের পর নিজেই বলেছিলেন, ‘ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের বলে এসেছি প্রথম বলেই উইকেট নেব।’ হয়েছেও তাই। কিন্তু গ্যাবাতে যা হলো সেটা হয়তো ভাবেননি জোসেফ নিজেও। 

    সেই ভাবনাতে অবশ্য কিছু আর আসে যায় না। দিনশেষে জোসেফ মাঠ ছেড়েছেন সবটুকু আলো কেড়ে নিয়ে, রূপকথার গল্প লিখে। যার শুরুটা হয়েছিল গায়ানার প্রত্যন্ত  গ্রাম বারাকারা থেকে। যেখান ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন সেই অর্থে কেউ দেখত না। কিন্তু দেখেছিলেন শামার জোসেফ, যিনি পাড়ি দিয়েছেন লম্বা একটা পথ। বছর খানেক আগেও গায়ানাতে কাজ করেছেন সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে। সেই শামার জোসেফের জন্যই আরো একবার ব্যবহার করা যায় ইয়ান বিশপের কন্ঠনিঃসৃত, ক্রিকেট রূপকথার অংশ হয়ে যাওয়া সেই বাণী, ‘রিমেম্বার দ্য নেম…’