• ইউরো ২০২৪
  • " />

     

    স্পেনের বাচ্চা ভয়ংকর, কাচ্চা ভয়ংকর

    স্পেনের বাচ্চা ভয়ংকর, কাচ্চা ভয়ংকর    

    স্পেন-জর্জিয়া ম্যাচের পরের একটা দৃশ্য তো সবারই চোখে পড়েছে। কে আগে পানি খাবেন, সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য রক-পেপার-সিজার খেলছেন নিকো উইলিয়ামস আর লামিন ইয়ামাল। প্রথমজনের বয়স এখনো ২২ পূর্ণ হয়নি, আর ষোল বছরের লামিন তো খাতায় কলমে এখনো ‘শিশু’ই। এই দুই তরুণ উইঙ্গারের কাঁধে ভর দিয়েই নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছে স্পেন।

    জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের মতো দলগুলো চলতি ইউরোতে এখনো অপরাজিত। তবে সব  ম্যাচে জিতেছে কেবল স্পেনই। প্রচলিত টিকিটাকা থেকে অনেকটা বেরিয়ে এসে ডিরেক্ট ফুটবলের দিকে ঝুঁকে পড়েছে দলটি। আর তাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুই উইঙ্গার, নিকো উইলিয়ামস আর লামিন ইয়ামাল।

    বরাবরই মিডফিল্ডারদের ওপর নির্ভরশীল স্পেন সম্ভবত এবারই প্রথম একই সাথে দুজন দারুণ উইঙ্গার পেলো। একটা সময়ে মিডফিল্ড এবং ফরোয়ার্ড লাইন মিলিয়ে ছয়জন মিডফিল্ডারও খেলাতে দেখা গেছে স্পেনকে, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা এবং ডেভিড সিলভা খেলতেন দুই ফলস উইঙ্গার হিসেবে। সেই স্পেন এখন উইংয়ে ভরসা করছে এক কাতালান আর এক বাস্ক তরুণের ওপর, যাদের উভয়েই গতি দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে পারেন প্রতিপক্ষের রক্ষণকে।

    স্পেনের ম্যাচে বল পজেশনে প্রতিপক্ষের চেয়ে স্পেন এগিয়ে থাকবে, এই দৃশ্য দেখেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু চলতি ইউরোতে সেই দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ছে না। এই টুর্নামেন্টে পর্তুগাল, ইতালি, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া, ফ্রান্স, ডেনমার্কের মতো দলগুলোর অ্যাভারেজ পজেশন স্পেনের চেয়ে বেশি। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে দলটির পজেশন ছিল ৪৭ শতাংশ, টানা ১৩৬ ম্যাচে পঞ্চাশ শতাংশের অধিক পজেশন রাখার রেকর্ডেও ছেদ পড়েছে তাতে।

     

    কিন্তু তাতেও স্পেনের আক্রমণাত্মক ও কার্যকরী ফুটবলে কোন বাধা আসেনি। এর পেছনে ভূমিকা রাখছেন লেফট উইঙ্গার নিকো উইলিয়ামস আর রাইট উইঙ্গার লামিন ইয়ামাল। দুজনে খেলছেন দুই টাচলাইনে। 

    মাঠটাকে অনেকটা ওয়াইড করে প্রতিপক্ষের জন্য রক্ষণের কাজটা কঠিন করছেন, আর মিডফিল্ড থেকে রদ্রি-পেদ্রি-রুইজের বলগুলো রিসিভ করে রান নিচ্ছেন দুই উইং ধরে। মাঠে দুজনের সমন্বয়টাও দারুণ। দুজনেই দুজনের মুভমেন্ট বুঝতে পারেন খুব দ্রুত, আর মাঠের খেলাতেও তা স্পষ্ট। চলতি টুর্নামেন্টে একটা করে গোল আর অ্যাসিস্ট পেয়ে গেছেন নিকো উইলিয়ামস। লামিন অবশ্য গোলের দেখা পাননি, তবে দুটো অ্যাসিস্ট পেয়েছেন ইতোমধ্যে। ফিনিশিং আরেকটু ভালো হলে আর ভাগ্য সাথে থাকলে জর্জিয়ার বিপক্ষে গোলটাও পেয়ে যেতেন।

    তবে নিকো-লামিনের এর ইউরোর পারফরম্যান্সকে ফ্লুক বলার কোন সুযোগ নেই। গত দুই মৌসুম ধরেই অ্যাটলেটিক বিলবাওতে ভালো খেলছেন নিকো, আর এক মৌসুম নিয়মিত খেলেই বার্সেলোনার প্রাণভোমরা হয়ে উঠেছেন লামিন। তবে এই দুই উইঙ্গারের ক্যারিয়ারের শুরুটা একটু ভিন্ন।

    ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই নিয়মিত রাইট উইংয়ে খেলছেন লামিন, জাভি খুব কমই লেফটে খেলিয়েছিলেন তাঁকে। গত মৌসুমে লিগে ৫ গোলের সাথে ৫ অ্যাসিস্ট পেয়েছেন তিনি। তবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, বার্সার রাইট উইংটা লম্বা সময়ের জন্যই নিজের করে নিতে চান তিনি।

    ওদিকে নিকো উইলিয়ামস ক্যারিয়ারের প্রথম দুই মৌসুমে খেলেছেন রাইট উইংয়ে, এরপর বিলবাও কোচ আর্নেস্তো ভালভার্দে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন লেফটে। গত মৌসুমে লেফট উইংয়ে বেশ ভালো খেলেছেন নিকো, লিগে ৫ গোল আর ১১ অ্যাসিস্টের পাশাপাশি গতি দিয়ে ভড়কে দিতে পেরেছেন প্রতিপক্ষকে। তাতে বার্সেলোনাও এখন স্বপ্ন দেখছে লেফট উইঙ্গার হিসেবে নিকোকে দলে ভেড়ানোর। নিকো নিজেও মোটামুটি রাজি। এখন লা লিগার ফিন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে বা এফএফপি বাগড়া না দিলে আগামী মৌসুমে বার্সার দুই উইং মাতাতে পারেন নিকো-লামিন।

     

    তবে আপাতত বার্সেলোনা নয়, বরং মনোযোগটা রাখা যাক স্পেনকে ঘিরেই। জার্মানির বিপক্ষে নিকো-লামিনকে আটকানোর কাজটা করতে হবে জার্মান রক্ষণের দুই ফুলব্যাককে। গত ম্যাচগুলোর সাপেক্ষে ভাবলে, জার্মান ব্যাকলাইনটা অনেকটা এমন হতে পারে, লেফট ব্যাক ডেভিড রাউম, সেন্টার ব্যাক রুডিগার এবং শ্লটারবাখ, রাইটব্যাক ইয়োশুয়া কিমিখ। সেই হিসেবে রাইটব্যাক কিমিখের ওপর দায়িত্ব থাকবে নিকোকে আটকানোর, আর রাউম সামলাবেন লামিনকে। ওয়ান ভার্সেস ওয়ানে দারুণ দক্ষ দুই স্প্যানিশ উইঙ্গারকে কীভাবে সামলাবেন দুই জার্মান ফুলব্যাক, সেটাও দেখার ব্যাপার। জার্মান মিডফিল্ডার আর উইঙ্গারদেরও এক্ষেত্রে ট্র্যাকব্যাক করে ডিফেন্সে ভূমিকা রাখতেই হবে।

     

    এক্ষেত্রে এটাও বলে রাখা ভালো, সর্বশেষ চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদের লেফট উইঙ্গার ভিনিসিয়াস জুনিয়রকে আটকাতে হিমশিম খেতে হয়েছিল কিমিখকে। আরেক লেফট উইঙ্গার নিকো আবারও সেই কঠিন সময়টা উপহার দেবেন কিনা, সেদিকে দৃষ্টি রাখতেই হচ্ছে। ওদিকে লামিনের কাটব্যাক আর বাঁ পায়ের ক্রসগুলোর দিকে নজর রাখতে হবে লাইপজিগের লেফটব্যাক ডেভিড রাউমকে।

    সব মিলিয়ে, জার্মান ফুলব্যাকরা ঠিক কতটা সামলাতে পারবেন দুই তরুণ স্প্যানিশ উইঙ্গারকে, এর ওপরেই নির্ভর করবে হাইভোল্টেজ এই কোয়ার্টার ফাইনালের ফলাফল। আর স্প্যানিশ এই দুই ‘শিশু’ নিজেদের কতটা মেলে ধরতে পারবেন, এর ওপর নির্ভর করছে স্পেনের আগামী দশকের ফুটবল-সাফল্য।