• রিও ২০১৬
  • " />

     

    রক্তাক্ত প্রান্তর থেকে জুডোর ম্যাটে

    রক্তাক্ত প্রান্তর থেকে জুডোর ম্যাটে    

    বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সাড়ে ৬ কোটিরও বেশী শরণার্থীকে নতুন করে আশার আলো দেখাতে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি নিয়েছে এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ১০ জন শরণার্থীর একটি দল অংশ নিচ্ছে চলমান রিও অলিম্পিকে। সেই দলে আছেন কঙ্গোর দুই জুডোকা।


    আরও পড়ুনঃ উত্তাল সমুদ্র থেকে অলিম্পিকের পুলে


    ১।

    জেরাল্ডো বার্নার্ডেস পড়েছেন মহা মুশকিলে। এতো বছর ধরে জুডোর তালিম দিচ্ছেন, এমন অদ্ভুত সমস্যায় তাঁকে কখনও পড়তে হয় নি। নতুন ছেলেমেয়ে দুটোকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না যে অনুশীলনে এতো 'সিরিয়াস' হওয়ার কিছু নেই। তাদের প্র্যাকটিস দেখে যে কারও মনে হতে পারে, অলিম্পিকের সোনার জন্য লড়াই চলছে বোধহয়! বার্নার্ডেসের নিয়মিত ছাত্রদের সাথে ওদের লেগে যাচ্ছে প্রায়ই...

    পিপল মিসেনগা আর ইয়োলানদে মাবিকার এমন ‘অদ্ভুত’ আচরণের কারণটা বের হতে অবশ্য বেশী সময় লাগলো না। মধ্য আফ্রিকার দেশ কঙ্গোর এই দুই জুডোকা কোনোদিন আলাদা করে চেনার সুযোগই পান নি যে কোনটা অনুশীলন আর কোনটা প্রতিযোগিতামূলক লড়াই। তাঁরা কেবল জানেন, হেরে গেলেই শাস্তিস্বরূপ রাত কাটাতে হবে তালাবদ্ধ ঘরে, দুয়েকদিন না খেয়েও থাকতে হতে পারে! ‘সাজা’ এড়াতেই তাই খেলতে নেমে মিসেনগাদের চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়, প্রতিটা দ্বৈরথ হয়ে ওঠে একরকম বাঁচামরার লড়াই।

     

    ২।

    ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত চলা কঙ্গোর গৃহযুদ্ধকে বলা হয় আফ্রিকার স্মরণকালের ইতিহসে সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাত। ৫০ লাখ মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হন আরও কয়েক লক্ষ কঙ্গোবাসী। ৯ বছরের বালক পিপল মিসেনগা সে দুর্দিনেই হারায় তার মাকে। একমাত্র ভাইটাও তখন থেকে নিখোঁজ। প্রাণের তাগিদে জনবসতি ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয় তাকে। অতোটুকুন বয়সে জীবনের বহু মোড় ঘুরে তার ঠিকানা হয় রাজধানী কিনশাসায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের এক আশ্রমে।

    জুডোয় হাতেখড়িটা সেখানেই। বয়সের ঘড়িতে চব্বিশ পেরিয়ে যাওয়া মিসেনগা স্মরণ করছিলেন সে সময়টা, "ওই বয়সে তো বাবা-মাই আপনাকে সব শেখায়। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের বোধটা শিশুরা পায় পরিবার থেকে। কিন্তু আমার তো কোনো পরিবার ছিল না। জুডোই আমাকে শিখিয়েছে সব।"

     

    ৩।

    ২০১৩ সাল। ব্রাজিলের রিওতে চলছে জুডোর বিশ্বকাপ। কঙ্গো জাতীয় দলের হয়ে সে আসরে এসেছেন মিসেনগা। সতীর্থ নারী প্রতিযোগী মাবিকার সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা হচ্ছে ক'দিন ধরেই। কোচদের অত্যাচার আর সহ্য হচ্ছে না। শাস্তি হিসেবে ‘অবরুদ্ধ’ থাকার সময়গুলোয় রাগ-ক্ষোভ-হতাশায় কখনও মরে যেতে ইচ্ছে করে। তা-ও বিদেশের মাটিতে ক'টা দিন একটু ভালো থাকা যাচ্ছে। দেশে ফিরলেই তো আবার সেই যুদ্ধ-বিগ্রহ, মারামারি-কাটাকাটির মধ্যে দিনানিপাত...এর নাম জীবন! সেই যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার শুরু দুই দশক আগে, এর তো শেষ হয় নি আজও। বাতাসে লাশের গন্ধ যে আর সহ্য হয় না, "ওখানে সেনাবাহিনীর একমাত্র কাজ কী জানেন? খুন করা! এই ছোট্ট জীবনে এতো বেশী যুদ্ধবিগ্রহ আর মৃত্যু দেখে ফেলেছি যে এসব আর নিতে পারছিলাম না।"

    দু'জনের মাথায় একই ভাবনা, ওই মৃত্যুপুরীতে আর ফিরে যাওয়া যাবে না। কিন্তু যাবেনই কোথায়? তখনই মাথায় এলো ব্যাপারটা, পালিয়ে গেলে কেমন হয়? শরণার্থী হিসেবে ব্রাজিলে আশ্রয় চাইলে পাওয়া যাবে না?

    সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই মিসেনগা আর মাবিকা বেড়িয়ে পড়েন হোটেল ছেড়ে। বিদেশ-বিভূঁইয়ে, অচেনা শহরে, অজানা ভাষা আর মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার আগে ভয় যে হচ্ছিল না তা নয়। কিন্তু ওই তালাবদ্ধ ঘর, দু' দিন না খেয়ে থাকার জ্বালা আর জ্বলন্ত দেশের ভয়াল স্মৃতি...ওইটুকু ভয় উবে যেতে সময় লাগলো না।

     

    ৪।

    তাঁদের জীবনের পরের আড়াই বছরের গল্পটা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি শরণার্থীর থেকে আলাদা কিছু নয়; যুদ্ধের বিভীষিকা কেড়ে নিয়েছে যাদের স্বাভাবিক জীবন, পরের দেশে তাঁদের ‘করুণা’র পাত্র হয়ে বেঁচে থাকায় আর বৈচিত্র্য কোথায়! প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে ভিনদেশে মানবেতর জীবন কাটানো এই মানুষগুলোকে আশার আলো দেখাতে এক নজিরবিহীন উদ্যোগ নেয় আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি। ঘোষণা দেয়া হয়, এবারের অলিম্পিকে থাকবে শরণার্থীদের একটি দলও। তাঁরা আলাদা কোনো দেশের নয়, প্রতিনিধিত্ব করবে খোদ অলিম্পিকের, বহন করবে অলিম্পিকের পতাকা।

    মিসেনগা-মাবিকার জীবনের নতুন মোড় এই উদ্যোগেই। একটি দেশের জাতীয় দলের সাবেক ক্রীড়াবিদ তাঁরা। অন্য যে কারও চেয়ে তাঁদের দাবীটা অন্তত একটু হলেও তো বেশী ছিলই। তাছাড়া ব্রাজিলে বসবাসরত সাড়ে ৮ হাজার শরণার্থীর মধ্যে অলিম্পিকের মতো আসরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সামর্থ্যও আছে কেবল তাঁদের দু'জনেরই! অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর নির্বাচিত দশ সদস্যের শরণার্থী অলিম্পিক দলে তাই অনেকটা প্রত্যাশিতভাবেই আসে কঙ্গোর জুডোকাদ্বয়ের নাম।

     

     

    কোচ জেরাল্ডো বার্নার্ডেসের সাথে মিসেনগা ও মাবিকা

     

    ৫।

    সময়টা যেন আক্ষরিক অর্থেই বদলে যেতে লাগলো এরপর থেকে। দু' বছরের উদ্বাস্তু জীবন থেকে তাঁরা ফের জুডোর ম্যাটে। রিও’র রিয়াসাও ইন্সটিটিউটে ব্রাজিলের অলিম্পিক দলের সাথেই চলে তাঁদের অনুশীলন। শুরুতেই বলা 'সিরিয়াস' অনুশীলনের গল্পটা ওখানেরই।

    ব্রাজিলের অভিজ্ঞ জুডো কোচ জেরাল্ডো বার্নার্ডেস দিচ্ছেন তাঁদের প্রশিক্ষণ। প্রবীণ এই ভদ্রলোক বলছিলেন শুরুর সেই সমস্যা এখন আর নেই, "সময়ের সাথে তাঁরা বেশ মানিয়ে নিয়েছে। আর আমাদের প্রতিযোগীরাও ওদের একরকম আগলেই রাখছে। তাঁদেরকে ঘষেমেজে নেয়ার জন্য সম্ভব সব চেষ্টাই আমরা করছি।"

    রিও'র এই ভালোবাসা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে চান মিসেনগা-মাবিকা। "অলিম্পিকের অংশ হয়ে আমি পৃথিবীর সব শরণার্থীর কাছে আশার আলো পৌঁছে দিতে চাই, সবার দুঃখ মুছে দিতে চাই। তাঁদের অন্তত এটুকু বিশ্বাস করতে শেখাতে চাই, শরণার্থীরাও পারে দামী কিছু করতে...", বলতে বলতে গলাটা যেন ভারী হয়ে আসে মিসেনগার।

    দেশের জন্য লড়তে না পারার আক্ষেপটুকু কোটি কোটি শরনার্থীর প্রতিনিধি হিসেবে ভুলে থাকতে চান মাবিকা। তবু চাইলেই কি আর সব ভুলে থাকা যায়? বাড়ির জন্য, বাবা-মা আর ভাইদের জন্য মনটা তো পোড়েই। সেই যে দেশ ছেড়ে এসেছেন তিন বছর আগে, আর কোনো যোগাযোগ নেই পরিবারের সাথে। মাবিকার মনে তাই ক্ষীণ আশা, অলিম্পিকের খেলা কিংবা খবরে তাঁকে টিভিতে দেখে কেউ না কেউ বাড়িতে খবরটা দেবে। প্রিয় মানুষগুলোর সাথে যোগাযোগের একটা ব্যবস্থা হবে।

    মাবিকার স্বপ্ন, তাঁর জীবনটা এখান থেকে বদলে যাবে ইতিবাচকভাবেই। দিনবদলের গান তিনি শোনাতে চান সব শরণার্থীকে। আর মাবিকার সেই গানই যেন প্রতিজ্ঞা হয়ে ঝরে মিসেনগার কণ্ঠে, "আমি তো সবার প্রতিনিধি! একটা পদক আমি জিতবোই, সবার জন্য...সব শরণার্থীর জন্য!"