সেদিনের এই দিনে : ধার করা ব্যাট-জুতাতেই ইতিহাস!
ধার করা ব্যাট। ধার করা জুতা। একটা ট্রিপল সেঞ্চুরি। একটা ফিফটি। একটা টাইমলেস টেস্ট। একজন অ্যান্ডি স্যান্ডহ্যাম। একটা ইতিহাস!
প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরির দেখা পেতে টেস্ট ক্রিকেটকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ৫৩ বছর ২০ দিন। ৩৯ বছর ২৭২ দিন বয়সে জ্যামাইকার স্যাবাইনা পার্কে প্রথম ইনিংসে স্যান্ডহ্যামের ৩২৫ রানের ইনিংসই হয়ে আছে সবচেয়ে বয়স্ক ক্রিকেটার হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরির রেকর্ড।
প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ান বাদ দিয়ে স্যান্ডহ্যামের বোধহয় সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি ছিলেন স্যার জ্যাক হবসের ওপেনিং সঙ্গী, সারেতে। দুজনের ৬৬টি তিন অঙ্কের জুটি আছে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ৪২৮ রানের জুটিটি সহ। সে জুটিতেও বেশিরভাগ রান ছিল স্যান্ডহ্যামেরই, তবে ‘স্পটলাইট’ বরাবরের মতোই ছিল হবসের ওপরই!
তবে স্যান্ডহ্যাম আলাদা হয়ে ক্রিকেট ইতিহাসে টিকে আছেন একটা সফরের জন্য। যে সফরে ছিলেন না হবস!
১৯৩০ সাল। একই সঙ্গে পৃথিবীর দুই প্রান্ত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নিউজিল্যান্ডে টেস্ট খেলছিল দুইটি ইংল্যান্ড দল! টেস্ট ক্রিকেটকে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার বাইরে সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে তখনকার ক্রিকেট কাউন্সিল এসব দেশেরে সফরে গুরুত্বের দিকে নজর দিয়েছিল।
তখনও ইংল্যান্ডের দেশের বাইরের সফর নিয়ন্ত্রণ করতো এমসিসি, যে নিয়ম চালু ছিল ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত। আগে থেকেই আবার অ্যাশেজ ও দক্ষিণ আফ্রিকা সফর ঠিক হয়ে আছে। নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে দল পাঠাতে তাই এমসিসি নিল কৌশলের আশ্রয়। একই সঙ্গে দুই জায়গাতেই পাঠানো হলো দুইটা ইংল্যান্ড দল! তখনকার সফর হতো দীর্ঘ, পরিবার ছেড়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে এতোদিন কেইবা থাকতে চান টানা! অনেক ক্রিকেটারই তাই নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলেন এসব সফর থেকে। কেউবা যেতে পারলেন না শারীরিক কারণে। নিউজিল্যান্ড সফরে পাঠানো হলো নতুন একটা দলকে, ফ্র্যাঙ্ক উলি ছাড়া যে দলে টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা ছিল মাত্র চারজনের। সে দলের অধিনায়ক ছিলেন নিয়মিত অধিনায়ক আর্থার গিলিগানের ভাই, হ্যারল্ড।
ক্যারিবীয় সফরের দলটা ছিল সে তুলনায় অভিজ্ঞ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তুলনামূলক কঠিন প্রতিপক্ষ বলেই এ ব্যবস্থা। তবে ছিলেন না জ্যাক হবস। তাঁকে সে সফরে পেতে বার্বাডোজ থেকে কয়েকজন বোর্ডকর্তা ইংল্যান্ডে এসেছিলেনও। তবে ৪৭ বছর বয়স আর পরের অ্যাশেজের কথা চিন্তা করেই হবসকে চাপ দেননি কর্তারা।
অভিজ্ঞ দল, তবে অনায়াসেই বলা যায় বুড়োদের দল। মাত্র পাঁচজনের বয়স ছিল ৩০ বছরের নিচে। ছিলেন ৫২ বছর বয়স্ক উইলফ্রেড রোডস, যিনি শেষ টেস্ট খেলেছিলেন ১৯২১ সালে! ১৯৩০ সালের ১২ এপ্রিল, সফরের শেষ টেস্টের শেষদিনে রোডসের বয়স ছিল ৫২ বছর ১৬৫ দিন, তিনিই হয়ে আছেন সবচেয়ে বয়স্ক টেস্ট ক্রিকেটার। জ্যামাইকা টেস্টে ইংল্যান্ড ক্রিকেটারদের গড় বয়স ছিল ৩৭ বছর ১৮৮ দিন, এখন পর্যন্ত যা সর্বোচ্চ।
বার্বাডোজ টেস্টে নামছে ইংল্যান্ড দল
সেই বুড়োদের দলে ছিলেন অ্যান্ডি স্যান্ডহ্যামও। ইংল্যান্ডের হয়ে তিনি শেষ খেলেছিলেন বছর পাঁচেক আগে। সফরের শেষ টেস্টটা ছিল টাইমলেস। সেই বিখ্যাত ডারবান টেস্টের মতো এটিও ড্র হয়েছিল, কারণটাও ছিল একইঃ ইংল্যান্ডের জাহাজ ধরার তাড়া!
সিরিজের শেষ টেস্ট বলে স্যান্ডহ্যাম তাঁর বাড়তি ব্যাটগুলো বিক্রি করে দিয়েছিলেন। একমাত্র ব্যাটটাতেও দেখা দিল ফাটল। অধিনায়ক ফ্রেডি ক্যালথর্পের ব্যাট ধার করলেন, জুতাও ধার করতে হলো প্যাটসি হ্যানড্রেনসের থেকে। সে জুতা আবার পায়ে হচ্ছিল না ঠিকঠাক, রান নেয়ার সময় পা পিছলে যাচ্ছিল বারবার!
সেই ব্যাট হাতে, সেই জুতো পরেই স্যান্ডহ্যাম গড়লেন ইতিহাস। ওপেনিংয়ে করলেন ৩২৫ রান, সঙ্গে লেস অ্যামিসের ১৪৯ রানে ইংল্যান্ডের রান ৮৪৯। এখন পর্যন্ত বিদেশের মাটিতে কোনো দলের এটিই সর্বোচ্চ স্কোর। প্রথম ইনিংসেই ৫৬৩ রানের লিড পেলো ইংল্যান্ড, তবে ক্যালথর্প ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ফলো-অন করালেন না!
সমালোচনা হলো, তবে দলের বয়স্ক সব ক্রিকেটাররা টানা একদিন ফিল্ডিং করেছিলেন বলে তাঁর সিদ্ধান্তটা ছিল বিবেচনা করার মতোই। দ্বিতীয় ইনিংসে ৯ উইকেটে ২৭২ রান করে ইনিংস ঘোষণা করলো ইংল্যান্ড। স্যান্ডহ্যাম করলেন ফিফটি। একই টেস্টে সবচেয়ে বেশী রানের স্যান্ডহ্যামের এ রেকর্ড টিকেছিল দীর্ঘদিন। গ্রেগ চ্যাপেল ওয়েলিংটনে সে রেকর্ড ভেঙেছিলেন ৪৪ বছর ও ৫৪৩ টেস্ট পর!
তবে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটা টেকেনি বেশিদিন! ততোদিনে যে চলে এসেছেন ক্রিকেটের ডন! লিডসে ৩৩৪ রানের ইনিংসটা স্যার ডন খেলেছিলেন মাস চারেক পরই।
দ্বিতীয় ইনিংসে জর্জ হেডলির ডাবল সেঞ্চুরিতে ঘুরে দাঁড়ালো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৫ উইকেটে ৪০৮ রান রেখেই ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা ছুটলেন, জাহাজ ধরতে।
স্যান্ডহ্যামও গেলেন। নিজের শেষ টেস্ট খেলে! রবার্ট সাটক্লিফ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই নিজেকে জ্যাক হবসের ওপেনিং সঙ্গী বানিয়ে ফেলেছেন ইংল্যান্ড দলে। স্যান্ডহ্যাম রয়ে গেলেন সারেতেই। তিনি বিশ্বস্ত এক ব্যাটসম্যান ছিলেন, তবে টেস্টের মানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি নিজেকে!
তাতে কী!
টেস্টের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ান হিসেবেই তো অ্যান্ডি স্যান্ডহ্যাম নিজের নামটা ক্রিকেট ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। এক অসাধারণ ভিতে! যে ট্রিপল সেঞ্চুরিটি স্যান্ডহ্যাম করেছিলেন অন্যের ব্যাট হাতে।
অন্যের জুতা পরে!