অপি থেকে মুশফিক: বৃত্তপূরণের গল্প
ম্যাজিক ফিগারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল ৩০তম ওয়ানডে পর্যন্ত। ১৯৯৯ সালে মেহরাব হোসেন অপির ব্যাটে যে ওয়ানডে সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিল বাংলাদেশ, ৩৩৩তম ওয়ানডেতে সেটির বৃত্তপূরণ করেছেন মুশফিকুর রহিম। অবশেষে সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের সঙ্গে (আয়ারল্যান্ড ও আফগানিস্তান ছাড়া) সব টেস্ট দলের মাঠেই সেঞ্চুরি হয়েছে বাংলাদেশের। তবে ৪২টি ওয়ানডের ছোট্ট ইতিহাস জানান দিচ্ছে, একটা সময় সোনার হরিণই হয়ে উঠেছিল তা।
১৯৯৯ সালে ঢাকায় মেরিল কাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১০১ রান করে আউট হয়েছিলেন মেহরাব হোসেন অপি। বাংলাদেশ প্রথম ওয়ানডে জয় পেয়েছিল তার আগেই, সেই ম্যাচেও অবশ্য শেষ পর্যন্ত জয় পাওয়া হয়নি। এরপর স্বপ্নের ১৯৯৯ বিশ্বকাপ, টেস্ট স্ট্যাটাস, ২০০৩ সালের আরেকটি দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপ, প্রথম টেস্ট জয়- অনেক কিছুই হয়ে গেছে। তবে কোনো এক অভিশাপে বাংলাদেশের ওয়ানডেতে সেঞ্চুরিটা যেন আর পাওয়াই হচ্ছিল না। তার চেয়েও অবিশ্বাস্য, মার্চ ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সালের জুন- এই ছয় বছর বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান এমনকি নব্বইয়ের ঘরেও যেতে পারেনি। অথচ এই সময়ে বাংলাদেশ ওয়ানডে খেলেছে ৭৭টি।
সেই রাহু থেকে অবশেষে মুক্তি দেন মোহাম্মদ আশরাফুল। ২০০৫ সালের কার্ডিফে সেই অস্ট্রেলিয়া-বধে আশরাফুলের ১০০ রান বাংলাদেশের ইতিহাসেরই সবচেয়ে স্মরণীয় ইনিংসগুলোর একটি। তবে ওই বছর বাংলাদেশের আর কেউ ছুঁতে পারেনি তিন অঙ্ক।
পরের বছর থেকে সেই তিন অঙ্ক বাংলাদেশের জন্য হয়ে যায় নিয়মিত। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে, সেটি অনেকটা নৈমিত্তিক করে ফেলেন শাহরিয়ার নাফীসই। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ ওয়ানডেতে পায় চারটি সেঞ্চুরি, এর তিনটিই নাফীসের। তিনটিতেই প্রতিপক্ষ আবার জিম্বাবুয়ে। ওই বছর বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন রাজিন সালেহ, প্রতিপক্ষ কেনিয়া।
২০০৭ সালে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিও সেই নাফীসেরই, এবার প্রতিপক্ষ অবশ্য বারমুডা। এই বছরেই সাকিব আল হাসান বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের হয়ে সেঞ্চুরি করেন কানাডার বিপক্ষে।
২০০৮ সালে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি পেয়েছেন তামিম ইকবাল, প্রতিপক্ষ আয়ারল্যান্ড। তখনও অবশ্য জানতেন না, এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ স্কোরও হয়ে যাবে তাঁর। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের হয়ে আরও তিনটি সেঞ্চুরি হয়েছে। সাকিব-আশরাফুল দুজনেই পেয়েছিলেন নিজেদের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি, অলক কাপালির জন্য যা প্রথম। সাকিবের সেঞ্চুরিটি ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে, অস্ট্রেলিয়ার পর আবারও কোনো টেস্ট দলের সঙ্গে ওয়ানডেতে তিন অঙ্কের দেখা পেল বাংলাদেশ।
২০০৯ সালে বাংলাদেশের চার সেঞ্চুরির সবগুলোরই জিম্বাবুয়ের সঙ্গে। এর মধ্যে তামিমের ১৫৪ রানের ইনিংসটাই আলাদা করে লেখা থাকবে। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রানের ওই রেকর্ড টিকে আছে এখনো। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডের মাঠে আসে সেঞ্চুরি, ইমরুল কায়েসের সৌজন্যে। এই বছর বাংলাদেশের সব সেঞ্চুরিই ‘ল্যান্ডময়’। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে আরেকটি সেঞ্চুরি পেয়েছেন সাকিব, তামিম ইংল্যান্ডের সঙ্গে আর জুনায়েদের প্রতিপক্ষ ছিল আয়ারল্যান্ড।
২০০৬ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ভরা মৌসুমের পর আবার আসে একটা খরা। ২০১১ সালে বাংলাদেশ সেঞ্চুরি পেয়েছে দুইটি, মুশফিক ও নাসির হোসেনের ওই দুই সেঞ্চুরি আবার তাঁদের ক্যারিয়ারেরই প্রথম। ২০১২ সালে একমাত্র সেঞ্চুরি এনামুল হক বিজয়ের, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে যা ছিল বাংলাদেশের প্রথম। ২০১৩ সালেও মাত্র একটি সেঞ্চুরি আসে তামিমের সৌজন্যে।
২০১৪ সালটা বাংলাদেশের জন্য খারাপ গেলেও সেঞ্চুরির দুয়ার খুলেছে ভালোমতোই। এই বছর চারটি সেঞ্চুরির দুইটি বিজয়ের, অন্য দুইটি সাকিব ও মুশফিকের।
বাংলাদেশের বদলে যাওয়া ২০১৫ সালটা দুই হাত ভরেই দিয়েছে ব্যাটসম্যানদের। বিশ্বকাপে মাহমুদউল্লাহর টানা দুই সেঞ্চুরি দিয়ে শুরু, এই বছর সাতটি সেঞ্চুরি পেয়েছে বাংলাদেশ। দুইটি করে পেয়েছেন তামিম ও মুশফিক, অন্যটি সৌম্যর। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ওয়ানডেই খেলেছে কম। আফগানিস্তান ও ইংল্যান্ডের সঙ্গে তিন অঙ্ক দেখেছেন তামিম ও ইমরুল। সাকিবকে এই বছরেই সেঞ্চুরি সংখ্যায় ছাড়িয়ে গেছেন তামিম, নয়টি সেঞ্চুরি নিয়ে এখনও তিনিই সবার ওপরে।
২০১৭ সালের শুরুটাও তামিমময়, ডাম্বুলা ও ওভালে দুই সেঞ্চুরি দিয়ে তামিম চলে গেছেন ওয়ানডে সেঞ্চুরির দুই অঙ্কের কাছাকাছি। এরপর কার্ডিফে সাকিব-মাহমুদউল্লাহর ওই মহাকাব্যিক জোড়া সেঞ্চুরি, মাত্র দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ একই ইনিংসে দেখেছে দুই সেঞ্চুরি। আর আজ মুশফিকুর রহিম দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে করলেন প্রথম সেঞ্চুরি, তাও দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠেই। দলের সঙ্গে দেশেরও একটা বৃত্তপূরণ হলো তাই।
এই ৪২টি সেঞ্চুরির ১১টিতেই প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে, বাংলাদেশের এরপর সর্বোচ্চ সাতটি সেঞ্চুরি পাকিস্তানের সঙ্গে। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে আছে পাঁচটি, ইংল্যান্ডের সঙ্গে চারটি। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও আছে একটি, এবার দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে অবশেষে কাটল গেরো। কিন্তু ১০ উইকেটের হারের পর সেঞ্চুরিটা শুধুই একটা রেকর্ড হয়েই থাকল, আফসোস এটাই।