সেদিনের এই দিনে : ওয়ানডে ক্রিকেটের 'হঠাৎ' জন্ম
“এটাকেই প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ বলা হয়, এটা আমাকে এখনো বিস্মিত করে! ম্যাচটিকে আমরা একরকম মজা হিসেবেই নিয়েছিলাম”, স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া একাদশের হয়ে খেলা অ্যাশলি ম্যালেট।
১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারি। অ্যাশেজের তৃতীয় টেস্টের পঞ্চম দিন। এমন এক ঘটনার জন্ম হলো, যা আমূলে বদলে দিল ক্রিকেট খেলার চেহারাটাই। ৪৭ বছর আগে এই দিনেই হয়েছিল ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ, যা তখন খোদ খেলোয়াড়দের কাছেই ছিল নিছক বিনোদনের খোড়াক!
১৯৭০-৭১ গ্রীষ্মে ইংল্যান্ড গেল অস্ট্রেলিয়ায়, উদ্দেশ্য অবশ্যই অ্যাশেজ খেলা। মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্ট। তবে তার আগেই শুরু হয়ে গেল সমালোচনা। প্রথম দুই টেস্ট যে নিষ্প্রাণ ড্র, যার পেছনে অনেকাংশেই দায় দুই অধিনায়কের ম্যাড়মেড়ে কৌশলের। দ্যা গার্ডিয়ানের কলামে ব্রায়ান চ্যাপম্যান তো ক্রিকেটের ভবিষ্যতকেই অনিশ্চয়তার মুখে দেখতে পাচ্ছিলেন প্রথম দুই টেস্টের পর, “প্রথম দুই টেস্টের ধারাবাহিতায় আরেকটি ড্র পুরো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকেই প্রশ্নের সম্মুখীন করতে পারে।”
তবে মেলবোর্ন টেস্ট শুরুর আগেই বাগড়া বাঁধালো বৃষ্টি। কিসের রোমাঞ্চ, কিসের ম্যাড়মেড়ে কৌশল। মেলবোর্নের আকাশ থেকে অঝোর ধারায় নামছে শুধু মুষলধারে বৃষ্টি। একদিন, দুইদিন, তিনদিন- খেলা শুরুই হলো না। মেলবোর্ন কর্তৃপক্ষের প্রায় আশি হাজার পাউন্ডের ক্ষতিপূরণ বাবদ দুই দেশের ক্রিকেট বোর্ড ছয় ম্যাচের সিরিজ শেষে আরেকটি অতিরিক্ত টেস্ট খেলতে সম্মত হলো। তবে এ সিদ্ধান্তে ইংলিশ খেলোয়াড়রা ঠিক সন্তুষ্ট হলেন না, বরং দাবি করলেন অতিরিক্ত পারিশ্রমিকের। এ নিয়ে বোর্ডের সাথে সিরিজের বাকিটা জুড়েই খেলোয়াড়দদের বিবাদ অব্যাহত ছিল। বর্তমান ব্যস্ত সুচীতে যেখানে ৪০ দিনে তিন ফরম্যাটের একটি সিরিজই প্রায় শেষ হয়ে যায়, সেখানে তখনকার ইংলিশ খেলোয়াড়দের কাছে ৪০ দিনে চারটির বেশি টেস্ট খেলাটা বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল। যদিও একই গ্রীষ্মে পাকিস্তান ইংল্যান্ডের মাটিতেই ৪৮ দিনে ছয়টি টেস্ট খেলেছিলো।
অতিরিক্ত টেস্ট ছাড়াও দর্শকদের কথা বিবেচনা করে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড (যার নেতৃত্বে ছিলেন স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান) এবং এমসিসি তৃতীয় টেস্টের পঞ্চম দিনে একটি ওয়ানডে ম্যাচ আয়োজনের ব্যাপারে সম্মত হয়। ইংল্যান্ড একাদশ এবং অস্ট্রলিয়া একাদশ নামে দুইদল খেলতে নামে। ৮ বলে ওভার, ৪০ ওভারের ম্যাচ। একদম শেষ মুহূর্তে পাঁচ হাজার পাউন্ডের বিনিমিয়ে স্পন্সর হিসেবে যুক্ত হয় টোবাকো কোম্পানি রথম্যান্স। ম্যাচ সেরার পুরস্কার ৯০ পাউন্ড! ৪৫ হাজারের বেশি দর্শকের উপস্থিতি আয়োজকদের জন্যও ছিল বেশ বিস্ময়কর।
ম্যাচ শুরুর পূর্বে স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান দর্শকদের উদ্দেশ্যে যেন ঘোষণা করেন ক্রিকেটেরই ভবিষ্যতবাণী, “আপনারা একটি ইতিহাস দেখতে যাচ্ছেন।”
টানা বৃষ্টির ফলে ধীরগতির উইকেটে প্রথমে ব্যাট করতে নামা ইংল্যান্ড একাদশ করে ১৯০ রান। জন এডরিচ করেন ইনিংস ও ম্যাচ সর্বোচ্চ ৮২ রান। ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম ফিফটিও তাই সেটাই। কিথ ফ্লেচার এবং অ্যালান নটের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৪ রান। অ্যাশলি ম্যালেট ও কেইথ স্টেকপোল নেন তিনটি করে উইকেট।
অস্ট্রেলিয়া একাদশ ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে জেতে ৫ উইকেটে, ৪২ বল বাকি রেখে। ৬০ রান করা ইয়ান চ্যাপেলকে সঙ্গ দিয়েছিলেন ডগ ওয়ালটার্স। ইংল্যান্ড অধিনায়ক রে ইলিংওর্থ ৩ উইকেট নিয়েছিলেন। তবে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন এডরিচ, তার ৬০ রানের ইনিংসের জন্য।
ইলিংওর্থ অবশ্য ইতিহাসের অংশ হওয়ার চেয়ে বরং সেদিন মাঠে নামতে পেরেই বেশি উচ্ছ্বসিত ছিলেন, “ড্রেসিংরুমে টানা সময় কাটানোর পর সেদিন মাঠে নামতে পেরেই আমরা খুশি ছিলাম। বাণিজ্যিকভাবে ওয়ানডে ক্রিকেট যে সফল হতে যাচ্ছে সে বিষয়ে আমাদের কোন সন্দেহ ছিলোনা। তবে এখনকার মত আমরা খুব গুরুত্বসহকারে খেলিনি সেদিন।”
প্রথম ম্যাচেই অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়ার পরও তখনকার ক্রিকেট বোর্ডগুলোর মানসিকতার কারনে ওয়ানডে ক্রিকেট সেভাবে প্রসার লাভ করেনি। এরই মাঝে ১৯৭৫ সালে প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপ হলেও মূলত কেরি প্যাকারের বিখ্যাত ওয়ার্ল্ড সিরিজই পরবর্তীতে ওয়ানডে ক্রিকেটের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুন, যা সময়ের সাথে কেবল বেড়েই চলেছে।
অথবা বেড়ে চলেছিল, টি-টোয়েন্টি আসার আগে।
এখন তো ওয়ানডে ক্রিকেটর দীর্ঘস্থায়িত্বও প্রশ্নের সম্মুখিন। অনেকেই মনে করেন, ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ হবে টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি। থাকবেনা ওয়ানডের অস্তিত্ব। হঠাৎ যেভাবে এসেছিল, হারিয়ে যাবে সেভাবেই?
নাকি ১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারি যে ফরম্যাটের জন্ম হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত টিকে যাবে সেটাও!