• " />

     

    "উলটো সুইং"-এর পূর্বাপর

    "উলটো সুইং"-এর পূর্বাপর    

     

    মেলবোর্ন। ১৯৭৯ সাল। উত্তর গোলার্ধে তখন গ্রীষ্মের ডাক, আর দক্ষিণে শোনা যাচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। মার্চের এমনি এক রৌদ্রকজ্জ্বল দিনে মুখোমুখি পাকিস্তান, স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার সাথে; দুই টেস্টের সিরিজের প্রথম ম্যাচে। নিজেদের প্রথম ইনিংসে দুই দলই চরমভাবে ব্যর্থ। মেলবোর্নের অতিরিক্ত বাউন্সি পিচের পুরো সুবিধা আদায় করছিলেন পেসাররা। তৃতীয়দিন পর্যন্ত পাওয়া ২০ উইকেটের ১৭টিই ছিল তাই পেসারদের দখলে। কিন্তু আদর্শ টেস্ট ম্যাচের উইকেট যেমন হয়, তৃতীয় দিন থেকেই তা হয়ে গেল ব্যাটিং সহায়ক। মাজিদ খানের অসাধারণ সেঞ্চুরিতে পাকিস্তান অস্ট্রেলিয়ার সামনে ছুঁড়ে দিল ৩৮১ রানের পাহাড়সম লক্ষ্য।

     

    যে টেস্টের প্রথম ইনিংসে কোন দলই তেমন রান করতে পারছিল না, দ্বিতীয় ইনিংসে দুইদলই সেখানে রানের ফোয়ারা ছুটাল। হিলডিচের ৬২, বোর্ডারের ১০৫ আর হিউজের ৮৪ রানের উপর ভর করে এক পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ার স্কোরকার্ড দাঁড়ালো তিন উইকেটে ৩০৫! ক্রিজে তখনো বোর্ডার অপরাজিত আছেন, পরে ব্যাট করতে নামার জন্যে বসে আছেন উড, স্লিপের মত ব্যাটসম্যানরা।

     

    রানের পাহাড় ডিঙ্গানোটা যখন মনে হচ্ছিল কেবলই সময়ের ব্যাপার, তখনি যেন তুষারধ্বস ঘটলো। ঘটলো না বলে বলা ভাল, সরফরাজ নেওয়াজ সেটা ঘটালেন। অস্ট্রেলিয়া মাত্র ৫ রানে তাদের শেষ ৭ উইকেট হারিয়ে ৭১ রানে ম্যাচ হারলো! নেওয়াজ একাই ৮৬ রানের বিনিময়ে তুলে নিলেন ৯ উইকেট!

     

     

     

     

    এবারের ঘটনা পাকিস্তানে। চিরায়ত উপমহাদেশীয় পিচ - বাউন্স নেই, প্রখর সূর্যতাপে দ্বিতীয় দিনেই উইকেটে ফাটল। পেসাররা এখানের পিচে কেবল দলের কোটা পূরণ করেন, অমানুষিক খেটে হয়তো একটা দুটো উইকেট পান। স্পিনারদের স্বর্গ এমন পিচেই উইকেটের বৃষ্টি ঝরালেন একজন। তিনি ইমরান খান। পাকিস্তানের অবিসংবাদিত সেরা অলরাউন্ডার। বল পুরনো হলে সেটা কেবলি স্পিনারদের সম্পত্তি, এরূপ ধারণার প্রতি তাঁর তীব্র অনুযোগ ছিল। আর অনু্যোগটা যে ভিত্তিহীন নয় সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধেই তুলে নিলেন।

     

    পুরনো বলের অসহজাত সুইংয়ে দিশেহারা হয়ে ভারতীয় এবং ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা একবারে তালগোল পাকিয়ে ফেললেন। উপমহাদেশীয় পিচে খেলে একজন পেসার সিরিজে ৩০-৪০ উইকেট করে নিচ্ছেন এমন বিরল ঘটনাও তাই ঘটা শুরু করল। সময়কাল কিন্তু বেশিদিন আগের নয়। সেটা আশির দশকের প্রথম ভাগ।

     

     

     

     

    ইমরান খানের হাত ধরেই পুরনো বলে পেসারদের দোর্দন্ড প্রতাপের সূচনা। সেটা পূর্ণতা পেল ওয়াসিম আকরাম আর ওয়াকার ইউনিসের হাত ধরে। ১৯৯২ বিশ্বকাপের ফাইনালের কথাই ধরুন না। অ্যালান লাম্ব আকরামের সুইংয়ে বোল্ড হয়ে হতভম্ব হয়ে স্ট্যাম্পের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এরপর ক্রিস লুইস, অসামান্য গতি আর তীক্ষ্ণ সুইং এ দোমনা হয়ে যিনি হলেন প্লেড অন। ৩৫ তম ওভারের শেষ দুই বলে ওয়াসিম আকরামের এই অসাধারণ দুটি বলই ইতিহাসে তাঁর নাম অক্ষয় করে দিল। ইমরান খান পেলেন গ্রেট হিসেবে পূর্ণতা। পাকিস্তান ঘরে ফিরল বিশ্বকাপ হাতে নিয়ে, মেলবোর্নের ৮৭০০০ দর্শককে সাক্ষী রেখে!

     

    পুরনো বলের এই আনঅর্থোডক্স বা অস্বাভাবিক সুইংয়ের নামই হচ্ছে 'রিভার্স সুইং'। সরফরাজ নেওয়াজকে এর স্রষ্টার অভিধা দেয়া হলেও খোদ পাকিস্তানেই এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক আছে! পাকিস্তানের অনেকেই বিশ্বাস করেন, রিভার্স সুইং এর উদ্ভাবক লাহোর জিমখানা ক্লাবের ফারাখ খানের। পঞ্চাশের দশকে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলা এই ফারাখ খানই তরুণ সরফরাজকে এই মারণাস্ত্রটির কৌশল শিখিয়েছিলেন বলে মনে করে হয়।ফারাখ খানের আলাদা পরিচয়ও আছে; তিনি ইমরান খান এবং মাজিদ খানের জ্ঞাতি ভাই এবং ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন ডাক্তার। ঐ যুগে পাকিস্তানের টেস্ট খেলার সুযোগ অনেক সীমিত ছিল বলে তিনি আর ক্রিকেট খেলায় মনোযোগী হন নি।

     

    ফারাখ খান পরবর্তীতে টেলিগ্রাফকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, রিভার্স সুইংয়ের কৌশলটিও তাঁর স্বকীয় নয়। ১৯৫৯ সালে ‘পাকিস্তান ঈগলেট দল’ এর হয়ে ইংল্যান্ড সফরের সময় তিনি সর্বপ্রথম এই কৌশলের খোঁজ পান। ইংল্যান্ড এবং সারের সাবেক পেসার অ্যালফ গোভার তাঁকে এই কৌশলের কথা বলেছিলেন। সাথে এটাও বলেছিলেন বল যত পুরনো আর একপাশ খসখসে হবে ততই এই সুইং কার্যকর হবে। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার পিচে যেহেতু বল সহজে নষ্ট হয়না তাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি রিভার্স সুইংয়ে বল করেননি। স্বাভাবিক আউটসুইঙ্গারেই তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন।

     

     

    তবে একথা অনস্বীকার্য, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রিভার্স সুইং এর প্রথম প্রদর্শন সরফরাজ নেওয়াজের হাত ধরে। ১৭ বছরের তরুণ নেওয়াজকে লাহোরের জিমখানা মাঠের নেটে হাতে ধরে ফারাখ খান এই কৌশল শিখিয়েছেন। অবশ্য নেওয়াজের নিজস্ব কিছু পরিবর্ধনও সেখানে ছিল। পরবর্তীতে এই গোপন কৌশলটি পরিণত হল উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির মতো। ইমরান খানের দুর্দান্ত প্রয়োগের পর যেটাকে আরো শাণিত করেছেন ওয়াসিম এবং ওয়াকার।

     

    কেমন ছিল রিভার্স সুইং এর প্রথম দিনগুলো? পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড যখন নাকানি-চুবানি খাচ্ছিল, বরাবরের মতোই ইংলিশ মিডিয়া এটাকে ক্রিকেটীয় চেতনার পরিপন্থী প্রমাণে ব্যস্ত ছিল। ‘পাকিস্তানিরা বল টেম্পারিং করে রিভার্স সুইং করছে, এজন্যেই এই কৌশল ফাঁস করছে না’ এমন শিশুতোষ অভিযোগও বাদ থাকেনি! যাই হোক, ইমরান খানের বোলিং অবশ্য এজন্যে থেমে থাকেনি। পরিসংখ্যানগুলোই তার উপযুক্ত প্রমাণ।

     

    রিভার্স সুইংয়ের সবচাইতে বড় সুবিধা হচ্ছে, পিচ করার পর বলটি রিভার্স সুইং করবে কিনা এটা বোলার নিজেও বলতে পারেন না! সাধারণ আউটসুইঙ্গারের মতো একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যান রিভার্স সুইংয়ের ক্ষেত্রেও বলের ‘শাইনি’ পাশটাকে ভিতরের দিকে দেখেন। কিন্তু বলটি পিচ করার পর সেটি বেরিয়ে না গিয়ে ইনসুইঙ্গার হয়ে যায়। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, নতুন বলে আউটসুইঙ্গার করার সময় একজন বোলারকে গতি এবং সুইংয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হয়। গতি বাড়ালে অনেক সময়ই সুইং করেনা। কিন্তু রিভার্স সুইং এর পূর্বশর্তই হচ্ছে প্রচন্ড গতি আর ফুল লেংথ পিচিং; ব্যাটসম্যানের এলবিডব্লিউ অথবা বোল্ড হবার প্রবণতা একারণেই এই বলে বেশি।

     

    এছাড়াও এখানে গোটা দলেরও বিশাল ভূমিকা থাকে। প্রত্যেক ফিল্ডারকে বলের যত্ন নিতে হয়। বলের একপাশ যতটুকু সম্ভব খসখসে, আর ‘শাইনি’ পাশটাকে ঘাম অথবা থুতু দিয়ে যতটুকু সম্ভব ভারি এবং চকচকে রাখতে হয়। প্রচন্ড গতিতে যখন এই বল বোলারের হাত দিয়ে বেরোয় এবং মোটামুটি ফুল লেংথে পিচ করে তখন ভরের অসমতার কারণে সাধারণ সুইং বলের মতো বেরিয়ে না গিয়ে এটি উল্টো ব্যাটসম্যানের দিকে বাঁক নেয়। একটি আদর্শ রিভার্স সুইং বলে এজন্যেই ব্যাটসম্যানের কিছুই করার থাকেনা! বোলারের উইকেট প্রাপ্তির সম্ভাবনাও তাই অনেক অনেক বেশি থাকে।

     

    ১৯৯৬ এর পর অবশ্য রিভার্স সুইং আর পাকিস্তানের একক সম্পত্তি থাকেনি। এখনতো নতুন প্রজন্মের পাকিস্তানি বোলারদের মধ্যেই রিভার্স সুইং করতে পারেন এমন কেউ তেমন নেই। ফর্ম বিচারে এ প্রজন্মের সেরা রিভার্স সুইঙ্গার হিসেবে অবশ্যই জেমস অ্যান্ডারসন এবং ডেল স্টেইনের নাম আসবে। রিভার্স সুইং করতে পারেন বলেই তাঁরা র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ বোলার।

     

    বাংলাদেশে রিভার্স সুইঙ্গার কবে আসবে? মোহাম্মদ শরীফকে মনে আছে? উনি কিন্তু পুরনো বলে রিভার্স করাতে পারতেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্যাপক সাফল্য পেলেও, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবশ্য তিনি তেমন কিছু করতে পারেননি।

     

    বর্তমানে রুবেল হোসেন রিভার্স সুইং করান। তবে তাঁর রাউন্ড আর্ম অ্যাকশন রিভার্স সুইং এর জন্যে তেমন উপযোগী নয় বলেই হয়তো ওয়ানডে ক্রিকেটের সাফল্য টেস্টে টেনে নিতে পারছেন না। তাসকিন আহমেদ নিজেই বলেছেন, বল সুইং করানো তাঁর কাজ নয়; তিনি শুধু সঠিক লাইন লেংথে জোরে বল করে যেতে পারেন। আমাদের সবেধন নীলমণি তাই মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি সহজাত সুইঙ্গার। ওয়াসিমের মতো তিনিও বামহাতি, সাথে আছে স্লোয়ার-কাটার দেয়ার প্রকৃতিদত্ত প্রতিভা। সঠিক পরিচর্যা পেলে আর কঠোর পরিশ্রম করলে তাঁর সেরা না হবার কোন কারণ নেই। তরুণ এই সেনসেশানের তো কেবলমাত্র শুরু। কাটার-এর পাশাপাশি রিভার্স সুইং আয়ত্ব করে গ্রেটদের কাতারে যেতে পারলে বাংলাদেশের পিচেও পেসার দিয়ে উইকেট বৃষ্টি ঘটানো সম্ভব। এখন এটা হবে কিনা সেই উত্তর কেবল মহাকালই বলে দিতে পারবে!