• বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ
  • " />

     

    মিরাজ-হেটমায়ার : তখন, এখন

    মিরাজ-হেটমায়ার : তখন, এখন    


    অ্যাকশনটা তার আকার-আকৃতির মতোই সাধারণ। তিনি যেন স্রেফ একজন ছেলে, ক্রিকেটটা যিনি উপভোগ করছেন পুরোদমে। মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরিতে তার সঙ্গে সিজদায় লুটিয়ে পড়া থেকে তাইজুলের গাল টানা- হাবভাবে একজন বালককে খুঁজে পাবেন আপনি। তবে ১৮ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৭ বার ইনিংসে ৫ উইকেট, দুইবার ম্যাচে ১০ উইকেটের পরিসংখ্যান বা বাংলাদেশের হয়ে ম্যাচে সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ড বলবে, তিনি বড় হচ্ছেন। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডকে হারানো সেই পারফরম্যান্স বা ২০১৮-তে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে গুঁড়িয়ে দেওয়া বোলিংয়ের সময়ের মাঝের দুই বছর তাকে আরেকটু পোক্ত করেছে। 

    আরেকজনের ব্যাটিংয়ে একটা বিষয় পরিষ্কার- তিনি আক্রমণ করতে ভালবাসেন। চট্টগ্রামের পর মিরপুর টেস্টে তার পারফরম্যান্সে অন্য কোনও ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যান অনুপ্রাণিত হতে পারলে ফলটা হয়তো ভিন্ন হতো আরেকটু। তার রঙ করা চুল বলে- তিনি এ যুগের। আবার হ্যাট মাথায় ব্যাটিংটা মনে করিয়ে দিতে চায়, তিনি ঐতিহ্য ভালবাসেন। ১০ টেস্টের ক্যারিয়ার হাইলাইটস হতে পারে এই দুই টেস্টে তার ব্যাটিং-ই। টেস্টে ৯৩ রানের ইনিংসটাই সর্বোচ্চ, তবে ওয়ানডেতে ১৭ ম্যাচেই করে ফেলেছেন ৩ সেঞ্চুরি। 

    মেহেদি হাসান মিরাজ ও শিমরন হেটমায়ারের ক্যারিয়ারের গতিপথ এখন পর্যন্ত দুইদিকে বাঁকা। তবে দুজনেরই বয়সটা বাড়ছে। দুজন বালক থেকে হয়ে উঠছেন পুরুষ। দুই দলের জন্য দুজন নিয়ে আছেন রোমাঞ্চকর ভবিষ্যতের অপেক্ষা। 

    মিরাজ-হেটমায়ার একে অপরের প্রতিপক্ষ ছিলেন অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়েও। 

    দুজনই খেলেছেন দুইটি করে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ, সে পর্যায়ে দুজনকেই তাই বলা যায় বেশ ‘অভিজ্ঞ’। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে হুট করেই অধিনায়ক বানানো হয়েছিল আগের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলা হেটমায়ারকে। তখনকার কোচিং প্যানেলের মতে, হেটমায়ারের একটা নিজস্ব স্টাইল আছে অধিনায়কত্বের। মিরাজ আগের বিশ্বকাপের মতোই ছিলেন অধিনায়ক, প্রথমবারের মতো দলকে তুলেছিলেন সেমিফাইনালেও। 

    মিরপুরে সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়ে গেল বাংলাদেশ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের প্রায় ‘দ্বিতীয় সারি’র যুব দলের সঙ্গে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাংলাদেশ তাই সেই সেমিফাইনালে ছিল পরিষ্কার ফেভারিট। তবে যারা এক ম্যাচ পরই হয়ে যাবে টুর্নামেন্ট-চ্যাম্পিয়ন, তাদের কাছে আটকে গেলেন মিরাজরা। ফিফটি করলেন হেটমায়ার। মিরাজ ফিফটি করলেন, ২ উইকেটও নিলেন। তবে পার করাতে পারলেন না দলকে। 

    হেটমায়ারকে তাই মিরাজ চেনেন সেই বয়সভিত্তিক দল থেকেই। সেই সেমিফাইনালের আগে যুব ওয়ানডেতে মিরাজ দুইবার আউট করেছিলেন হেটমায়ারকে। তবে সেটা ভিন্ন পর্যায়, ভিন্ন সময়। তখন হেটমায়ার-মিরাজদের ভিন্ন বয়স। 

    মিরাজের আন্তর্জাতিক অভিষেক হলো হেটমায়ারের ছয় মাস আগে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের দ্বিতীয় টেস্টেই নিলেন ১২ উইকেট। হেটমায়ার টেস্টে প্রথম ফিফটি পেতে লাগালেন ৮ ইনিংস। তবে ওয়ানডেতে তৃতীয় ম্যাচেই করলেন সেঞ্চুরি। 

    আন্তর্জাতিক পর্যায়ের দুজনের দেখা হয়ে গেল বাংলাদেশের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। সে সফরেও টেস্টে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন মিরাজ, তবে ‘ট্রায়াল বাই পেস’-এ বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের আত্মসমর্পণে যেন বিস্মৃত হয়ে গেছে সেটা। হেটমায়ার যেমন ফিরতি সফরে বাংলাদেশের ‘ট্রায়াল বাই স্পিন’-এ দেখলেন সতীর্থদের অসহায়ত্ব। 

    সে সফরে টেস্টে হেটমায়ার ঝড়ো ইনিংস খেললেন, ওয়ানডে সিরিজে সেঞ্চুরি করলেন। হেটমায়ারকে একবারই আউট করতে পারলেন মিরাজ, ৩ ইনিংসের ভেতরে। মিরাজ হয়তো অপেক্ষা করছিলেন, তার সময়টা আসার। 

    ওয়েস্ট ইন্ডিজ এলো। হেটমায়ার এলেন। মিরাজ তাকে আউট করলেন চারবার, চার ইনিংসে। প্রথম টেস্টে তো গুরুত্বপূর্ণ দুই সময়ে। দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে মিরাজের সাত শিকারের একটি হেটমায়ার। দ্বিতীয় ইনিংসের পাঁচটিরও একটি। মিরাজের কাছে বাকিগুলোর তুলনায় এই কাজটা ছিল সহজই, “ওর বিপক্ষে আমি অনেক দিন খেলেছি। দুইটা যুব বিশ্বকাপ খেলেছি, তারপর জাতীয় দলে ঢুকেও খেললাম। ওর সম্পর্কে অনেক কিছুই আমি জানি। কাজেই ওর সময় পরিকল্পনা করা সহজ হয়েছে। এজন্য সাফল্যও এসেছে।” 

    অধিনায়ক সাকিব বলছেন, মিরাজ আটকে থেকেছে ‘সাধারণ বোলিংয়ের’ পরিকল্পনাতেই। প্রথম ইনিংসের বোলিংয়ের জন্য কৃতিত্বটা বেশি দিচ্ছেন তাকে, “অসাধারণ বোলিং করেছে অবশ্যই। প্রথম ইনিংসের বোলিংটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা যেহেতু পাঁচশ রান করেছিলাম, একটা বড় অ্যাডভানটেজ ছিল। আমরা কখনই চিন্তা করিনি এত কম রানে ওদেরকে অল আউট করতে পারবো। ওই বিশ্বাসটা ওর বোলিংয়ের কারণেই এসেছে। প্রথম ইনিংসে সাত উইকেট, ওখানেই আসলে ম্যাচটা সেট করে দিয়েছে।” 

    সেই প্রথম ইনিংসেই হেটমায়ার ফিরতি ক্যাচ দিলেন মিরাজকে। 

    কল্পিত কিছু একটা ভেঙেচূড়ে ফেলতে চাইছিলেন যেন তিনি এরপর। সফট ডিসমিসাল ব্যাটসম্যানদের নিজের ওপর রাগটা বাড়িয়ে দেয় স্বাভাবিকভাবেই। একটা বড় শট খেলার সুযোগ ছিল, হয়তো সুযোগ ছিল বলটাকে আরেকটু কর্তৃত্বের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণের। সেটা যখন হয় না, তখন নিজের ওপর রাগ ওঠাটা স্বাভাবিকই। মিরাজের বলে হেটমায়ারের হলো সেটাই। এটা আরও বেড়ে যায়, যখন আপনার মেজাজটা থাকে আক্রমণাত্মক, সেই সময় শট চেক করতে গিয়ে, বা ‘হাফ-হার্টেড’ শট খেলে নিজের বিপদটা ডেকে আনলে। মিরাজ ফিরতি ক্যাচটা সামনে নীচু হয়ে ধরলেন, বলে একটা চুমু দিয়ে ছুঁড়লেন ওপরের দিকে। হেটমায়ার নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণে আনলেন, ব্যাটটা সজোরে ঘুরিয়ে আনতে চেয়েও থামিয়ে দিলেন। 

    এখন মিরাজের সময়। হেটমায়ারের সময়টাও হয়তো আসবে। গতিপথ বদলে যেতে পারে দুজনের ক্যারিয়ারের, আবার কোথাও গিয়ে হয়তো দেখা হয়ে যাবে। 

    তখন বয়সটা শুধু আরেকটু বাড়বে মিরাজ-হেটমায়ারের। আর বদলাবে মঞ্চটা।