• বিশ্বকাপের ক্ল্যাসিক মুহুর্ত
  • " />

     

    ১৯৯৬ : রাজা আর জাদুকরে লঙ্কান রূপকথা

    ১৯৯৬ : রাজা আর জাদুকরে লঙ্কান রূপকথা    

    শ্রীলঙ্কা ছিল ‘ছোট’ দল। 

    আগের পাঁচ বিশ্বকাপে তারা জিতেছিল চারটি ম্যাচ। ১৯৯৩ সাল থেকে সেই বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগে শীর্ষ ৭ দলের বিপক্ষে তাদের ২৪টি জয়ের বিপরীতে হার ছিল ৩৮টি। ওপেনার হিসেবে সনাথ জয়াসুরিয়ার গড় তখন ২৬-এরও কম, স্ট্রাইক রেট ৭৬-ও হয়নি। মুত্তিয়া মুরালিধরনের গড় শীর্ষ ৭ দলের বিপক্ষে ৩৮, কুমার ধর্মসেনার দেশের মাটিতে গড় ৫৪। 

    পার্ট-টাইমার হিসেবে ব্যাংকে, সেলসম্যান হিসেবে, ইন্সুরেন্সে কাজ করা ক্রিকেটারদের নিয়ে বিশ্বকাপ জেতাটা আর কোনও অধিনায়কের হয়তো দিবা-স্বপ্ন হতে পারে, অর্জুনা রানাতুঙ্গার নয়। ‘ছোট’ দলের ‘বড়’ নেতা ছিলেন তিনি। ছিল আত্মবিশ্বাস। ছিলেন সিংহ-হৃদয়। ঘন জঙলে কান পেতে তিনি যেন শুনেছিলেন- তাদেরকে কেউ আটকাতে পারবে না সেবার। তার শোনা সেই দৈববাণী রুপ নিয়েছিল বাস্তবে। তিনি পেয়েছিলেন একজন ডি সিলভাকে। 

    পর্তুগীজদের এই ‘সারনেম’ ডি সিলভার অর্থ- বন, জঙ্গল বা অরণ্য থেকে উঠে আসা কেউ। ক্রিকইনফোতে ডি সিলভা সার্চ করলে এমনকি আপনি অস্ট্রিয়া-ইতালিরও ক্রিকেটার পাবেন। আর শ্রীলঙ্কা অংশে এলে শেষ হবে না ডি সিলভার তালিকাটা। তবে সবার চেয়ে একজন আলাদা- অরবিন্দ। 

    ১৯৯৬ বিশ্বকাপে রানাতুঙ্গা ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা রাজা। ৫ ফুট সাড়ে ৩ ইঞ্চি উচ্চতার ডি সিলভা ছিলেন তার রাজকীয় জাদুকর। 

     

     

    ****

     

    বিশ্বকাপের আগেও শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটাররা পেশাদার ছিলেন না সে অর্থে। বোর্ডের অবস্থা আরও বাজে, কোনও সফরের আগে স্পন্সরদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো বোর্ড কর্তাদের। বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে মুরালিধরন শুনলেন তিনি 'চাকার', শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটাররা শিকার হলেন অস্ট্রেলিয়ানদের বিভৎস স্লেজিংয়ের। তবে সে সফরই গড়ে দিল শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপ জয়ের ভিত। 

    সেবার শ্রীলঙ্কার পাওয়ার কথা ছিল এক লাখ অস্ট্রেলিয়ান ডলার। তবে তাদের দুর্দশা দেখে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড সে অঙ্কটা দ্বিগুণ করে দিল। আর শ্রীলঙ্কার বোর্ড প্রেসিডেন্টকে বলা হয়েছিল, বাড়তি টাকাটা দিয়ে যাতে কোচ ডেভ হোয়াটমোরকে আনেন তারা। নিউ সাউথ ওয়েলসের ফান্ডিংয়ে আনা হয়েছিল ফিজিওথেরাপিস্ট অ্যালেক্স কোউনটরিসকে। হোয়াটমোর শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে আনলেন ‘মেথড’ আর ‘পদ্ধতি’। কোউন্টরিস বদলে দিলেন ক্রিকেটারদের ফিটনেস। বিশ্বকাপে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতেন তিনি, ফিট করতেন ক্রিকেটারদের।

    রানাতুঙ্গা পেয়ে গেলেন ‘সেট-আপ’। 



    তবে মাঠের ক্রিকেটে ঠিক স্বস্তিতে থাকতে পারলেন না তারা শুরুতে। কলম্বো কাঁপছিল সন্ত্রাসী হামলায়। বিশ্বকাপ খেলতে সেখানে গেল না অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। নিজেদের কাজটা করে রাখলো শ্রীলঙ্কা। ভারতের বিপক্ষে জয়ের পর কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা নিশ্চিত হয়েছিল তাদের, ক্যান্ডিতে কদিন আগেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৯৩ রানে আটকে দেওয়া কেনিয়ার বিপক্ষে শ্রীলঙ্কা করলো ৩৯৮, তখনকার ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান, যে রেকর্ড টিকেছিল ১০ বছর। সে ম্যাচ দিয়ে শ্রীলঙ্কা জানলো, তাদের ব্যাটিংয়ের সামর্থ্যটা।

    সে দলে প্রত্যেকের ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন রানাতুঙ্গা। ব্যাটসম্যান, বোলার- সবার। কারও কাজ শুরুতে ঝড় তোলা, কেউ শুধু স্ট্রাইক বদল করে স্ট্রোকমেকারদের দেবেন। কেউ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার চেষ্টা করবেন। বোলাররা আসবেন ক্রমান্বয়ে। কারও কাজ হবে শুধু বলটা পুরোনো করে দেওয়া। 

    তবে ব্যাটসম্যান ডি সিলভাকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন রানাতুঙ্গা। তার কাছে শ্রীলঙ্কা অধিনায়কের একটাই চাওয়া ছিল শুধু, “সেঞ্চুরি করো, ম্যাচ জেতাও।” 

    ডি সিলভা ছিলেন এমনই। 

    ****

    আগে ডি সিলভা ছিলেন অস্থির-প্রকৃতির ব্যাটসম্যান। দারুণ সব শটে ২০-৩০ রান করলেন, এরপরই শুরু হতো পাগলামো। যে বলটা ডিফেন্ড করার কথা, সেটা তিনি পাঠাতে চাইতেন দূর গ্যালাক্সিতে। ডি সিলভা উড়তে জানতেন, শুধু ল্যান্ডিংয়ের ব্যাপারটা জানতেন না যেন। 

    বিশ্বকাপের আগে কেন্টের হয়ে একটা মৌসুম বদলে দিল সব। ডি সিলভা বদলে গিয়ে হয়ে উঠলেন সিরিয়াস। 

    আগেও নিজের খেলা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন, তবে অনেকের মতে ক্যারিয়ারের বেশ কয়েক বছর ওই নতুন জিনিসের চেষ্টাতেই নষ্ট করেছেন তিনি। সে বিশ্বকাপে ডি সিলভা ছিলেন অন্যরকম। যা করতে চান, হয় সেটাই। গ্রুপপর্বে নিজের ব্যাট বদলে নিয়েছিলেন স্বভাববিরুদ্ধ ভারী একটা, শচীন টেন্ডুলকার যেমন ব্যবহার করেন। এরপর শুরু করেছিলেন সেটা দিয়ে খেলা। যেন হুট করে ব্যাট বদলে ফেলা কোনও ব্যাপারই না। 



    এর আগে কোনও দলই ফাইনালে রান তাড়া করে জেতেনি। তবে বোলার আর ব্যাটসম্যানদের ওপর অগাধ ভরসাতেই অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাটিংয়ে পাঠালেন রানাতুঙ্গা। লাহোরের ফাইনালের মঞ্চটা এরপর নিজের করে নিলেন ডি সিলভা। চললো তার ম্যাজিক-শো। 

    মার্ক ওয়াহকে শুরুতেই ফিরিয়েছিলেন চামিন্দা ভাস। মার্ক টেইলর ও রিকি পন্টিংয়ের জুটি এরপর ১০১ রানের। দুজনই ফিরলেন দ্রুত, দুজনই শিকার ডি সিলভার। এরপর মিড-অন থেকে দৌড়ে গিয়ে ধরলেন ক্যাচ, পয়েন্টে আরেকটি। বোলিংয়ে ফিরে যে কোনও স্পিনারের ঈর্ষা করার মতো ডেলিভারিতে বোল্ড করলেন ইয়ান হিলিকে। 

    তবে প্রথম ইনিংসে ডি সিলভার ‘শো’-টা ছিল শুধুই ট্রেইলার। 

    ****

    ২৪২ রানতাড়ায় ২৩ রানেই ফিরেছিলেন শ্রীলঙ্কার দুই ওপেনার- জয়াসুরিয়া ও কালুভিতরানা। আশাঙ্কা গুরুসিনহার সঙ্গে যোগ দিলেন ডি সিলভা। দুই নন্দেস্ক্রিপটস সতীর্থ। 

    গুরুসিনহা ছিলেন শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং ভিতের অন্যতম বড় স্তম্ভ। চন্ডিগড়ে একবার শ্রীলঙ্কার ৮২ রানের মধ্যে তিনি করেছিলেন অপরাজিত হাফ সেঞ্চুরি। মেলবোর্নে তার সতীর্থদের ১৪৩ রানের বিপরীতে করেছিলেন ১৪৪। যখন লড়াইয়ে কেউ ছিল না, তিনি বুক চিতিয়ে দিয়েছিলেন। এবার পাশে পেলেন ডি সিলভাকে। আদতে বলা উচিৎ, ডি সিলভা পাশে পেলেন গুরুসিনহাকে। 

    রানতাড়া, বিশ্বকাপ ফাইনাল- ডি সিলভা এরপর অভিধান থেকে মুছে ফেললেন স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলে এমন সব শব্দ। যখন তিনি ব্যাটিং করেন, আপনি শুধু দেখবেন। যেন একটা বুফে ডিনারে গিয়ে সব ডিশ পছন্দ হয়ে গেছে আপনার। স্ট্রেইট ড্রাইভ, ফ্লিক, কাভার ড্রাইভ। কাট। পুল। হুক। ক্রিজের ব্যবহার। ব্যাকলিফট। ডি সিলভা একটা প্যাকেজের নাম। 

    তাকে সেদিন চাপ ছুঁয়ে যায়নি। গুরুসিনহাকেও যায়নি। তবে চাপটা পেয়ে বসেছিল পুস্পকুমারাকে, যিনি ছিলেন দ্বাদশ ব্যক্তি। সেই পুস্পকুমারা, কলম্বোতে যিনি থাকতেন ডি সিলভার বাড়িতে। তখনও শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটাররা ঠিক পেশাদার হয়ে ওঠেননি। কলম্বোতে এসে এমনকি থাকার জায়গাও ছিল না তাদের। জয়াসুরিয়া থাকতেন রানাতুঙ্গার বাসায়। ডি সিলভা আশ্রয় দিয়েছিলেন রবিন্দ্র পুস্পকুমারাকে। 

    ড্রিংকস ব্রেকে একগাদা বার্তা পাঠানো হলো শ্রীলঙ্কার ড্রেসিংরুম থেকে। ‘ডি সিলভাকে এইটা করতে বলো, সেটা না করো’। ‘গুরাকে বলো ফাস্ট বোলারদের যেন তাড়া না করে’। সেসব হয়তো তিনি পৌঁছে দিতে পারতেন, হোয়াটমোরের সামনে পড়ে গুবলেট পাকিয়ে গেল সব। বিশাল এক বার্তা পাঠালেন কোচ। পুস্পর তখন ইংরেজির ওপর দখল নেই তেমন। মাঠে এসে কে কী বলতে বলেছেন, ভুলে গেলেন সব। স্রেফ বলে উঠলেন, ‘আইয়া, ওয়েল প্লেইড।’ 

    পুস্পর ব্যর্থতায় কিছু যায় আসেনি। জয় থেকে ৯৪ রান দূরে ফিরলেন গুরুসিনহা। জাদুকরের সঙ্গে যোগ দিলেন তার রাজা। 

    সে রাজা সেই বিশ্বকাপে ছিলেন নির্ভার। এমনই যে, ফিল্ডিং থেকে ফিরে যখন শ্রীলঙ্কান ওপেনাররা মাঠে যেতেন ব্যাটিংয়ে, রানাতুঙ্গা তার কাপড়-চোপড় খুলে সাদা তোয়ালেটা চাপিয়ে দিতেন ঘুম। ২ উইকেট যাওয়ার পর উঠে প্রস্তুত হতেন ব্যাটিংয়ে নামতে। ফাইনালেও হয়তো সেটাই করেছিলেন। নামলেন। গলার লকেটটা বারবার ঠিক করলেন। শেন ওয়ার্নে ফুলটসে ছয় মারলেন। ওপাশে ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডসের পর তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে সেঞ্চুরি করলেন ডি সিলভা। ৬ ম্যাচে ডি সিলভার স্কোর হলো এমন- ৯১ (৮৬), ৮ (১৪), ১৪৫ (১১৫), ৩১ (৩০), ৬৬ (৪৭), ১০৭* (১২৪)। 

    গ্লেন ম্যাকগ্রার করা ৪৭তম ওভারের দ্বিতীয় বলটা থার্ডম্যানে গ্লাইড করলেন রানাতুঙ্গা। বল বাউন্ডারি পৌঁছানোর আগেই তুলে নিলেন দুটি স্টাম্প। বলটা চার হবে, সেটা তো নিশ্চিত। বিশ্বকাপ জিতবেন, সেটাই আগে থেকে জানতেন যেন তিনি, আর এটা তো একটা বাউন্ডারি। ওপাশে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন ডি সিলভাকে। শ্রীলঙ্কার রাজা। শ্রীলঙ্কার জাদুকর। 

    শ্রীলঙ্কা এরপর থেকে হয়ে উঠলো ‘বড়’ দল। 

    এরপর কী ঘটেছিল- 
    ১৯৯৯ বিশ্বকাপেও শ্রীলঙ্কার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রানাতুঙ্গা। সেবার গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল তার আগের আসরের চ্যাম্পিয়নরা, ওয়ানডেকে সে টুর্নামেন্ট দিয়েই বিদায় বলেছিলেন রানাতুঙ্গা। পরে বাবার পথ ধরে রাজনীতিতে এসেছেন, হয়েছেন মন্ত্রী। ২০০৩ সালে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল দিয়ে বিদায় বলেছিলেন ডি সিলভা, পরে হয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার জাতীয় ক্রিকেট নির্বাচক। 

    ‘৯৬-রূপকথার সবচেয়ে কাছাকাছি এরপর দুবার গিয়েছিল শ্রীলঙ্কা- ২০০৭ ও ২০১১ সালে পরপর দুইবার ফাইনাল খেলেছিল তারা।