• বিশ্বকাপের ক্ল্যাসিক মুহুর্ত
  • " />

     

    ১৯৯৯ : ক্ষ্যাপাটে দৌড়, অদ্ভুত সমাপ্তি, অতুলনীয় ম্যাচ

    ১৯৯৯ : ক্ষ্যাপাটে দৌড়, অদ্ভুত সমাপ্তি, অতুলনীয় ম্যাচ    

    এর আগেও বিশ্বকাপে একবার দেখা হয়েছিল দুদলের। সেখানে হার্শেল গিবসের অদ্ভুত মিস আর স্টিভ ওয়াহর না বলা কথা হয়ে গেছে ক্রিকেট লোকগাঁথার অংশ। চারদিন পর এজবাস্টনে সেমিফাইনালে আবার মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এবার যা হলো, তা ছাড়িয়ে গেল যেন সবকিছুকে। শেন ওয়ার্ন থেকে শুরু করে অ্যালান ডোনাল্ড, ড্যামিয়েল ফ্লেমিং থেকে শুরু করে ল্যান্স ক্লুজনার- সবাই ঢুকে গেলেন ক্রিকেট-রূপকথার এক ম্যাচে। বিশ্বকাপের এখন পর্যন্ত সেরা ম্যাচ বললে আপনি কি আপত্তি করবেন? 


    অননুমেয় অস্ট্রেলিয়া!

    শুরু হয়েছিল মার্ক ওয়াহর 'ডাক' দিয়ে। রিকি পন্টিং-অ্যাডাম গিলক্রিস্টের জুটি ভাঙ্গলো, ওই ওভারেই ফিরে গেলেন লেম্যান। স্টিভ ওয়াহ হাল ধরলেন মাইকেল বেভানকে নিয়ে, ৯০ রানের জুটিটা ভাঙ্গলো ওয়াহর আউটেই। ওই ওভারেই আবার আউট হলেন টম মুডি। ৫৪ রানে ১ উইকেট থেকে ৫৮ রানে ৪ উইকেট, ১৫৮ রানে ৪ উইকেট থেকে ১৫৮ রানেই ৬ উইকেট। শেষ আঘাতটা তো আরও প্রবল, ২০৭ রানে ৬ উইকেট থেকে ২১৩ রানেই অলআউট। ডোনাল্ড-পোলকের জোড়া ধাক্কার ভীড়ে একটা উইকেট গেল ক্যালিসের ভাগে।

     

    ওয়ার্ন ম্যাজিক

    অস্ট্রেলিয়া হাপিত্যেশ করছে উইকেটের জন্য। ৬ চারে হার্শেল গিবস করেছেন ৩০ রান। শেন ওয়ার্ন, ওভার দ্য উইকেট। লেগস্ট্যাম্পের বাইরে ড্রিফট করা বল, গিবস খেলেন ধোঁকা। টার্ন করে ঢুকলো অফস্ট্যাম্পের শীর্ষ বরাবর! হতভম্ব গিবস ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, যেন বুঝে উঠতেই পারেননি, হলোটা কী!

    পরের ওভারে বোকা বনলেন গ্যারি কারস্টেন। স্লগ করতে গেলেন, বল গেল ব্যাটের বেশ নীচ দিয়ে। যথারীতি টার্ন, তার আগে ড্রিফট, কারস্টেনেরও নেই অফস্ট্যাম্প। এরপর হ্যান্সি ক্রনিয়ের পালা। ফুললেংথ, ঘুরিয়ে খেলতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ। ক্রনিয়েও অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ, গিবসের মতোই। রিপ্লে দেখাচ্ছিল, ব্যাট নয়, বল ছুঁয়ে গেছে ক্রনিয়ের বুট! তাতে কি আর ওয়ার্ন-জাদুর মাহাত্ম্যটা কমে! ওয়ার্ন করলেন ৮ বল, রান দিলেন না, উইকেট নিলেন ৩টি। 

     

     

    নিজের শেষ ওভারের প্রথম ৪ বলে এসেছিল ১৪ রান। ওয়ার্ন এরপরই ফ্লাইটের ধোঁকায় ফেললেন ক্যালিসকে। টানা তৃতীয় ফিফটি করা ক্যালিস শুধু ক্যাচটাই দিলেন স্টিভ ওয়াহকে।

     

    রান-আউট অভিশাপ?

    ৩০ বল, ৬ রান। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে এমন ব্যাটিংয়ের স্মৃতি রাখতে চান কজন? কালিনানের এমন স্মৃতি আছে। ইনিংসের শেষটাও হয়েছিল হতাশাজনকভাবেই। ক্যালিস খেলেছিলেন মিড-অফে, সিঙ্গেলটা কেন নিতে গিয়েছিলেন দুজন মিলে, কে জানে! বেভান ভুল করেননি, সরাসরি থ্রোতে স্টাম্প ভেঙে ‘মুক্তি’ দিয়েছিলেন কালিনানকে! ৪৮ থেকে ৬১ রানে যেতেই ৪ উইকেট নেই দক্ষিণ আফ্রিকার! কিন্তু তা ছিল রান-আউট আর তার সম্ভাবনার ‘শুরু’ মাত্র!  

    ক্যালিস-রোডস, দুজনই রানআউট হতে পারতেন। হতে পারতেন শন পোলকও। রান-আউট যেন সেদিন অন্যরকম একটা ইঙ্গিতই দিচ্ছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে।

     

    রাইফেল-হিরো-ভিলেন

    স্টিভ এলওর্দি রান-আউট হলেন পল রাইফেলের করা থ্রোতে। সে থ্রো আবার গ্লেন ম্যাকগ্রার হাতে লেগে দিক পরিবর্তন করে লাগলো স্টাম্পে! শেষ ব্যাটসম্যান ডোনাল্ড এলেন হাসি হাসি মুখে। দরকার ৮ বলে ১৬ রান। ম্যাকগ্রার ফুলটসটা ঠিক মনমতো খেলতে পারলেন না ক্লুজনার, ক্যাচ গেল লন-অনে, সেই রাইফেলের কাছেই। করলেন মিস, হাত গলিয়ে শুধু বেড়িয়ে গেল না বল, হলো ৬! খানিক আগে তার ভাল ফিল্ডিংটা বিফলে গেল কিনা, সেটা নিয়ে ক্ষণিকের টেনশনে ভুগেছিলেন হয়তো। তবে খানিক বাদের টেনশনের বর্ণনাটা দিতে পারবেন তিনিই!  



    ওভার নাম্বার ৫০!

    ৬ বল, ৯ রান। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় ব্যাটিংয়ে। উইকেট একটি। প্রস্তুত মঞ্চ, প্রস্তুত রোমাঞ্চ দেখার অপেক্ষা। তবে পরের চার বলে যা হলো, তাতে রোমাঞ্চ খুঁজবেন, নাকি ট্র্যাজেডি দেখবেন, নাকি পাবেন কমেডির স্বাদ, তার ভার নিতে হবে আপনাকেই।

    ড্যামিয়েন ফ্লেমিংয়ের ফুললেংথের প্রথম বলে ক্লুজনারের ব্যাটটা চললো বিদ্যুতগতিতে, টাইমিংটা হলো অসাধারণ। কাভার দিয়ে চার। চার বছর আগে সেমিফাইনালে শেষ ওভারেও প্রথম বলেই রিচি রিচার্ডসনের ব্যাটে চার খেয়েছিলেন ফ্লেমিং, ফিরে আসছিল কি সে স্মৃতিটাই! পরের বল, আবার চার, এবার ওয়াইডিশ লং অফ দিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও বিশ্বকাপ ফাইনালের মাঝে ব্যবধান এক রান! তবে ক্লুজনার বা ডোনাল্ড নাকি জানতেন না তখনও, আম্পায়ারের কাছে শুনে নিয়েছিলেন স্কোর। কে জানে, স্কোর শোনাটাই চাপ হয়ে গেল কিনা। ফ্লেমিং রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে এলেন ওভার দ্য উইকেটে। পরের বলে না হলো টাইমিং, না হলো জায়গামতো খেলা, বল গেল মিড-অনে। এর মাঝেই ডোনাল্ড কেন বেড়িয়ে গেলেন ক্রিজ ছেড়ে, কে জানে! ওই চাপ? লেম্যান সরাসরি থ্রোটা লাগাতে পারলেন না, লাগালে ডোনাল্ডের হাসিমুখটা বিষাদে ভরে যেত তখনোই!

    পরের বলটা ক্লুজনার ঠিকমতো খেলতে পারলেন না, শুধু পড়িমড়ি করে ছুটলেন। ডোনাল্ড দাঁড়িয়ে থাকলেন প্রায় ওখানেই। প্রথমে নিজের ক্রিজের দিকে ঘুরলেন, ব্যাট পড়ে গেল হাত থেকে। ক্লুজনার, ডোনাল্ড- দুজনই দাঁড়িয়ে একই প্রান্তে! মিড-অফের ফিল্ডার দিলেন ফ্লেমিংকে, ফ্লেমিং আন্ডারআর্ম বোলিংয়ের মতো করে দিলেন গিলক্রিস্টকে। ডোনাল্ড নিয়মরক্ষার জন্য যেন একটু দৌড়ালেন, হাল ছেড়ে দিতে হলো মাঝপথেই। ক্লুজনার দৌড়েই চলেছেন, পেরিয়ে গেছেন ক্রিজ। একবার পেছন ঘুরে তাকালেন, দৌড় থামালেন। হাঁটা দিলেন। ওপাশে অস্ট্রেলিয়া মেতেছে বুনো উল্লাসে, সুপার সিক্সে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে হেড-টু-হেডে জিতে তাদেরকে টপকে ফাইনালের জায়গাটা যে অস্ট্রেলিয়ারই।

    এজবাস্টনের মাঠভর্তি দর্শক, এক নিরাপত্তাকর্মী তাদের কবল থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলেছেন ক্লুজনারকে। কিন্তু সে ম্যাচের স্মৃতিটা যদি এখনও তাড়া করে ফেরে ‘জুলু’কে, তার কবল থেকে তাঁকে রক্ষা করে কে!

    ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ম্যাচের অংশ হওয়ার স্মৃতিটাই হয়তো প্রলেপ দেয়।

    এরপর কী ঘটেছিল- 

    ফাইনালে পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ১৯৯২ এর পর আবার সেমিফাইনালে আটকে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০১৫ সাল পর্যন্ত সে বাধা টপকানো হয়নি তাদের। হয়তো এ ম্যাচ দিয়েই তাদের গায়ে লেপ্টে গিয়েছিল 'চোকার' ট্যাগ।

     

    *১৭ জুন, ২০১৬ প্রথম প্রকাশিত