কাতারকে হারিয়ে কোপার কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা
কাতারকে অকাতরে হারানো হয়নি, তবুও ২-০ গোলের জয় আর্জেন্টিনার। ম্যাচশেষের বাঁশির পরও অবশ্য স্বস্তি পাওয়া হয়নি আর্জেন্টাইনদের। অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও কিছুক্ষণ। সালভাদর থেকে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে কলম্বিয়ার ১-০ গোলের জয় নিশ্চিত হওয়ার পর গলা থেকে কাঁটা নেমেছে লিওনেল স্কালোনির। ৩৬ বছর পর কোপা আমেরিকার গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিতে হয়নি তার দলের। গত বিশ্বকাপেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পরের রাউন্ডে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। কোপা আমেরিকাতেও তাই বি গ্রুপে এক হার, এক ড্র, এক জয় নিয়ে আগের দুইবারের রানার্স আপ আর্জেন্টিনা উঠেছে কোপার কোয়ার্টার ফাইনালে। আর পুরো ৯ পয়েন্ট নিয়ে কলম্বিয়া হয়েছে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন।
কোয়ার্টার ফাইনালে মেসিদের প্রতিপক্ষ ভেনেজুয়েলা। তাদের বিপক্ষে সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য রেকর্ড মোটেই ভালো নয় আর্জেন্টাইনদের। শেষ তিন ম্যাচে ভেনেজুয়েলাকে হারাতে পারেনি তারা। এর মধ্যে মার্চে প্রীতি ম্যাচে এই ভেনেজুয়েলার কাছেই ৩-১ গোলে হেরেছিল আর্জেন্টিনা।
কাতারের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার পারফরম্যান্সকে উন্নতি বলতে পারেন আগের দুই ম্যাচ থেকে। কিন্তু প্রতিপক্ষ যে কাতার, সেটাই হয়ত আবার তৃপ্তিটুকু নিমিষেই মিলিয়ে দিতে পারে আর্জেন্টাইনদের। এশিয়ার চ্যাম্পিয়নদেরকে হারাতে আর্জেন্টিনাকে প্রায় পুরোটা সময় ঘাম ঝরাতে হয়েছে। পাহাড়সমান চাপে থাকা আর্জেন্টিনাকে অবশ্য শুরুতেই স্বস্তি দিয়েছিল কাতার ডিফেন্ডাররা। থ্রি ম্যান ব্যাকলাইনে নিচে থেকে বিল্ড আপ করে খেলার চেষ্টা করছিল তারা। ৩ মিনিটে লাউতারো মার্টিনেজকে ডিবক্সের ভেতর বল উপহার দিলেও, মার্টিনেজ প্রথম সুযোগে বল মেরেছিলেন ওপর দিয়ে। কিন্তু মিনিট খানেক পরই আবার একই রকম ভুল করে বসলেন আরেকজন, এবার বেসাম হিশাম। ডিবক্সের ভেতর থেকে ডায়াগোনাল বল মারতে গিয়েছিলেন তিনি, মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মার্টিনেজ। সহজ বল লুফে নিয়ে এরপর আরেক ডিফেন্ডারের চাপ উপেক্ষা করে বাম পায়ের ফিনিশে গোল করে ৪ মিনিটে আর্জেন্টিনা এগিয়ে নেন ২১ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড।
কাতারের বিপক্ষে ম্যাচে আরও একবার একাদশে পরিবর্তন এনেছিলেন স্কালোনি। সার্জিও আগুয়েরো ফিরেছিলেন আক্রমণে। মার্টিনেজ-আগুয়েরো-মেসিকে দিয়ে যে আর্জেন্টিনার আক্রমণে ধার বাড়ে সেটার প্রমাণ পাওয়া গেল আরেকবার। আর্জেন্টিনার সেরা পারফরমারও ছিলেন আগুয়েরো। অবশ্য দুই অর্ধেই একাধিকবার সহজ সুযোগ নষ্ট করেছেন। এরপর ম্যাচ শেষের ৭ মিনিট আগে গোল থেকে প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে দৌড়ে ডিবক্সের ভেতর ঢুকে ডানদিক থেকে কোণাকুণি ফিনিশে দারুণ এক গোল করে আগের ভুলগুলোর হতাশা ভোলেন ম্যানচেস্টার সিটি স্ট্রাইকার। ওই গোলে জয় নিশ্চিত হয়ে যায় আর্জেন্টিনারও।
প্রথম আর শেষ গোলের মুহুর্তটা বাদ দিলে মাঠে আরও একবার আর্জেন্টিনা পার করেছে অস্বস্তিকর মুহুর্ত। মাঝে এতোখানিই চাপে পড়ে গিয়েছিল তারা যে রেফারি আর্জেন্টিনা কোচকে হলুদ কার্ডও দেখাতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ কোপা আমেরিকার শত বছরের ইতিহাসে কোচের হলুদ কার্ড দেখার রেকর্ড ছিল না এতোদিন। স্কালোনিই প্রথম! তার অবশ্য মেজাজ হারানোরই কথা। প্রথমার্ধেই খেলাটা শেষ করে দিতে পারত আর্জেন্টিনা। ২২ মিনিটে লিওনেল মেসির পাস থেকে আগুয়েরো সবকিছু ঠিকঠাক করেও মেরেছেন বাইরে দিয়ে। নিকোলাস অটামেন্ডি একবার সহজ হেড মেরেছেন উড়িয়ে। আরেকবার নিজের হেড কাতার গোলরক্ষক সাদ শিবের হাত ফস্কে বেরিয়ে আসার পরও দ্বিতীয় দফায় পাওয়া সুযোগ পেয়ে হেলায় হারিয়েছেন মার্টিনেজ। আর্জেন্টিনার এসব ভুলের শাস্তি হতে পারত প্রথমার্ধেই। ইনজুরি সময়ে সেই বেসামই শাপমোচন করে ফেলেছিলেন প্রায়। গোলরক্ষক আর্মানি হার মেনেছিলেন, কিন্তু তার নেওয়া ফ্রি কিক বারপোস্ট বাধা ফাঁকি দিতে পারেনি।
ম্যাচে ওটাই কাতারের সেরা সুযোগ হয়ে থেকেছে। কিন্তু এর বাইরেও তারা বেশ কয়েকবার ত্রাস ছড়িয়েছে আর্জেন্টিনার রক্ষণে। টটেনহাম হটস্পারের হুয়ান ফয়েথ নেমেছিলেন এদিন একাদশে। তবে অভিজ্ঞ নিকোলাস অটামেন্ডিই ছিলেন বেশি নড়বড়ে। দুই অর্ধে অন্তত দুইবার আর্জেন্টিনাকে বিপদে ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। প্রথমার্ধে নিকোলাস টালিয়াফিকো সময়মতো ব্লক করে একবার গোলবঞ্চিত করেন পেদ্রো মিগুয়েলকে। আরেকবার অধিনায়ক হাইদোস আর আকরাম মিলে ডানদিক থেকে আসা ক্রসে পা ছোঁয়াতে ব্যর্থ হন। নইলে প্রথমার্ধে ম্যাচের গল্পটা অন্যরকমও বানিয়ে ফেলতে পারত কাতার।
দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য কাতারকে আর সেভাবে আক্রমণে ওঠার সুযোগ আর্জেন্টিনা দেয়নি। অটামেন্ডির এক ভুল থেকে আকরাম একটা সুযোগ পেয়েছিলেন। কর্নারের বিনিময়ে সে দফায় পার পেয়ে যায় আর্জেন্টিনা। এছাড়া পুরোটা সময়ই রক্ষণে কাতারকে ব্যস্ত রেখেছিলেন আগুয়েরো। ৬০-৬২ মিনিটের মধ্যে তিনবার দারুণ তিনটি সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। প্রথমবার মেসি পাস ধরে এগিয়ে গিয়ে ডিফেন্ডারের কাছে হার মেনেছেন গোলের সামনে গিয়ে, পরের বার তার শট গোলরক্ষক ঠেকিয়ে দিয়েছেন কর্নার থেকে। তৃতীয়বার মেরেছেন বাইরে দিয়ে।
দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য সেরা সুযোগটা পেয়েছিলেন মেসিই। ৭৩ মিনিটে স্পটকিক নেওয়ার কাছাকাছি জায়গায় বল পেয়েছিলেন। এমন জায়গা থেকে মেসি সাধারণত মিস করেন না। কিন্তু তিনিও যে ভুল করেন সেটাই বুঝিয়ে দিলেন আরেকবার। বাম পায়ে শট করতে গিয়ে বল উঠে গেল আকাশে। ম্যাচের পরদিন ৩২ বছর বয়সে পা দেবেন মেসি, জন্মদিনটা তাই উদযাপন করার উপলক্ষ্য তখন পাননি মেসি। তাতে আক্ষেপও আরেকটু বেড়েছিল আর্জেন্টিনার।
স্কালোনির প্রথম বদলি মার্কোস আকুনিয়ার তাই অবদান রাখা হয়নি ম্যাচে। আকুনিয়াই ডিবক্সের ভেতর থেকে লে অফটা করেছিলেন মেসিকে। তবে ৭৬ মিনিটে মার্টিনেজের জায়গায় নামা পাউলো দিবালা অবদান রেখেছেন আগুয়েরোর গোলে। তার পাস ধরেই এগিয়ে গিয়েছিলেন আগুয়েরো। এরপর বাকি সময়ে জার্মান পেতজেলাকে নামিয়ে রক্ষণে আরও মনোযোগ দেয় আর্জেন্টিনা। আর কাতারের জন্য সেখান থেকে ফেরাও ছিল প্রায় অসম্ভব।
শেষ পর্যন্ত তাই আরও একবার পরের রাউন্ডে লা আলবিসেলস্তেরা। নিজের সেরা হয়ত খেলতে পারেননি, কিন্তু জন্মদিনটা তাই এবার উদযাপন করতেই পারেন মেসি।
আর্জেন্টিনা একাদশ
আর্মানি, সারাভিয়া, ফয়েথ, অটামেন্ডি, টালিয়াফিকো, পারেদেস, লো সেলসো, রদ্রিগো ডি পল, মেসি, মার্টিনেজ, আগুয়েরো