• আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্ট
  • " />

     

    'ডানহাতি-বাঁহাতি কম্বিনেশন' ও সাকিবের 'অন্যরকম' পরিকল্পনা

    'ডানহাতি-বাঁহাতি কম্বিনেশন' ও সাকিবের 'অন্যরকম' পরিকল্পনা    

    টেস্ট ক্রিকেটের বয়স হয়ে গেছে ১৪২ বছরের কাছাকাছি। এর মধ্যে কত কিছু পরিবর্তন এসেছে, আধুনিক যুগে সাদা পোশাক বাদ দিলে বদলে গেছে কত কিছু। পুরনো ধ্যানধারণাও বদলে গেছে অনেক কিছু, তবে বদলায়নি বাংলাদেশ দলের মান্ধাতা আমলের ভাবনা। বাঁহাতিরা ডানহাতিদের বল করতে পারে না বা উল্টোটা হতে পারে না, সেটা একরকম প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে বাংলাদেশ দল। এবার ডানহাতির সঙ্গে একজন বাঁহাতিকেই বল করতে হবে, এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে ব্যাটিং অর্ডার নামের জিনিসটারও শ্রাদ্ধ করে ছেড়েছে বাংলাদেশ দল।

     

     

    অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশ দলের টপ অর্ডার বাঁহাতি নির্ভর ছিল। তামিম-ইমরুল দীর্ঘদিন ওপেন করেছেন এক সঙ্গে, কখনো সেখানে জায়গা নিয়েছেন সৌম্য। তিনে মুমিনুলের নামাটাও বেশ কিছুদিন ধরে নিয়মিত ব্যাপার। কিন্তু আফগানিস্তানের বিপক্ষে এই টেস্টে হঠাৎ করে বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিল, সবকিছু ওলটপালট করা হবে। এমন অনেক ব্যাপার হলো, আগে যা কখনো হয়নি। প্রথম ইনিংসের কথাই ধরুন, লিটন আগে ওপেন করেছেন, মিডল অর্ডারেও নেমেছেন। কিন্তু ডানহাতি বাঁহাতির জন্য প্রথম ইনিংসে টেস্টে প্রথমবারের মতো উঠে এলেন তিনে। মুমিনুলকে নামতে হলো চারে, সেটাও না হয় মানা গেল। কিন্তু মুশফিক আবার নেমে গেলেন ছয়ে। সেদিন সাকিবকে প্রশ্ন করা হয়েছিল এই ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে।  তার ব্যাখ্যা ছিল এরকম, ‘আসলে ওই সময় আমরা একজন ডানহাতি বাঁহাতি রাখতে চেয়েছিলাম। সেজন্যই লিটনকে তিনে নিয়ে আসা হয়। আর ও স্পিন ভালো খেলে। আর এমন নয়, যে মুমিনুল চারে খেলেনি। আর লিটন নবীকে ভালোও খেলছিল। ওই পরিকল্পনায় আমরা সফলও ছিলাম। নবী ভাই অবশ্যই বাঁহাতিদের জন্য বেশি কার্যকরী।  যদিও টেস্ট ক্রিকেটে সেরকম ডানহাতি বাঁহাতি করা কঠিন, তারপরও আমরা চেষ্টা করেছি যতক্ষণ এটা করা যায়।’

     

     

    কিন্তু আজ যেটা হলো, সেটার ব্যাখ্যা কী? সৌম্যকে সরিয়ে ওপেনে নিয়ে আসা হলো লিটনকে। অথচ গত বছর জিম্বাবুয়ে সিরিজে ওপেনিংয়ে নেমে ব্যর্থ হওয়ার পর এক্রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছিল, লিটনকে দিয়ে টেস্টে অন্তত নতুন বলে খেলানো যাবে না। কয়েকটা টেস্ট যেতে না যেতেই সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলো টিম ম্যানেজমেন্ট, দৃশ্যত ডানহাতি বাঁহাতি কম্বিনেশনের অদ্ভুত যুক্তিতে। সবচেয়ে বড় চমকটা এলো তিনে। মোসাদ্দেক টেস্ট ক্যারিয়ারে সাতের ওপর কখনো ব্যাট না করলেও আজ চলে এলেন তিনে। এমনকি ঘরোয়া লিগেও যখন ফর্মে ছিলেন, সর্বোচ্চ চারেই ব্যাট করতেন। অথচ সাদমানের সঙ্গে ডানহাতি হিসেবে আট থেকে এক লাফে তিনে চলে এলেন। এরপর চারে মুশফিক নামলেন, সেটাও সেই ডানবাঁহাতির জন্য। বেচারা মুমিনুলকে তাই বাধ্য হয়ে নামতে হলো পাঁচে, ৩৭ টেস্টের ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো এই অভিজ্ঞতা হলো তার। এত কিছু করেও অবশ্য কোনো লাভ হয়নি। নতুন ব্যাটিং অর্ডারে মানিয়ে নিতে পারেননি কেউই। মোসাদ্দেক তিনে নেমে অবিশ্বাস্যরকম এক আত্মঘাতী এক শটে আউট হয়ে জানান দিয়েছেন, এই পজিশনে ব্যাট করার মতো মানসিক স্থিতি ছিল না তার। পাঁচে নেমে মুমিনুল টেকেননি বেশিক্ষণ।

    আজ চতুর্থ দিন শেষে সাকিব যখন সংবাদ সম্মেলনে এলেন, স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল বাংলাদেশ অধিনায়ককে। সাকিবের নিজের যুক্তিটা এরকম, ‘চারশো চেজ করতে গেলে আপনাকে অন্য কিছু করতে হবে। আমরা তো কখনো চারশো চেজ করিনি। যদি দুইশো চেজ করতাম আমাদের ব্যাটিং অর্ডার ওরকমই থাকত। যেহেতু চারশো চেজ করছিলাম আমাদের কিছু প্রস্তুতির দরকার ছিল। আমরা প্রথম ইনিংসে তো খেলেছি দুইশোই করেছি। এখান এর থেকে আর কতইবা খারাপ হতে পারে। ভালো করার ইচ্ছাতেই পরিকল্পনাগুলো করা হয়। যখন পরিকল্পনা কাজে আসে তখন বলা ওয়াও কি প্লান ছিল। যখন কাজে আসে না তখন মনে হয় প্লানিং ভুল ছিল।’

    পরে অবশ্য এই পরিকল্পনাটা আরেকটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিলেন, ‘‘জিনিসটা যেটা ছিল ওদের একটা পেস বোলার। আর নবী এক পাশ থেকে বল করবে। পেস বোলার হয়ত হোল্ড করবে চার-পাঁচ ওভার রান না দিয়ে, বল পুরনো করার জন্য। ডান-বাম হওয়াতে একটা জিনিস ভাল যে নবি দেখেন প্রথম স্পেলে কোন উইকেট পায়নি। প্রথম ইনিংসে কিন্তু প্রথম স্পেলে উইকেট পেয়েছিল। সাকসেসফুল এখানে হইনি কারণ যাদের বড় ইনিংস খেলার কথা ছিল তারা খেলতে পারেনি। পরিকল্পনায় খুব যে সমস্যা তা কিন্তু না। একটা প্লেয়ার যেকোনো জায়গায় ব্যাট করতে পারে। আপনি যদি চারশো চেজ করেন, সৌম্য আটে নেমেছে আমি মানলাম। তার তো দ্বিতীয় নতুন বলও খেলা লাগতে পারত, পারত না? সাদমানকেও তো দ্বিতীয় নতুন বল খেলতে হতে পারত। আপনি যদি চারশো চেজ করেন আপনাকে ব্যাট করতে হবে ১৩০ ওভার চোখ বন্ধ করে। ১৩০ ওভার ব্যাট করা চাট্টিখানি কথা না। আমাদের ওই প্লান ছিল সেকেন্ড নিউ বল যখন ওরা ফেস করবে তখন খেলা আমাদের হাতে থাকার মত অবস্থায় থাকবে।’’

    এমনকি সাকিব মোসাদ্দেককে ওপেনিংয়ে খেলাতে চেয়েছিলেন বলে জানিয়ে চমকে দিলেন, ‘আমি তো কালকে এই আলোচনাও করেছি যে দুই ডানহাতি আমি পাঠাব কিনা। আমি মোসাদ্দেককে ওপেন করতে পাঠাতে চেয়েছিলাম। সত্যি কথা, এটা আমি এখন বললাম। সবাই মিলে এই আলোচনার পরে এই প্লান করা হয়েছে যে এভাবে যাই তাহলে আমাদের কাছে একটা সুযোগ আছে। সকাল বেলা টিম মিটিংয়ে ওটা সেট করে আমরা মাঠে এসেছি। ওই বিশ্বাসটা সবার ছিল। এমন না আমি বিশ্বাস করেছি বা কোচ বিশ্বাস করেছে। পুরো পনেরো জন এই বিশ্বাস করেছে। শুধু আমার সিদ্ধান্ত হলে মোসাদ্দেক আর লিটন ওপেন করত। যেহেতু আমার সিদ্ধান্ত পুরো ছিল না সেহেতু সাদমান গিয়েছে।’

    তবে অধিনায়কের কথার পরও প্রশ্ন থেকে যায়। টেস্ট ক্রিকেট এমনিতেও আলাদা মনযোগ আর মানসিক প্রস্তুতি দাবি করে। বিশেষ করে টপ অর্ডারে ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা পারতপক্ষে করতে চায় না কেউই। মারনাস ল্যাবুশেন যেমন স্মিথবিহীন হেডিংলিতে চারে নেমে রান পেলেও পরের টেস্টে এসে স্মিথের জন্য জায়গা ছেড়ে চলে গেছেন তিনে। ডানহাতি বাঁহাতি নিয়ে সেখানে ছিল না আলাদা ভাবনা। তার চেয়েও বড় কথা, আফগানিস্তানেরও এই হাস্যকর পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেওয়ার মতো যথেষ্ট গোলাবারুদ ছিল। রিস্ট স্পিনার জাহির খান যেমন শুরুতে দুই ডানহাতিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। মুশফিককে যথারীতি ফিরিয়েছেন রশিদ খান, মুমিনুলকেও তাই। এমন যদি হতো আফগানদের শুধু এক ধরনের স্পিনার আছে তাহলেও সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে তর্ক করা যেত। কিন্তু ডানহাতি বাঁহাতি রিস্ট স্পিনার থেকে ফিঙ্গার স্পিনার, আফগান স্পিনে বৈচিত্র্যের অভাব নেই। তার চেয়েও বড় কথা, দুই টেস্টের অভিজ্ঞতা নিয়ে আসা একটা দলের বিপক্ষে যখন এরকম পরিকল্পনা হয়, একটা দেশের টেস্টমনস্কতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়।

    টেস্টের আগে সংবাদ সম্মেলনে সাকিব আল হাসান বলেছিলেন, নিজেদের শক্তি-দুর্বলতার পাশাপাশি একটা দলের প্রতিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা নিয়েও ভাবা জরুরি। এখন মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ দল পরের ভাবনাটা একটু বেশিই ভেবে ফেলেছে!