বার্সেলোনার ডাগআউটে জাভির থাকা, না থাকা: ভাল না মন্দ?

গত মৌসুমে লিভারপুলের কাছে হেরে আরও একবার চ্যাম্পিয়নস লিগে ব্যর্থতা, এই মৌসুমে ধারাবাহিকতার অভাব- সব মিলিয়ে স্প্যানিশ ম্যানেজারকে চাকরিচ্যুত করার দাবিটা জোরাল হয়েছে আরও। বিইন স্পোর্টস জানিয়েছে, আগামী গ্রীষ্মেই ভালভার্দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করছে বার্সেলোনা। ভালভার্দের জায়গায় আসছেন বার্সেলোনা কিংবদন্তী জাভি হার্নান্দেজ। সুদিন ফেরানোর অপেক্ষায় কাতালানদের জার্সিতে ২৪ বছর কাটানো জাভিতেই ভরসা রাখছে বার্সা। যদিও এসবই গুঞ্জন, কোনো কিছুই এখনও নিশ্চিত করার উপায় নেই। কিন্তু এর পরও বার্সার ডাগ আউটে জাভি আসলে সেটা কতোখানি কার্যকরী হবে সেই বিশ্লেষণ করার চেষ্টা।
যেসব কারণে জাভিতে স্বপ্ন দেখতে পারে বার্সেলোনা
১. দ্য বার্সেলোনা ডিএনএ
মাত্র ১১ বছর বয়সে বার্সেলোনার যুবদলে যোগ দিয়েছিলেন জাভি। হাঁটি হাঁটি পা পা করে বয়সভিত্তিক দলগুলোর শত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সে কাতালানদের জার্সিতে অভিষেক হয়েছিল তার। টানা ১৭ বছর বার্সার খেলে ক্লাব ছেড়েছিলেন তিনি। ক্লাব ছাড়লেও বার্সার সাথে যোগাযোগ অব্যাহত জাভির। ক্লাবের নাড়িনক্ষত্র হাতের তালুর মতই পরিচিত তার।
লা মাসিয়া থেকে মূল একাদশ- বার্সার সবকিছু সম্পর্কে অবগত থাকা এবং ‘দ্য বার্সেলোনা ওয়ে’ মেনে চলাটাই হয়তো জাভির সবচেয়ে বড় ‘প্লাস পয়েন্ট’। সর্বকালের অন্যতম সেরা সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারকে আইডল হিসেবে মানেন বার্সার যুবদলের অনেকেই। তরুণদের সম্পর্কে অবগত হওয়ায় একাদশে আনসুমান ফাতির মত তরুণদের সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে জাভির হাত ধরে।
ভালভার্দের অধীনে তরুণ ফুটবলাররা তেমন সুযোগ পাননি। কিন্তু মেসি, পিকে, ইনিয়েস্তা- বার্সেলোনার প্রায় সব কিংবদন্তীর শুরুটাই হয়েছিল একেবারে কৈশোর থেকে। জাভিকে আনলে তাই নিজেদের সে পরম্পরা ফিরে আসার আশা রাখতেই পারে স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়নরা।
২. গার্দিওলার যোগ্য উত্তরসূরি?
ইয়োহান ক্রুইফের বার্সেলোনার ‘ড্রিম টিম’-এর অন্যতম ভরসা ছিলেন পেপ গার্দিওলা। ক্লাব ছাড়ার পর বার্সার মিডফিল্ডে তার জায়গাতেই এসেছিলেন জাভি। পেশাদারি ক্যারিয়ার শেষে অবশ্য ছাড়িয়ে গেছেন গার্দিওলাকে। নিজস্ব ফুটবল দর্শন, খেলার ধরণ- সবকিছুতে অনেকে গার্দিওলার ছায়া খুঁজে ফেরেন জাভিতে। কোচিং ক্যারিয়ারে এখনও অনভিজ্ঞ জাভিকে ধরা হচ্ছে গার্দিওলার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবেই, যার হাত ধরে আবারও পজেশন ভিত্তিক ফুটবলের স্বর্ণযুগের অপেক্ষায় বার্সেলোনা সমর্থকরা।
আল সাদের ম্যানেজার হওয়ার পর নিজস্ব ফুটবল দর্শন এবং কোচদের মধ্যে আইডল হিসেবে গার্দিওলার কথাই বারবার বলেছেন জাভি। আল সাদের ডাগআউটে তেমন আলো ছড়াতে পারেননি, কিন্তু কাতারী ক্লাবটিকে খেলিয়েছেন পজেশন ভিত্তিক ফুটবল। বার্সেলোনায় বিশ্বমানের সব ফুটবলার পাবেন তিনি, চিরপরিচিত ন্যু ক্যাম্পেই হয়তো দেখা যাবে তার দর্শন শক্তি।
৩. সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা
জীবনের ২৫টি বসন্ত বার্সেলোনায় কাটিয়ে দেওয়ায় জাভির প্রতি বার্সেলোনা ফুটবলারদের শ্রদ্ধা, সম্মান, বা তাকে মেনে চলা নিয়ে ন্যূনতম সন্দেহের অবকাশ নেই। জাভির সাথে অনেকটা রিয়ালের জিদানকে ম্যানেজার হিসেবে আনার সাদৃশ্য খুঁজে পেতে পারেন আপনি। রিয়ালে জিদানের সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল ‘লস ব্লাঙ্কোস’দের হয়ে ‘জিজু’র গ্রহণযোগ্যতা।
জাভির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি একই রকম। তার ওপর বার্সেলোনা একাদশে এখনও খেলে যাচ্ছেন তার দীর্ঘদিনের ৪ সতীর্থ মেসি, পিকে, বুস্কেটস এবং আলবা; যাদের সাথে সেই লা মাসিয়া থেকেই বন্ধুত্ব জাভির। শৈশবের ক্লাবের ম্যানেজার হিসেবে মানিয়ে নিতে মেসি-পিকেদের সাহায্য পাবেন জাভি, সেটা অবশ্য নিশ্চিত। ভালভার্দের রক্ষণাত্মক ট্যাকটিক্স নিয়ে জোরা সমালোচনার পরও তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করে যেতে দিয়েছে বার্সেলোনা বোর্ড।
জাভির ক্ষেত্রেও এদিক দিয়ে অটল থাকবেন জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউরা। এরিক আবিদাল এবং প্যাট্রিক ক্লুইভার্টরা আছেন বার্সেলোনার যুবদলের কোচ হিসেবে। কাতালানদের হয়ে মাঠ কাঁপানো জাভির ম্যানেজার হিসেবে মানিয়ে নিতে তাই হয়তো সমস্যা হবে না তেমন।
যে কারণে জাভিকে আনার জুয়া কাজে দেবে না বার্সেলোনার
১. অভিজ্ঞতার অভাব
মাঠের খেলায় জাভি যতটা অভিজ্ঞ, যত বড় কিংবদন্তী; সে হিসেবে মাঠের বাইরে এখনও ‘তরুণ’-ই বলা চলে জাভিকে। অবশ্য সাবেক স্প্যানিশ মিডফিল্ডারের কোচিং ক্যারিয়ারের বয়স পেরোয়নি এক বছরও। ইউরোপে নিজের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট বার্সেলোনার মত শিরোপাবুভুক্ষু দল হওয়ায় শুরুতেই কিছুটা অপ্রস্তুতও হয়তো হয়ে যেতে পারেন জাভি। সেক্ষেত্রে জাভিকে আনার আবেগ থেকে কঠিন বাস্তবতায় ফিরে আসতে হবে বার্সেলোনাকে।
আল সাদের হয়েও নিজেকে তেমন প্রমাণ করতে পারেননি জাভি। কোচিং ক্যারিয়ার যত ছোটই হোক, অন্তত প্রথম কোচিং অভিজ্ঞতা হিসেবে হয়তো কোনো মতে পাশ মার্কস নিয়ে উতরে যাবেন তিনি।
গার্দিওলার সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল পুরো দল এবং স্কোয়াড সম্পর্কিত সবধরণের কাজে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছিলেন তিনি। জানুয়ারি বা জুন, জাভি যখনই আসুন; তাকে নতুন করে সাফল্যের ছক কষতে হবে কাতালানদের জন্য। অনভিজ্ঞ জাভি এই চাপ নিতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারে আছে জোর সংশয়।
২. আবেগের বশবর্তী হচ্ছে বার্সা?
নিজেদের সর্বকালের অন্যতম সেরাদের একজনকে ম্যানেজার হিসেবে ফেরানোর সিদ্ধান্ত যতটা না বাস্তববাদী, তার চেয়ে হয়তো ঐ ফুটবলারকে ঘিরে আবেগটাই বেশি কাজ করে ক্লাবগুলোর। সেজন্যই সোলশারকে ম্যানেজারের পদে এনে বিপাকে পড়েছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ফিলিপ্পো ইনজাঘি এবং জেনারো গাত্তুসোর ওপর ভরসা রেখেও সুদিন ফেরেনি এসি মিলানের।
বার্সেলোনার অবশ্য নিজেদের সাবেক ফুটবলারদের ডাগআউটে দেখার ঘটনা নতুন নয়। গার্দিওলার মত কাতালানদের হয়ে ফিরেছিলেন লুইস এনরিকে। কিন্তু সিনিয়র দলের ম্যানেজার হওয়ার আগে বার্সেলোনার যুবদলের দায়িত্বে ছিলেন পেপ, এএস রোমাকে কোচিং করানোর পর ন্যু ক্যাম্পে এসেছিলেন এনরিকে।
সেদিক দিয়ে জাভি বেশ খানিকটাই পিছিয়ে। কাতার সুপারলিগের চেয়ে রীতিমত আলোকবর্ষ এগিয়ে থাকা লা লিগায় কোচিং জগতে প্রায় নতুন জাভির ম্যানেজার হয়ে আসাটা বার্সেলোনার জন্য বেশ বড় এক বাজিই বলা চলে।
জিদান, গার্দিওলা, আনচেলত্তি, ক্রুইফরা সফল হলেও জাভির সামনে চ্যালেঞ্জটা পারদসম। বিশেষ করে রনাল্ড কোমানের মত প্রমাণিত ম্যানেজার যখন নিজে বার্সেলোনায় যোগ দিতে আগ্রহী, তখন তার বদলে জাভিকে আনার সিদ্ধান্তকে আবেগের বশবর্তী হওয়ার দিকেই হয়তো ইঙ্গিত করবেন ফুটবল সমর্থকদের সিংহভাগ।
৩. ম্যানেজার বদলেই ভাগ্য বদল?
ম্যানেজার বদলালেই যে ক্লাবের সুদিন ফেরানো যায় না, তার জ্বলন্ত প্রমাণ আর্সেনাল, ইউনাইটেড এবং মিলান। স্পেনে গত দশকে একচেটিয়া রাজত্ব করলেও ইউরোপে বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে বার্সা। এই মৌসুমে এস্পানিওল, লেভান্তের মত দলের মাঠে জিততে পারেনি তারা। প্রতিপক্ষের মাঠে ফুটবলারদের নড়বড়ে পারফরম্যান্স, আত্মবিশ্বাসের অভাবে বার্সেলোনার অন্যতম ধ্রুবক সার্জিও বুস্কেটসে এবং জর্দি আলবার একাদশে জায়গা হারানো, তরুণ উসমান ডেম্বেলের গড়পড়তা পারফরম্যান্সের ফুলঝুড়ি- সব মিলিয়ে দল সাজাতে এবং মেসিদের খেলায় আগের ধার ফিরিয়ে আনতে বার্সার সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। শুধুমাত্র ম্যানেজার বদলেই হয়তো ভাগ্য ফিরবে না তাদের।
কোচিং ক্যারিয়ারে ইউরোপে নিজের প্রথম ক্লাব হিসেবে খুব সম্ভবত এর চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ চাইতে পারতেন না জাভি। বার্সেলোনাকে হাতের তালুর মত চিনলেও ম্যানেজার হিসেবে তার মানিয়ে নেওয়া এবং সাফল্য পেতে তার ওপর আস্থা এবং ধৈর্য ধরতে হবে বার্সেলোনার। এত সমস্যার সম্মুখীন বার্সেলোনাকে ক্যারিয়ারের শুরুতেই কীভাবে গুছিয়ে নেবেন জাভি, সে ব্যাপারে অবশ্য প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।