• লা লিগা
  • " />

     

    কেন একই ধরনের চোটে পড়ছেন রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়রা?

    কেন একই ধরনের চোটে পড়ছেন রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়রা?    

    ১৪ আগস্ট ২০২৪।

    ইউয়েফা সুপার কাপে আটালান্টার মুখোমুখি হওয়ার আগে শেষবারের মতো অনুশীলনে নেমেছে রিয়াল মাদ্রিদ দল। পুরোদমে অনুশীলন চলছে। হঠাৎ শোনা গেল একটা গগণবিদারী চিৎকার। চিৎকারটা এসেছে দলের ফরাসি মিডফিল্ডার এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গার গলা থেকে। 

    সাথে সাথে থেমে গেল অনুশীলন। খেলোয়াড়, কোচ, ফিজিও- সবাই ছুটে এলেন। কামাভিঙ্গা তখনও হাঁটুতে হাত রেখে কাতরাচ্ছেন।

    অনুশীলনে চোটে পড়লেন কামাভিঙ্গা; Image Source: Reuters

    তখনই বোঝা যাচ্ছিল, পরদিন অনুষ্ঠিতব্য সুপার কাপের ম্যাচে নামা হচ্ছে না কামাভিঙ্গার। পরবর্তীতে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে নিশ্চিত হলো, অ্যান্টেরিওর ক্রুশিয়েট লিগামেন্টের (এসিএল) চোটে পড়েছেন তিনি। অন্তত সাত সপ্তাহ মাঠের বাইরে থাকতে হবে তাঁকে।

    লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, কামাভিঙ্গা একা নন, বরং গত এক-দেড় বছরের মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদের আরো বেশ কিছু খেলোয়াড় পড়েছেন এই লিগামেন্টের ইনজুরিতে। গত মৌসুম শুরুর প্রাক্কালে লিগামেন্টের চোটে পড়েছিলেন গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া। এই চোটের কারণে প্রায় পুরো মৌসুমটাই মাঠের বাইরে কাটাতে হয়েছিল তাঁকে।

    একই মৌসুমের প্রথম ম্যাচে অ্যাটলেটিক বিলবাওয়ের বিপক্ষে অ্যাওয়ে ম্যাচে ২-০ ব্যবধানে জিতেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। ওই ম্যাচে লিগামেন্টের চোটে পড়ে মৌসুমটাই শেষ হয়ে যেতে বসেছিল সেন্টারব্যাক এডার মিলিতাওয়ের। গত ডিসেম্বরে ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে লিগামেন্টের চোটে পড়েছিলেন আরেক সেন্টারব্যাক ডেভিড আলাবাও। কোর্তোয়া-মিলিতাও ইতোমধ্যে মাঠে ফিরলেও এখনো ফেরা হয়নি তাঁর। অক্টোবরে ম্যাচ ফিটনেস অর্জন করার কথা শোনা গেলেও সময়টা পেছাতে পারে আরো।

    গত মৌসুমের শুরুতে লিগামেন্টের চোটে পড়েছিলেন মিলিতাও; Image Source: Getty Images

    এখানেই শেষ নয়। কামাভিঙ্গার ওই চোটের মাত্র পাঁচদিন আগেই লিগামেন্টের চোটে পড়েছেন সদ্য সতেরো পূর্ণ করা সেন্টারব্যাক হোয়ান মার্তিনেজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেবলই প্রি-সিজন সম্পন্ন করেছিলেন তিনি, হয়তো মূল দলে জায়গা করে নেওয়ার স্বপ্নও দেখছিলেন।

    এর আগে, ওই প্রি-সিজনেই এসি মিলানের বিপক্ষের ম্যাচে লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায় উনিশ বছর বয়সী মিডফিল্ডার সেজার পালাসিওসের। গত জুলাইয়ে রিয়াল মাদ্রিদের দ্বিতীয় দল কাস্তিয়ার মিডফিল্ডার দানি মেসোনেরোও একই চোটে পড়েন।

    সব মিলিয়ে গত এক বছরে অন্তত ছয়বার লিগামেন্টের চোটে পড়েছেন দলের খেলোয়াড়রা। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়রাই কেন বারবার এই চোটে পড়ছেন?

    ক্লাবের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু সূত্র থেকে জানা যায়, অতীতে মাদ্রিদের খেলোয়াড়দের এই ধরনের চোটের পেছনে কিছুটা হলেও দায় দেওয়া হতো ভালদেবেবাস ট্রেনিং গ্রাউন্ডের। নব্বইয়ের দশকে একটা তত্ত্ব প্রচলিত ছিল, খেলোয়াড়দের বুটের নন-সিলিন্ড্রিকাল স্টাডগুলো মাঠের ঘাসে আটকে যেত। ফলে অনুশীলন বা ম্যাচের সময়ে দ্রুত ঘুরতে গিয়ে লিগামেন্টে চোট পেতেন খেলোয়াড়রা। 

    অনেকের মতে, বর্তমানের মাঠগুলোও অনেক ক্ষেত্রে এই ধরনের সমস্যা তৈরি করছে। টার্ফে খেলোয়াড়দের বুট আটকে যাওয়ায়, দৌড়ের দিক পরিবর্তনের সময়ে চোটের শঙ্কা ও পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। মাদ্রিদের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, একেক ক্লাবের হোম ভেন্যুতে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মাঠের ব্যবহারের ফলেও বেড়েছে চোটের পরিমাণ। চলমান মৌসুমের প্রথম ম্যাচে মায়োর্কার মাঠে ১-১ ড্র করে রিয়াল মাদ্রিদ, আর সেই মাঠের সাথে নাকি ভালদেবেবাসের মাঠ বিস্তর পার্থক্য ছিল।

    তবে মাঠের সমস্যাটাই শেষ কথা নয়। পালাসিওস আর মার্তিনেজের চোটের ক্ষেত্রে সূত্রগুলো দায়ী করছে খেলোয়াড়দের শারীরিক সামর্থ্য আর প্রস্তুতির ব্যাপারটা। যুবদল থেকে সরাসরি মূলদলের সাথে অনুশীলন বা ম্যাচ খেলার ক্ষেত্রে যেমন শারীরিক সামর্থ্য বা প্রস্তুতি দরকার হয়, অনেক ক্ষেত্রেই সেটা তাড়াতাড়ি অর্জন করা সম্ভব হয় না খেলোয়াড়দের।

    “আমরা পৃথিবীর অন্য কোনো দলের ব্যাপারে কথা বলছি না। আমরা কথা বলছি রিয়াল মাদ্রিদের মূল দলের ব্যাপারে, এবং এই দলে যারা খেলেন তাঁদের প্রত্যেকেই যেন একেকজন পশু,” একটি সূত্র জানায়, “ম্যাচের ফলাফলে অন্য কোন দল আমাদের হারাতেই পারে, কিন্তু শারীরিক সক্ষমতায় কখনোই নয়।”

    Image Source: Getty Images

    তবে এই চোটের সংখ্যা কমানোর জন্য ক্লাবের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিটি খেলোয়াড়ের শরীরে পেশির পরিমাণের ভারসাম্য পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে, কেননা যেকোন ধরনের ‘ইমব্যালান্স’ খেলোয়াড়দের লিগামেন্ট এবং টেনডন ইনজুরির কারণ হতে পারে।

    একই সাথে খেলোয়াড়দের পুষ্টির ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হচ্ছে ক্লাবকে। খেলোয়াড়দের নিয়ন্ত্রিত খাবার গ্রহণ, কোলাজেন এবং অন্যান্য সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ ইত্যাদি ব্যাপারও বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে মাদ্রিদ। খেলোয়াড়দেরকে চোট থেকে রক্ষা করতে এবং দেহের সঠিক বৃদ্ধির জন্য খাবারের ঠিক কোন কোন উপাদানগুলো বেশি প্রয়োজন, সেগুলো নিয়েও কাজ চলছে। যেমন, হাড়গুলোর সংযোগস্থানকে মজবুত করে বিধায় কোলাজেন সাপ্লিমেন্টকে মাদ্রিদে বেশ গুরুত্বে চোখে দেখা হচ্ছে। লিগামেন্টের ক্ষেত্রে কোলাজেন মূলত লুব্রিকেন্ট হিসেবে কাজ করে, এবং কোন একটি অংশের ওপর চাপ কমিয়ে চোটের শঙ্কা কমাতে সাহায্য করে।

    চোটের শঙ্কা কমানোর জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম আর ঘুমের ব্যাপারটাও বেশ জরুরী। রিয়াল মাদ্রিদের মতো দলে পুরো মৌসুম জুড়েই ব্যস্ততা থাকে, ফলে খেলোয়াড়দের পর্যাপ্ত বিশ্রাম পাওয়াটা কঠিন। তবুও খেলোয়াড়দের ম্যাচ, অনুশীলন এবং ভ্রমণের সময় সমন্বয় করে যথেষ্ট বিশ্রাম দেওয়ার কাজটা করছেন কোচিং স্টাফরা। পাশাপাশি রাতে সাত থেকে নয় ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করার জন্যও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তাঁদের।

    তবুও যদি কোনো খেলোয়াড় লিগামেন্টের চোটে পড়েন, সেক্ষেত্রে মাদ্রিদ সাধারণত একজন এক্সটার্নাল বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডাক্তার ম্যানুয়েল লেয়েসই এই দায়িত্ব পালন করেন। স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের অলিম্পিয়া মেডিকেল-সার্জিক্যাল সেন্টারের অর্থোপেডিক সার্জারি অ্যান্ড ট্রমাটোলজি সার্ভিসের প্রধান তিনি।

    সাধারণত যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যায় যে চোট পাওয়ার ঠিক কতদিন পর অস্ত্রোপচারের টেবিলে যেতে হবে চোটগ্রস্ত খেলোয়াড়কে। অস্ত্রোপচারের পর ক্লাবের ফিজিওথেরাপি ডিপার্টমেন্ট কাজ শুরু করে। মোটামুটি প্রথম চার মাস এই ডিপার্টমেন্টের অধীনেই রিহ্যাবের কাজ করতে হয় খেলোয়াড়কে। এরপর ধীরে ধীরে রিহ্যাব কোচ এবং ফিজিক্যাল ট্রেনারদের অধীনে তাঁর মাঠে ফেরার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

    আন্তোনিও পিন্টাস; Image Source: Getty Images

    রিহ্যাবের ক্ষেত্রে সাহায্য করার মতো অনেকেই আছেন ক্লাবে। রিয়াল মাদ্রিদের ফিজিক্যাল প্রিপারেশন বিভাগের প্রধান আন্তোনিও পিন্টাস আছেন, ১৯৯৬ সালে তিনি এসিএল চোট থেকে ফিরে আসার ওপরে একটা বই লিখেছিলেন। তাঁর সহকারী হিসেবে জিউসেপ্পে বেলেস্ত্রি, সেবাস্তিয়ান দেভিয়াজ এবং ফিটনেস ট্রেনার হোসে পারালেস আছেন, তাঁরাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে বেশ দক্ষ।

    তবে হ্যাঁ, যত প্রস্তুতি আর সতর্কতাই নেওয়া হোক না কেন, লিগামেন্ট চোটের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা বোধ হয় ‘ভাগ্য’-ই রাখে। অন্যান্য ব্যাপারগুলো চোটের সম্ভাবনা বাড়াতে বা কমাতে পারে, কিন্তু দিনশেষে ভাগ্য পক্ষে না থাকলে বোধ হয় লিগামেন্টের চোট এড়ানো সম্ভব নয়।

    আর রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়দের চেয়ে সেটা ভালো আর কে জানে!