নীল-সাদা থেকে যেভাবে লাল বায়ার্ন আর হলুদ ডর্টমুন্ড। জার্সিকথন। পর্ব ৪
আপনি জানেন কি? বায়ার্ন মিউনিখ আর বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, জার্মান বুন্দেসলীগার এই দুটো বড় ক্লাবেরই ইতিহাসের শুরুটা হয়েছিল নীল-সাদা কিট দিয়ে। অপরদিকে, বেয়ার লেভারকুসেন আর আরবি লাইপজিগ এখনো ধরে রেখেছে নিজেদের প্রথম জার্সির রঙগুলো।
সেই নীল-সাদা কিটটা কেন ছাড়লো বায়ার্ন? কীভাবে হলুদ-কালো কিট হয়ে গেল ডর্টমুন্ডের সমার্থক? কেন লাল-কালো জার্সি বেছে নিলো লেভারকুসেন?
বিশ্বের বিখ্যাত ক্লাবগুলোর জার্সির পেছনের গল্প নিয়ে প্যাভিলিয়নের এই আয়োজন ‘জার্সিকথন’। এই সিরিজের চতুর্থ পর্বে থাকছে জার্মান বুন্দেসলীগার ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ, বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, বেয়ার লেভারকুসেন এবং আরবি লাইপজিগের জার্সির পেছনের গল্পগুলো।
বায়ার্ন মিউনিখ
বায়ার্নের জার্সির ব্যাপারে কথা বলার আগে তাদের প্রতিষ্ঠার গল্পটা একটু বলা দরকার।
১৮৭৯ সালে মিউনিখে প্রতিষ্ঠিত হয় “মুনশ্নার তুরভেইন ১৮৭৯” নামক একটা স্থানীয় জিমন্যাস্টিকস ক্লাব। তখনও জার্মানিতে ফুটবল খেলাটা তত প্রসার লাভ করেনি। তবে ক্লাবের একটা অংশ চাইছিলো ক্লাবের ফুটবল শাখা খুলতে। কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা এই ব্যাপারে একেবারেই আগ্রহ দেখালেন না। এমনই এক অবস্থায়, ১৯০০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ফ্রাঞ্জ জনের নেতৃত্বে এগারোজন বেরিয়ে এলেন পুরোনো ক্লাব থেকে, গঠন করলেন নতুন ক্লাব “এফসি বায়ার্ন মিউনিখ”।
আগেই বলা হয়েছে, শুরুর দিকে বায়ার্ন পরতো নীল-সাদা কিট। সাদামাটা ওই কিটটা ছিল “মুনশ্নার তুরভেইন” ক্লাব থেকে অনুপ্রাণিত, এবং বাভারিয়ার পতাকার আদলে তৈরি।
১৯০৬ সালে বায়ার্ন মিউনিখ যুক্ত হয় মুনশ্নার স্পোর্ট-ক্লাবের সাথে। এর আর জার্সি হিসেবে গ্রহণ করে ওই ক্লাবের লাল-সাদা কিটকেই। মূলত অর্থনৈতিক কারণে ওই ক্লাবের সাথে যুক্ত হওয়া বায়ার্ন চেয়েছিলো মুনশ্নার স্পোর্ট-ক্লাবের অন্যান্য সুবিধাগুলোও গ্রহণ করা। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই চুক্তি বাতিল করা হয়। তবে বায়ার্ন মিউনিখের লাল কিটের যুগ শুরু গেছে ততদিনে, আর সেটা থেকেই আসে দলটির ডাকনাম “ডি রটেন” বা “দ্যা রেডস”।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দলটির কিটে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। লাল-সাদা সাথে নীলের ছোঁয়া দেখা যায় দলটির কিটে। সত্তরের দশকেও বায়ার্নের হোম কিট ছিল লাল-সাদা রঙের। তবে অ্যাওয়ে কিটে নীলের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়। এই যুগেই প্রথমবারের মতো ইউরোপসেরা হওয়ার স্বাদ পায় বায়ার্ন। আশির দশকে থেকে বায়ার্নের জার্সিতে বিভিন্ন ধরনের শেড, স্ট্রাইপ এবং গ্র্যাডিয়েন্ট দেখা যেতে শুরু করে। সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে এখনো। এর বাইরে, বৈচিত্র্য দেখা যায় দলটির অ্যাওয়ে এবং থার্ড কিটেও। এছাড়াও মিউনিখের বার্ষিক উৎসব ‘অক্টোবাফেস্ট’ উপলক্ষ্যে প্রতি মৌসুমে বিশেষ জার্সি তৈরি করে ক্লাবটি।
বরুশিয়া ডর্টমুন্ড
১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ডর্টমুন্ডের শুরুর দিকের জার্সি ছিল নীল-সাদা স্ট্রাইপ আর লাল স্যাশ।
সহজ-সাধারণ এই জার্সিটা চললো চার বছর। ১৯১৩ সালে জার্সির রঙ বদল করে ডর্টমুন্ড। দলটির ক্রমবর্ধমান সমর্থকগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ ছিলেন শহরের শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ। তাঁদেরকে ফুটিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে জার্সির জন্য কালো-হলুদকে বেছে নেয় ডর্টমুন্ড। জার্সির হলুদ রঙটা প্রকাশ করে শহরের স্টিল শিল্পকে, আর কালো রঙটা দিয়ে বোঝায় কয়লা শিল্প। এরপর থেকে এই হলুদ-কালো জার্সিটাই হয়ে ওঠে ডর্টমুন্ডের পরিচয়। এই জার্সির রঙ থেকেই তৈরি হয় ডর্টমুন্ডের হোম ভেন্যু সিগনাল ইদুনা পার্কের বিখ্যাত ‘দ্য ইয়েলো ওয়াল’। এই আইকনিক হলুদ-কালো জার্সির ওপর বিভিন্ন ডিজাইন করেই হোম কিট তৈরি করে তারা।
অ্যাওয়ে এবং থার্ড কিটেও ডর্টমুন্ড পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মূলত ওই হলুদ-কালো রঙের ওপরেই। মাঝেমধ্যে সাদা, ধূসর বা লাল রঙের থার্ড কিট দেখা গেলেও এগুলোর বাইরে অন্যান্য রঙের জার্সি দেখা যায় না বললেই চলে।
বেয়ার লেভারকুসেন
১৯০৪ সালে জার্মান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি বেয়ার এজি এর কিছু ক্রীড়াপ্রেমী কর্মীর আগ্রহ থেকে প্রতিষ্ঠিত হয় বেয়ার লেভারকুসেন ক্লাবটি। শুরুতে শুধু জিমন্যাস্টিকসে গুরুত্ব দিলেও, সদস্যদের আগ্রহের প্রেক্ষিতে তিন বছর পরে ফুটবল শাখা খোলে দলটি। প্রথম থেকেই লাল-কালোই ছিল দলটির জার্সির মূল রঙ। বিভিন্ন সময়ে কালোর সাথে বিভিন্ন শেডের লাল রঙ ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ষাটের দশকে অ্যাওয়ে কিট হিসেবে সাদা রঙের জার্সি পরতে দেখা যায় লেভারকুসেনকে। আশির দশকে তারা হোম কিট হিসেবে লাল-সাদা জার্সি এবং থার্ড কিট হিসেবে নীল জার্সি পরতে শুরু করে। এরপর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে দলটি আবার কালো-লাল জার্সিতে ফিরে আসে। সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে এখনো।
জার্সির লাল রঙটা তুলে ধরে ক্লাবের প্যাশন, এনার্জি, এবং মাঠের হার না মানা মনোভাব। অপরদিকে কালো রঙটা বোঝায় শক্তি, প্রতিরোধ আর ডিটারমিনেশন।
আরবি লাইপজিগ
বায়ার্ন মিউনিখ, বরুশিয়া ডর্টমুন্ড বা বেয়ার লেভারকুসেনের তুলনায় আরবি লাইপজিগ অনেকটাই নবীন ক্লাব। মাত্র ১৬ বছর আগে অস্ট্রিয়ান এনার্জি ড্রিঙ্কস কোম্পানি রেড বুল কিনে নেয় জার্মানির পঞ্চম ডিভিশনের ক্লাব এসএসভি মার্করানস্টাডকে। নতুন করে ক্লাবটির নামকরণ করা হয়, “র্যাসেনবলস্পোর্ট লাইপজিগ” বা সংক্ষেপে আরবি লাইপজিগ।
বলে রাখা ভালো, অস্ট্রিয়ার ‘সালজবুর্গ’ আর মেজর লিগ সকারের ‘নিউ ইয়র্ক মেট্রোস্টার্স’ ক্লাব দুটিও কিনে নিয়েছিল রেড বুল কোম্পানি। এরপর ক্লাব দুটোর নাম বদলে পরিণত হয় ‘আরবি সালজবুর্গ’ এবং ‘নিউ ইয়র্ক রেড বুলস’-এ।
২০০৯ সালে জুন মাসে অফিশিয়ালি লাইসেন্স পায় লাইপজিগ। জার্মানির ফুটবলের পঞ্চম স্তর থেকে যাত্রা শুরু হয় তাদের। এরপর ধীরে ধীরে চতুর্থ, তৃতীয় ও দ্বিতীয় স্তর পেরিয়ে, ২০১৬-১৭ মৌসুমে দলটা জায়গা করে নেয় জার্মান বুন্দেসলীগায়। এখনো লিগ শিরোপা জিততে না পারলেও বুন্দেসলীগায় বেশ ভালো করছে দলটি। ইউরোপের মঞ্চেও নিয়মিত দেখা যাচ্ছে তাদের উপস্থিতি।
শুরু থেকেই রেড বুলের সাদা-লাল রঙটাই মূলত দেখা গেছে লাইপজিগের হোম কিটে। তবে অ্যাওয়ে এবং থার্ড কিটে দেখা গেছে লাল, মেরুন এবং নেভি ব্লু রঙের আধিক্য।
সব মিলিয়ে, প্রায় সব জার্মান ক্লাবের জার্সির রঙের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা ইতিহাস এবং গুরুত্ব আছে। আলিয়াঞ্জ এরেনা থেকে সিগনাল ইদুনা পার্ক, প্রতিটা গ্যালারির অকুণ্ঠ সমর্থনেও এই বিষয়টার ছাপ পাওয়া যায়।