• ক্লাব ফুটবল
  • " />

     

    রিয়াল মাদ্রিদের কেন সাদা জার্সি, বার্সেলোনা কীভাবে মেরুন-নীল?। জার্সিকথন। পর্ব ১

    রিয়াল মাদ্রিদের কেন সাদা জার্সি, বার্সেলোনা কীভাবে মেরুন-নীল?। জার্সিকথন। পর্ব ১    

    রিয়াল মাদ্রিদকে অনেকেই ডাকেন ‘লস ব্লাঙ্কোস’ (দ্য হোয়াইটস) বলে, বার্সাকে ডাকা হয় ‘ব্লাউগ্রানা’ (নীল এবং গাঢ় লাল) নামে। লিভারপুলের সাথে যায় ‘দ্য রেডস’ নামটা, ওদিকে ইন্টার মিলানের ম্যাচে ‘নেরাজ্জুরি’ (নীল-কালো) নামটা শোনা যায় ধারাভাষ্যকারদের মুখে। এমন বড় বড় ক্লাবগুলোকে অনেক ক্ষেত্রেই ডাকা হয় তাদের জার্সির রঙ দিয়ে। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ কেন সাদা রঙকেই বেছে নিলো? বার্সেলোনা কেন হোম জার্সিতে ব্যবহার করে মেরুন-নীল রঙ? লিভারপুলের লাল, কিংবা ইন্টার মিলানের কালো-নীল রঙের জার্সির পেছনের গল্পটাই বা কী?

    বিশ্বের বিখ্যাত ক্লাবগুলোর জার্সির পেছনের গল্প নিয়ে প্যাভিলিয়নের এই আয়োজন ‘জার্সিকথন’। এই সিরিজের প্রথম পর্বে থাকছে দুই স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনার জার্সির পেছনের গল্পগুলো।

    রিয়াল মাদ্রিদের সাদা জার্সির গল্পটা দিয়েই শুরু করা যাক।

    রিয়াল মাদ্রিদ মানেই শ্বেতশুভ্র জার্সি; Image Source: X

    এই সাদা রঙের পেছনে অনেকগুলো তত্ত্ব পাওয়া যায়। প্রচলিত একটা তত্ত্ব অনুসারে, মাদ্রিদের সাদা জার্সিটা ছিল ইংল্যান্ডের অ্যামেচার দল করিন্থিয়ান ফুটবল ক্লাব থেকে অনুপ্রাণিত। ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্লাবটি ছিল তাদের ফেয়ার প্লের জন্য বিখ্যাত। এর বিশ বছর পরে প্রতিষ্ঠিত রিয়াল মাদ্রিদের শুরুর দিকের খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আর্থার জনসন। জন্মসূত্রে জনসন ছিলেন ব্রিটিশ। দ্য ওভালে করিন্থিয়ান এফসিকে সাদা জার্সিতে খেলতে দেখে রিয়াল মাদ্রিদের জন্য এই রঙটা বেছে নেওয়ার আইডিয়া মাথায় আসে তাঁর। 

    আরো একটা তত্ত্ব অনুসারে, ১৯০২ সালে যখন ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বেশিরভাগ দলই সাদা জার্সি পরে খেলতো। রিয়াল মাদ্রিদও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ইংল্যান্ড থেকে আলাদা করে রঙিন জার্সি না এনে বরং সাদা জার্সিতেই অভ্যস্ত হয় দলটি।

    তবে প্রায় ১২২ বছরের ইতিহাসে, মাঝেমধ্যেই নিজেদের কিট নিয়ে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে রিয়াল মাদ্রিদ। ১৯২০-এর দিকে সাদা জার্সির সাথে কালো শর্টস পরতে শুরু করে মাদ্রিদ। যদিও মাদ্রিদের ওই কিটটা তেমন জনপ্রিয় হয়নি। 

    এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সাদা জার্সির সাথে নীল বা কালো মোজাও পরেছে দলটি। 

    সাদা জার্সি আর নীল মোজায় অচেনা মাদ্রিদ; Image Source: Getty Images

    তবে পঞ্চাশের দশকে টানা পাঁচটা ইউরোপিয়ান কাপ জেতার পর থেকে যখন রিয়াল মাদ্রিদের জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, তখন থেকে নিজেদের হোম কিট নিয়ে তেমন এক্সপেরিমেন্ট করেনি ক্লাবটি। 

    এরপর থেকে রিয়াল মাদ্রিদ মানেই পুরো সাদা জার্সি, রিয়াল মাদ্রিদ মানেই লস ব্লাঙ্কোস।

    ১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে কালো রঙের অ্যাওয়ে জার্সি পরে মাঠে নেমেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। স্তাদে দে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ওই ফাইনালে ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে ৩-০ ব্যবধানে জিতেছিল লস ব্লাঙ্কোসরা। ম্যাচ জয়ের পরপরই দলের সব খেলোয়াড়কে ক্লাবের পক্ষ থেকে সাদা জার্সি দেওয়া হয়েছিল। কেননা রিয়াল মাদ্রিদ যখন ট্রফি হাতে উল্লাস করবে, তখন তো পরনে সাদা জার্সি থাকতেই হবে!

    অ্যাওয়ে জার্সির উপরে চেনা সাদা জার্সি পরে শিরোপা হাতে উল্লাস করেছিলো রিয়াল মাদ্রিদ; Image Source: Getty Images

    ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল ২০১৬-১৭ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে। জুভেন্টাসকে ৪-১ ব্যবধানে হারানোর ওই ম্যাচেও অ্যাওয়ে জার্সিতে নেমেছিলেন রোনালদো-রামোসরা। তবে ফাইনালটা জয়ের পরপরই সবাই পরে নিলেন মাদ্রিদের অভিজাত সাদা জার্সিটা। রিয়াল মাদ্রিদের কাছে সাদা জার্সির গুরুত্ব এতখানিই!

    স্বাভাবিকভাবেই মাদ্রিদের প্রায় সব বড় অর্জনের কথা স্মরণ করতে গেলেই এই সাদা জার্সিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফুটবলপ্রেমীদের। হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর অবিশ্বাস্য সব রেকর্ড, রামোস-বেনজেমার নিবেদন কিংবা ভিনিসিয়াস জুনিয়রের উত্থান, সবগুলো ছবিতেই দেখা যায় রিয়াল মাদ্রিদের ওই অল হোয়াইট কিটটা।

    রোনালদোর গায়ে বোধ হয় মাদ্রিদের সাদা জার্সিই সবচেয়ে বেশি মানায়; Image Source: Getty Images

    প্রতি মৌসুমে জার্সির সামনের স্পন্সর এবং ডিজাইনে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়, কিন্তু অ্যাডিডাসের তৈরি করা এই জার্সিতে সাদা রঙের আধিক্যটা থেকে যায় প্রতি বছরই। 

    আর হ্যাঁ, গল্পটা যেহেতু রিয়াল মাদ্রিদের সাদা জার্সি নিয়েই, তাই সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর সেই অমর উক্তিটা স্মরণ করতেই হচ্ছে, “রিয়াল মাদ্রিদের সাদা জার্সিতে কাদা লাগতে পারে, ঘামে ভিজতে পারে, রক্তে রঞ্জিতও হতে পারে, কিন্তু কখনোই লজ্জা আর গ্লানি মিশবে না।”

    ৩৬টা লা লিগা আর ১৫টা ইউসিএল জয়ী দলটার ক্ষেত্রে কথাটা সম্ভবত পুরোপুরি সঠিক।

    বলে রাখা ভালো, ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে, জার্সি, কিট এবং মার্চেন্ডাইজ বিক্রির দিক থেকে ইউরোপের দ্বিতীয় সফলতম ক্লাবের নাম রিয়াল মাদ্রিদ। এই সময়ে মোট ১৫৫ মিলিয়ন ইউরো আয় করে তারা। একই সময়ে, ১৭৯ মিলিয়ন ইউরো আয় করে ওই তালিকায় সবার ওপরের নামটা ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার। 

    বার্সেলোনার মেরুন-নীল জার্সির পেছনের গল্পেই চোখ ফেরানো যাক এবার।

    বার্সেলোনা মানেই মেরুন আর নীল জার্সি; Image Source: FC Barcelona

    কাতালানদের মেরুন-নীলের পেছনেও একটা ছোট্ট গল্প পাওয়া যায়। ক্লাব সূত্র যেমনটা জানাচ্ছে, এই দুই রঙের শুরুটা হয়েছিল ইংল্যান্ডের একটা স্কুলে। কাতালান ক্লাবটার একেবারে শুরুর দিকের দুজন খেলোয়াড় ছিলেন আর্থার এবং আর্নেস্ট উইটি নামক দুই ভাই। দুজনেই পড়ালেখা করেছিলেন লিভারপুলের কাছে ক্রসবির মার্চেন্ট টেইলর্স স্কুলে। ওই স্কুলের রাগবি দলের জার্সির রঙ ছিল অনেকটা মেরুন-নীল ধাঁচের। বলা হয়, যে ওই জার্সি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই বার্সেলোনা দলের প্রথম জার্সির জন্য মেরুন-নীল রঙটা পছন্দ করেছিলেন আর্থার এবং আর্নেস্ট।

    মুখে মেরুন বললেও, খাতাকলমে ওই রঙটার নাম ‘Claret’। 

    মেরুন-নীলের দুটো হাফ ছিল বার্সার প্রথম জার্সিতে; Image Source: FC Barcelona

    প্রথম জার্সিতে অবশ্য দুই হাফে দুই রঙ ছিল। পরবর্তীতে, হাফের পরিবর্তে জার্সি আসে মেরুন-নীলের স্ট্রাইপ। এরপর বিভিন্ন সময়ে এই দুই রঙের হাফ, হুপ এবং চেক দেখা গেছে বার্সার জার্সিতে। ধীরে ধীরে মেরুন-নীল রঙদুটো হয়ে যায় বার্সেলোনার সমার্থক। আর এই দুটো রঙের আধিক্যের কারণেই বার্সাকে ডাকা হয় ‘ব্লাউগ্রানা’ বা ‘আজুলগ্রানা’ হিসেবে।

    আবার ওদিকে কাতালুনিয়ার রাজধানী হিসেবে বার্সেলোনার জার্সিতে বিভিন্ন সময়ে পাওয়া গেছে কাতালান-ছোঁয়াটাও। কাতালুনিয়ার হলুদ-লাল পতাকার আদলে তৈরি জার্সিও বার্সেলোনা গত কয়েক মৌসুম ধরে পরছে নিজেদের ফোর্থ কিট হিসেবে। 

    কাতালুনিয়ার পতাকার আদলে তৈরি বার্সার ফোর্থ কিট; Image Source: Getty Images

    তবে নিজেদের অ্যাওয়ে এবং থার্ড কিটে নিয়মিতই পরীক্ষানিরীক্ষা করে এসেছে বার্সেলোনা। নব্বইয়ের দশকে বার্সেলোনার অ্যাওয়ে জার্সিতে আকাশি ধরনের রঙ “টার্কোয়েস”-ও দেখা যেত। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত নিয়মিত এই জার্সি পরতো বার্সেলোনা। তবে এই শতাব্দীতে মাত্র তিন মৌসুমে ওই জার্সি পরতে দেখা গেছে বার্সাকে।

    Image Source: Getty Images

    এছাড়া ২০০৩ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বার্সেলোনার অ্যাওয়ে জার্সি ছিল হালকা সোনালী বর্ণের। কাতালানদের হয়ে লিওনেল মেসির অভিষেকও হয়েছিল এই জার্সিতেই।

    Image Source: Getty Images

    এর বাইরে গত কয়েক মৌসুমে বার্সাকে অ্যাওয়ে এবং থার্ড কিট হিসেবে সাদা, কালো, সোনালী এবং হালকা সবুজ ধরনের রঙের জার্সিও পরতে দেখা গেছে। 

    এছাড়া ১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে বার্সেলোনা নিজেদের ক্লাবের শততম বার্ষিকী উদযাপন করেছিল মেরুন-নীল রঙের হাফ ডিজাইনের জার্সি দিয়ে। চলতি মৌসুমে, ক্লাবটির ১২৫তম বার্ষিকী উদযাপনের বছরেও একই ধরনের জার্সি পরছে ক্লাবটি।

    এ পর্যায়ে বলে রাখা ভালো, আশির দশক থেকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের জার্সির সামনে স্পন্সরের নাম থাকলেও বার্সেলোনার ক্ষেত্রে এই প্রচলন শুরু হয়েছে প্রায় পঁচিশ বছর পরে। ২০০৫-০৬ মৌসুমেই শেষবারের মতো সামনে স্পন্সরের নামবিহীন জার্সি পরে মাঠে নেমেছিল কাতালানরা। 

    ২০০৫-০৬ মৌসুমের পর সামনে স্পন্সরের লোগোবিহীন জার্সি পরেনি বার্সেলোনা; Image Source: DPA

    এরপর ২০০৬-০৭ মৌসুমে বার্সেলোনা চুক্তি করে ইউনিসেফের সাথে। সেই চুক্তির আওতায় কাতালান ক্লাবটি প্রতি বছর দেড় মিলিয়ন ইউরো প্রদান করে জাতিসংঘের এই অঙ্গসংগঠনকে। পাশাপাশি দলটির জার্সির সামনেও ওঠে ইউনিসেফের লোগো। এই চুক্তির মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর।

    এরপর থেকে কখনো কাতার ফাউন্ডেশন, কখনো কাতার এয়ারওয়েজ, কখনো রাকুটেন, আবার কখনো স্পটিফাইয়ের নাম দেখা গেছে বার্সেলোনার জার্সিতে। স্পটিফাইয়ের সাথে চুক্তির অংশ হিসেবে বার্সেলোনা এখন প্রতি এল ক্লাসিকোতে তাদের জার্সিতে ব্যবহার করছে বিশেষ কোন সঙ্গীতশিল্পী বা ব্যান্ডের লোগো। ড্রেক, রোসালিয়া, দ্য রোলিং স্টোনসের পর সর্বশেষ এল ক্লাসিকোতে বার্সার জার্সিতে দেখা গেছে কোল্ডপ্লের লোগো। 

    এল ক্লাসিকোর 'বিশেষ' জার্সিতে বিশেষ লোগো ব্যবহার করে বার্সা; Image Source: X

    এছাড়া ২০২২ সালে বার্সেলোনার সাথে চুক্তি হয় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক অঙ্গসংগঠন ইউএনএইচসিআর-এর। এই চুক্তির অধীনে এখন দলটির জার্সির পেছনে থাকে ইউএনএইচসিআর-এর লোগো। 

    Image Source: Imago

    তবে স্পন্সর বা জার্সির ডিজাইন যেমনই হোক না কেন, ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা বলতে বোঝায় ওই মেরুন-নীল রঙটাই, ঠিক যেমন ধবধবে সাদা রঙটা মনে করিয়ে দেয় রিয়াল মাদ্রিদকে!