• ক্লাব ফুটবল
  • " />

     

    মিলানের ‘কুরভা সুড’, জুভেন্টাসের ‘ভাইকিং’, ইন্টারের ‘বয়েস-সান’। ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা। পর্ব ৪

    মিলানের ‘কুরভা সুড’, জুভেন্টাসের ‘ভাইকিং’, ইন্টারের ‘বয়েস-সান’। ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা। পর্ব ৪    

    মিলান ডার্বির ওই বিখ্যাত ছবিটা দেখেননি, এমন ফুটবল-দর্শক খুঁজে পাওয়া কঠিন। এসি মিলানের রুই কস্তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন ইন্টার মিলানের মার্কো মাতেরাজ্জি। ছবিটার পটভূমিতে শুধুই দেখা যাচ্ছে মাঠে দর্শকদের ছুঁড়ে দেওয়া ধোঁয়া আর ফ্লেয়ার।

    Image Source: Getty Images

    প্রথম দর্শনে ছবিটাকে মনে হতে পারে নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই মিলানের দুই খেলোয়াড়ের বন্ধুত্বের অসামান্য নিদর্শন হিসেবে। কিন্তু ছবিটার পটভূমিটা জানিয়ে দিচ্ছে, দুই মিলানের দর্শক-সমর্থকদের মধ্যে পাগলামির পরিমাণটাও নিতান্ত কম নয়। শুধু দুই মিলান বললে ভুল হবে, ফুটবল-পাগলামিটা ইতালির প্রায় প্রতিটা ক্লাবের সমর্থকদের মধ্যেই দারুণভাবে বিদ্যমান, প্রায় প্রত্যেকটা ক্লাবেরই রয়েছে একাধিক আল্ট্রাস ফ্যান গ্রুপ। 

    ফুটবলের এমন বিখ্যাত পাগলাটে সমর্থকদলের গল্প নিয়েই প্যাভিলিয়নের এই আয়োজন, “ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা”। এই সিরিজের চতুর্থ পর্বে থাকছে ইতালির ফুটবল ক্লাব, এসি মিলান, জুভেন্টাস আর ইন্টার মিলানের পাগলাটে সমর্থকদলের গল্পগুলো।

    এসি মিলান

    ইউরোপীয় সাফল্যের বিচারে ইতালির শ্রেষ্ঠ ক্লাব এসি মিলান। ইতিহাস ঘেঁটে এই দলটার অন্তত সাতটা আল্ট্রাস ফ্যান গ্রুপের খোঁজ পাওয়া যায়। এগুলো হলো “ফসা দে লেওনি”, “কম্যান্দোস তিগ্রে”, “ব্রিগাতে রসোনেরে”, “অলতারনেতিভা রসোনেরে”, “গেরিয়েরি উলত্রাস কুরভা সুড মিলান”, “আভানগুয়ারদিয়া রসোনেরে” এবং “কুরভা সুড মিলান”।

    কমান্দোস তিগ্রে

    ইতালীয় ভাষায় ‘কমান্দোস তিগ্রে’। ইংরেজিতে বলা যেতে পারে, “টাইগার কম্যান্ডোস”। 

    Image Source: X

    ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটিকে ধরা হয় এসি মিলানের সবচেয়ে পুরোনো আল্ট্রাস ফ্যান গ্রুপ হিসেবে। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এসি মিলানের গ্যালারির উত্তর অংশে নিয়মিত দেখা যেত তাদের। এই গ্রুপটির সবচেয়ে রমরমা সময় এসেছিল আরিগো সাচ্চি আর ফ্যাবিও ক্যাপেলোর অধীনে। সেই সময়ে সদস্যসংখ্যা পৌঁছেছিল ২০০০ পর্যন্ত। ২০১৬ সালে গ্রুপটি ভেঙে যাওয়ার খবর এসেছিল, যদিও গ্রুপের অন্য অংশ সেটা অস্বীকার করে।

    ফসা দে লেওনি 

    ইতালীয় ভাষায় ‘ফসা দে লেওনি’। ইংরেজিতে, ‘লায়ন’স ডেন’। বাংলায় বলা যেতে পারে, ‘সিংহের গুহা’।

    এসি মিলানের এই ফ্যানগ্রুপটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৮ সালে। কাগজে কলমে ‘কমান্দোস তিগ্রে’ সবচেয়ে পুরোনো আল্ট্রাস ফ্যানগ্রুপ হলেও ফসা দে লেওনির অনেক সদস্য নিজেদের দাবি করেন সবচেয়ে পুরোনো সংগঠন হিসেবে। ২০০৫ সালে জুভেন্টাসের আল্ট্রাস ফ্যানগ্রুপ ‘ভাইকিং জুভে’র সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ‘ফসা দে লেওনি’। জুভেন্টাসের বিপক্ষে ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষের আল্ট্রাসদের পতাকা এবং ব্যানার চুরি করেছিলেন মিলান আল্ট্রাসের কিছু সদস্য। প্রতিশোধস্বরূপ, মিলানের পরের ম্যাচর পর সমর্থকেরা বাড়ি ফেরার সময়ে তাদের কাছ থেকে পতাকা ও ব্যানার ছিনিয়ে নেন জুভেন্টাসের আল্ট্রাসরা। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, ২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় ‘ফসা দে লেওনি’কে।

    'ফসা দে লেওনি'-এর হাতে 'ভাইকিং জুভে'-র ব্যানার; Image Source: X

    কুরভা সুড মিলানো

    ইতালীয় কুরভা সুড মিলানোকে বাংলায় বলা যায় দক্ষিণ গ্যালারির ঢেউ।

    Image Source: Getty Images

    ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটাও নিজেদেরকে মিলানের প্রথম আল্ট্রাস গ্রুপ হিসেবে দাবি করেন। এই সংগঠনটা এখন মূলত মিলানের অন্য সব আল্ট্রাসদের ‘মাদার অর্গানাইজেশন’ হিসেবে কাজ করছে। কোরিওগ্রাফির জন্য বিখ্যাত ‘ব্রিগাতে রসোনেরে’, অথবা, ‘গেরিয়েরি উলত্রাস কুরভা সুড মিলান’, এই গ্রুপগুলো এখন চলে এসেছে 'কুরভা সুড মিলানো' নামক এই ছাতার নিচে। মাঠে গিয়ে দলের জন্য গলা ফাটানো, স্লোগান দেওয়া, ব্যানার-টিফো প্রদর্শনে ‘কুরভা সুড মিলানো’র জুড়ি মেলা ভার।

    জুভেন্টাস

    ক্লাবের শেলফে সিরি-আ টাইটেল সংখ্যার হিসাবে জুভেন্টাসই রয়েছে সবার ওপরে। তুরিনের বুড়িদের বিশ্বব্যাপী অফিশিয়াল ফ্যানগ্রুপ একটাই, ‘জুভেন্টাস অফিশিয়াল ফ্যান ক্লাবস’। এর বাইরে জুভেন্টাসের কোন অফিশিয়াল আল্ট্রাস গ্রুপ নেই। তবে এখন অনেকগুলো আনঅফিশিয়াল আল্ট্রাস ফ্যানগ্রুপ রয়েছে জুভেন্টাসের। এর মধ্যে “গ্রুপো স্তোরিকো ফাইটার্স”, “ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফাইটার্স গ্রুপো স্তোরিকো”, “দ্রুঘি” এবং “ভাইকিং জুভে”-এর নাম আসে সবার আগে। জুভেন্টাসের প্রথম আল্ট্রাস ফ্যানগ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হয় সত্তরের দশকে। বামপন্থী সমর্থকদের নিয়ে তৈরি হয় “ভেনসেরেমোস” এবং “আউতোনোমিয়া বিয়ানকোনেরা” নামক দুটি গ্রুপ। তবে সংগঠন হিসেবে দুটো গ্রুপই ছিল ব্যর্থ। খুব দ্রুতই বিলুপ্তি ঘটে তাদের। এরপর ১৯৭৬ সালে জুভেন্টাসের প্রথম আসল আল্ট্রাস গ্রুপ হিসেবে ‘ফসা দে কাম্পিওনি’ এবং ‘প্যান্থারস’ গঠিত হয়।

    ভাইকিং জুভে

    আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভাইকিং জুভে’। তবে অভ্যন্তরীণ সমস্যায় গত শতাব্দীর শেষ দিকে এই আল্ট্রাস গ্রুপটির বিলুপ্তি ঘটে। এরপর ২০০৩ সালে আবারও পুনর্গঠিত হয় তারা। এরপর থেকে নিয়মিতই জুভেন্টাসের স্টেডিয়ামের উত্তর গ্যালারিতে দেখা যেত তাদের। ২০০৫ সালে এসি মিলানের ‘ফসা দে লিওনি’র সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে তারা, সেই ঘটনা তো আগেই বলা হয়েছে। 

    ২০০৬ সালে ক্যালসিওপলি স্ক্যান্ডালের দায়ে সিরি-বিতে অবনমন ঘটে জুভেন্টাসের। তখন অন্য অনেক তারকার মতো তখন ক্লাব ছাড়েন ডিফেন্ডার ফ্যাবিও ক্যানাভারোও। এর তিন বছর পর সেই ক্যানাভারোই যখন ফিরেছিলেন জুভেন্টাসে, ভাইকিং সেটাকে খুব ভালোভাবে নেয়নি। তাই ক্যানাভারোর প্রত্যাবর্তনের পর স্টেডিয়ামে ব্যানার দেখা গিয়েছিল। তাতে লেখা ছিল, “রিয়াল মাদ্রিদ তোমাকে ছুঁড়ে ফেলেছে। নাপোলি তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তোমার লোভই তোমাকে এখানে আবার নিয়ে এসেছে”। ক্যানাভারোর ফেরা উপলক্ষ্যে ভাইকিং বিশেষ টি-শার্টও বের করেছিল। টি-শার্টের সামনের পাশে লেখা ছিল, “ভাড়াটে ক্যানাভারো”, আর পেছনে লেখা ছিল, “বিশ্বাসঘাতকের জন্য কোন ক্ষমা নেই”।

    এরপর সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে জৌলুস হারাতে থাকে ভাইকিং। আগে যেমন এক নামে তাদেরকে পুরো ইতালি চিনতো, যেভাবে পুলিশ এবং অন্য দলের সমর্থকেরা তাদেরকে রীতিমতো ভয় পেত, সেই ব্যাপারটা এখন আর অবশিষ্ট নেই। বর্তমানের ভাইকিং বেঁচে আছে আগের ভাইকিংয়ের কঙ্কাল হয়ে। মাঝেমধ্যে অন্যান্য আল্ট্রাস গ্রুপের সাথে যৌথভাবে বিভিন্ন কাজে অংশ নিতে দেখা যায় তাদের। 

    ইন্টার মিলান

    ইতালির ফুটবলের সর্বকালের সেরা ক্লাব হিসেবে এসি মিলান আর জুভেন্টাসের সাথে উচ্চারিত হয় ইন্টার মিলানের নামও। অন্য দুটো দলের মতো ইন্টার মিলানেরও অনেকগুলো আল্ট্রাস গ্রুপ তৈরি হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে, ‘কুরভা নর্দ’, ‘ইররিদিউসিবিলি’, ‘ইন্টার উলত্রাস’, ‘ব্রায়ানজা আলুলিকা’, ‘মিলানো নেরাজ্জুরা’, ‘স্কুইলিব্রাতি’, ‘বয়েস-সান’, ‘ভাইকিংস’ উল্লেখযোগ্য।

    ২০২২ সালে সবগুলো সংগঠনই চলে আসে ‘কুরভা নর্দ মিলানো ১৯৬৯’-এর ছায়াতলে। তবে একই ছাতার নিচে এলেও প্রত্যেকটা সংগঠনেরই নিজস্ব স্বকীয়তা রয়েছে। আর এদের মধ্যে ‘বয়েস-সান’ এবং ‘ভাইকিংস’-ই সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী।

    ২০০৪-০৫ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল এসি মিলান এবং ইন্টার মিলান। দ্বিতীয় লেগে সানসিরোতে, ম্যাচের ৭০তম মিনিটেই অ্যাগ্রিগেটে ৩-০ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ে কার্যত বিদায় নিশ্চিত হয়ে যায় হোম টিম ইন্টার মিলানের। তখন কুরভা নর্দ থেকে উড়ে আসতে থাকে একের পর এক ফ্লেয়ার। ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে খেলা বন্ধ হয়ে যায়। দুই দলের খেলোয়াড়রা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দেখতে থাকেন এই অভূতপূর্ব দৃশ্য।

    আর কুরভা নর্দ আসলে মাঠে কী করতে পারে, ২০১০ সালে পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনাও সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল। চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালের প্রথম লেগে হোসে মরিনহোর ইন্টার মিলানের বিপক্ষে হারতে হয়েছিল মেসি-জাভিদের বার্সাকে। 

    এই টিফো বানিয়ে বার্সাকে 'স্বাগত' জানিয়েছিল কুরভা নর্দ; Image Source: Getty Images

    এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সিরিআর বিভিন্ন ম্যাচের আগে-পরে প্রতিপক্ষের টিম বাসে হামলা, দর্শকদের আক্রমণসহ নানা অপকর্মের সাথেও জড়িত ছিল ‘কুরভা নর্দ’-এর নাম। ২০১৫ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে জুভেন্টাসের পরাজয়ের পর টিফো তৈরি করে তাদের খোঁচাও মেরেছিল কুরভা নর্দ

    টিফো বানিয়ে জুভেন্টাসকে খোঁচা মেরেছিল কুরভা নর্দ; Image Source: Getty Images

    বয়েস-সান

    ইন্টার মিলানের সবচেয়ে পুরোনো আল্ট্রাস গ্রুপের নাম ‘বয়েস-সান’।

    'বয়েস-সান' শব্দটি মূলত ইতালীয় “বয়েস স্কোয়াদ্রে দাসিওনে নেরাজ্জুরে” থেকে এসেছে, যাকে ইংরেজিতে ‘নেরাজ্জুরে অ্যাকশন টিমস’ বলা যেতে পারে। বলে রাখা ভালো, শুরু থেকে নীল-কালো জার্সি পরার কারণে ইন্টার মিলানের ডাকনাম ‘নেরাজ্জুরি’। 

    ১৯৬৯ সালে বয়েস-সান প্রতিষ্ঠিত হয়।

    ২০০৬-০৭ সালে, ইন্টার মিলানের হয়ে লুইস ফিগোর শেষ হোম ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে একটা পেনাল্টি পেয়েছিল নেরাজ্জুরিরা। মার্কো মাতেরাজ্জি পেনাল্টি স্পটে বল বসিয়ে শট নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এমন সময়ে, ফিগোকে পেনাল্টি নিতে দেওয়ার দাবি জানিয়ে গ্যালারির উত্তর প্রান্ত থেকে স্লোগান শুরু করে বয়েস-সান, আর খুব দ্রুতই সেটা ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্যালারিতে। সেই স্লোগানের শক্তি এতটাই ছিল, যে মাতেরাজ্জি নিজে পেনাল্টি স্পট থেকে সরে গিয়ে ফিগোকে পেনাল্টি নিতে দেন। ফিগোও ঠিকই গোল করেছিলেন পেনাল্টি থেকে। এরপর উত্তর গ্যালারির সামনে উদযাপনে ভেসেছিলেন মুহুর্মুহু করতালি, স্লোগান আর আতশবাজির সাথে।

    খেলোয়াড়দের সাথে ইতালির ক্লাবগুলোর আল্ট্রাসদের সম্পর্ক এমনই নিবিড়। দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে আল্ট্রাসরা যেমন উদযাপনে মেতে ওঠেন প্রিয় দলের ম্যাচডেতে, খেলোয়াড়রাও তেমনি আপন করে নেন এই আল্ট্রাসদের।