রিভারপ্লেট-বোকা জুনিয়র্স: পাগলামি যে সমর্থকদের রক্তে। ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা। পর্ব ৬
সাল ২০১৮।
কোপা লিবের্তাদোরেসের ফাইনালের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হলো আর্জেন্টিনার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব: বোকা জুনিয়র্স আর রিভারপ্লেট। দুই লেগের ফাইনালের প্রথম লেগটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বোকা জুনিয়র্সের মাঠ লা বোম্বোনেরাতে। ২-২ ব্যবধানে ড্র হওয়ার পর সবার নজর ছিল দ্বিতীয় লেগের দিকে। এস্তাদিও মনুমেন্টালে আরো একটা ধুন্ধুমার লড়াইয়ের আশাই করছিলেন সবাই। কিন্তু লড়াইটা যে মাঠের বদলে মাঠের বাইরেই শুরু হবে, সেটা সম্ভবত কেউই ভাবতে পারেননি।
মনুমেন্টালে যাওয়ার পথে রিভারপ্লেট ফ্যানরা আক্রমণ করলেন বোকা জুনিয়র্সের টিম বাসে। তাতে আহত হলেনবোকা জুনিয়র্সের খেলোয়াড়রা। বমি এবং মাথাঘোরার কারণে কার্লোস তেভেজ নাজেহাল হয়ে পড়লেন, চোখে আঘাত পেলেন মিডফিল্ডার পাবলো পেরেজ। আহতই হলেন না, ম্যাচের সময় পেছালো কয়েকবার, আর পরে ভেন্যু পাল্টে ম্যাচটা নিয়ে যাওয়া হলো মাদ্রিদের সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে।
Image Source: AFP
ফুটবলের এমন বিখ্যাত পাগলাটে সমর্থকদলের গল্প নিয়েই প্যাভিলিয়নের এই আয়োজন, “ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা”। এই সিরিজের ষষ্ঠ পর্বে থাকছে রিভারপ্লেট এবং বোকা জুনিয়র্সের সমর্থকদল যথাক্রমে ‘লস বোরাচোস দেল ত্যাবলন’ এবং ‘লা দোসে’-এর গল্পগুলো।
রিভারপ্লেটের ফ্যানদের দিয়েই শুরু করা যাক। স্প্যানিশ “লস বোরাচোস দেল ত্যাবলন” শব্দটাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় 'The drunks of the stands', বাংলায় বলা যেতে পারে 'গ্যালারির মাতালের দল'। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, অন্যান্য আল্ট্রাসদের মতো আগ্রাসী আচরণের সাথে অতিরিক্ত মদ্যপান করাটাও তাদের বৈশিষ্ট্য। আর নামের “ত্যাবলন” অংশটা মূলত বোঝায় দক্ষিণ আমেরিকার স্টেডিয়ামগুলোর কাঠের তৈরি সোপান ধরনের অংশগুলোকে। সাধারণত গ্যালারির এই জায়গাতেই অবস্থান নেন দর্শকদের মধ্যে সবচেয়ে আক্রমণাত্মক অংশটা।
গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে, যখন ফুটবল আল্ট্রাসদের উত্থান ঘটছে পৃথিবীজুড়েই, রিভারপ্লেটের সমর্থকদের একটা অংশ গঠন করে তাদের নিজেদের আল্ট্রাস, “লস বোরাচোস দেল ত্যাবলন”। এরপর আশির দশক আর নব্বই দশকের শুরুর অংশে তারা সদস্য সংখ্যা এবং পরিধিতে বাড়তে থাকে। রিভারপ্লেটের হোম ভেন্যু এস্তাদিও মনুমেন্টালে তাদের উপস্থিতিও নিয়মিত হয়ে ওঠে। শুধু ব্যানার-ফেস্টুন-টিফো, গান-স্লোগান আর ফ্লেয়ারের মাধ্যমে মাঠের প্রতিপক্ষের জন্য কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই নয়, পাশাপাশি গ্যালারিতে সফরকারী দর্শকদের কোণঠাসা করা ফেলাও তাদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে। আর স্টেডিয়ামের বাইরে তাদের আক্রমণাত্মক আচরণের সাক্ষী বুয়েনস এইরেসের অলিগলিগুলোই।
Image Source: Getty Images
পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য আল্ট্রাস গ্রুপগুলোর মতো লস বোরাচোস দেল ত্যাবলনের ইতিহাসের পরতে পরতে মিশে আছে ভায়োলেন্সের গল্প। এই ভায়োলেন্সের শিকার শুধু প্রতিপক্ষ বা রাইভাল দলগুলোই নয়, অনেক ক্ষেত্রে ছিল রিভারপ্লেটের অন্যান্য ফ্যানগ্রুপও। লস বোরাচেস দেল ত্যাবলন পরিধিতে যত বাড়তে থাকে, বিভিন্ন প্রকার অপরাধের সংখ্যাও তত বাড়তে থাকে। নাইন্টিজের পর এই শতাব্দীর শুরুর দশকে এই আল্ট্রাস ফ্যানগ্রুপের সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতার জন্য দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অবৈধ ব্যবসা, টিকেট রিসেলিংসহ নানা রকম ব্যাপারকে কেন্দ্র করে লস বোরাচোস দেল ত্যাবলনের মধ্যে গ্রুপিংও শুরু হয়। এই ব্যাপারগুলো অনেকক্ষেত্রে গড়ায় হাতাহাতি থেকে গোলাগুলি পর্যন্তও।
২০০৭ সালের আগস্টে গুলি লেগে মৃত্যুবরণ করেন গঞ্জালো আক্রো নামক একজন আল্ট্রাস-সদস্য। এই হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে উঠে এসেছিল অভ্যন্তরীণ অবৈধ ব্যবসার মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এই হত্যাকাণ্ডটা আর্জেন্টিনার ফুটবলকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে আল্ট্রাস গ্রুপটির বেশ কিছু সদস্য গ্রেফতার হয়েছিলেন, অনেককে দীর্ঘ সময় ধরে জেল খাটতে হয়েছে। আর এই ঘটনাটা লস বোরাচোস দেল ত্যাবলনের সুখ্যাতিও ধ্বংস করে দিয়েছিল। পরিষ্কার হয়ে যায়, যে রিভারপ্লেটের আল্ট্রাসের উদ্দেশ্য যতটা দলকে সমর্থন করা, তার চেয়েও সম্ভবত অবৈধ অর্থ আর ক্ষমতার লোভ। সংঘর্ষের এই ঘটনাটাই প্রথম বা শেষ নয়।
১৯৯৪ সালে সুপার ক্লাসিকোতে মুখোমুখি হয়েছিল বোকা জুনিয়র্স আর রিভারপ্লেট। বোকা জুনিয়র্সের হোম ভেন্যু লা বোম্বোনেরাতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওই ম্যাচটা। ওই ম্যাচেই, গ্যালারিতে এবং মাঠের বাইরে পুলিশ এবং বোকা জুনিয়র্স সমর্থকদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে রিভারপ্লেটের আল্ট্রাসরা। দুই দলের অনেক সমর্থক আহত হন, আর ম্যাচের পরে বুয়েনস এইরেসের রাস্তাতেও দুই পক্ষের সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। দুইজন রিভারপ্লেট সমর্থকের মৃত্যুর কথাও শোনা যায় এই ঘটনায়।
২০০২ সালে মনুমেন্টালে অনুষ্ঠিত এক ম্যাচে পরাজিত হয় রিভারপ্লেট। প্রিয় দলের পরাজয়ের হতাশা থেকে গ্যালারিতেই পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন রিভারপ্লেটের সমর্থকরা। গ্যালারির সিট থেকে শুরু করে ফ্লেয়ার, পুলিশের দিকে এমন বিভিন্ন জিনিস ছুঁড়তে শুরু করেন তাঁরা। এই সংঘর্ষ চলতে থাকে মাঠের বাইরের রাস্তাগুলোতেও। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে অনেকে আহত হন। অনেককে গ্রেফতারও করা হয়।
২০১৮ সালের কোপা লিবার্তেদোরেসের ফাইনালের ঘটনা তো আগেই বলে হলো। লস বোরাচোস দেল ত্যাবলনের আক্রমণে সেবার আহত হন বোকা জুনিয়র্সের খেলোয়াড়রা। এরপর ফাইনাল ম্যাচটা সরিয়ে নেওয়া হয় মাদ্রিদে, সেখানে ৩-১ ব্যবধানে জেতে রিভারপ্লেট।
এর আগে, ২০১৬ সালে, বোকা জুনিয়র্স আর রিভারপ্লেটে মধ্যকার প্রিসিজন ম্যাচে মাঠে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই দলের খেলোয়াড়রা। মাঠের সংঘর্ষ পৌঁছে যায় গ্যালারিতেও। দুই দলের মোট পাঁচজন খেলোয়াড় লাল কার্ড দেখেন, তাতে ম্যাচটাও পণ্ড হয়ে যায়। ওদিকে মাঠের বাইরে বারবার হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে দুই দলের সমর্থকেরা। সংঘর্ষ থামাতে শেষ পর্যন্ত দাঙ্গা পুলিশকে নিয়োগ করা হয়।
সুপার ক্লাসিকোর ব্যাপারটা এমনই। মাঠে রিভারপ্লেট আর বোকা জুনিয়র্সের খেলোয়াড়রা যেমন তেতে থাকেন, মাঠের বাইরেও যেন বারুদ নিয়ে অপেক্ষা করেন দুই দলের আল্ট্রাসরা। বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুই আল্ট্রাস গ্রুপের উন্মাদনাও চোখে পড়ে।
রিভারপ্লেটের ‘লস বোরাচোস দেল ত্যাবলন’-এর গল্প তো বলা হলোই। এবার বরং বোকা জুনিয়র্সের ‘লা দোসে’-এর গল্পগুলো বলা যাক।
স্প্যানিশ ‘লা দোসে’ শব্দটাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “টুয়েলফথ ম্যান”, আর বাংলায় দ্বাদশ ব্যক্তি। স্বাভাবিকভাবেই, গ্যালারিতে লা দোসের সমর্থনটা বোকা জুনিয়র্সের মাঠের এগারোজনের অবদানের চেয়ে কম জরুরী নয়, তাই নিজেরাই নিজেদেরকে দলের দ্বাদশ খেলোয়াড়ের মর্যাদা দিয়েছেন। বোকা জুনিয়র্স প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে। আর আল্ট্রাস ফ্যানগ্রুপ লা দোসের শুরুটা ছিল ১৯২০ এর দিকে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পেতে কেটে যায় প্রায় পঞ্চাশ বছর।
বোকা জুনিয়র্স যেমন বুয়েনস এইরেসের শ্রমিকশ্রেণীর মানুষের ক্লাব, লা দোসেও তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করে এসেছে সবসময়ে। তাদের শুরুটা হয়েছিল বোকা জুনিয়র্সকে প্রবলভাবে সমর্থনের মধ্য দিয়েই। হোসে বারিতা নামক এক পাগলা সাপোর্টারের নেতৃত্বে বোকার হোম ভেন্যু লা বোম্বোনেরোতে নিয়মিত দেখা মিলতো লা দোসের। হোসে বারিতার ডাক নাম ছিল এল এবুয়েলো বা 'দ্য গ্র্যান্ডফাদার'। তাঁর নেতৃত্বেই লা দোসে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। মাঠে গাওয়া গান, গলা ফাটানো স্লোগান, চ্যান্ট, কিংবা ব্যানার-ফেস্টুন, সবকিছুর মাস্টারমাইন্ড ছিলেন এই হোসে বারিতা। তবে পুরো ব্যাপারটা এতটাও নিষ্পাপ ছিল না। হোসে বারিতার নেতৃত্বে যেমন সংগঠিত হয়েছিলেন লা দোসের সদস্যরা, একই সাথে সংঘবদ্ধভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন বিভিন্ন অপরাধে।
রিভারপ্লেটের লস বোরাচোস দেল ত্যাবলনের মতোই লা দোসের সদস্যরাও জড়িয়ে পড়ে টিকেট কেলেঙ্কারি, চাঁদাবাজি, মাদক পাচার এবং বিক্রি, এবং অন্যান্য অবৈধ কর্মকাণ্ডে। ব্যাপারটা এতটাই বিস্তার লাভ করে যে, বারিতা একটা সময়ে ক্লাবের টিকেটের ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন। ক্লাবের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও নাক গলানো শুরু করেন তাঁরা। আর মাঠে আর মাঠের বাইরের বিভিন্ন ঘটনা তো আছেই।
১৯৯১ সালে, রেসিং ক্লাবের বিপক্ষে একটা অ্যাওয়ে ম্যাচে পরাজয়ের পর মাঠে এবং মাঠের বাইরে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে লা দোসে। পুলিশের সাথে হাতাহাতি ছাড়াও গ্যালারিতে ভাঙচুর করে তারা। সংঘর্ষটা খুব দ্রুত ডালপালা মেলেছিল, আর তাতে আহতের সংখ্যাও হয় অনেক।
২০০৬ সালে লা বোম্বোনেরাতে বোকা জুনিয়র্সের মুখোমুখি হয়েহিল চাচারিতা জুনিয়র্স। হাইভোল্টেজ ওই ম্যাচকে ঘিরে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় বোকা জুনিয়র্সের আল্ট্রাসরা। আবারও সেই চেয়ার ছোঁড়াছুঁড়ি, আবারও মারামারি, আবারও অনেকের আহত হওয়া, আবারও গ্রেফতার।
২০১৫ সালে কোপা লিবার্তেদোরেসের ম্যাচে রিভারপ্লেটের বিপক্ষে লা বোম্বোনেরোতে নেমেছিল বোকা জুনিয়র্স। হাফটাইমের পর দ্বিতীয়ার্ধের খেলার জন্য যখন রিভারপ্লেটের খেলোয়াড়রা ড্রেসিংরুম থেকে মাঠে ফিরছেন, তখন তাঁদের উদ্দেশ্যে পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করেন লা দোসের কিছু সদস্য। পিপার স্প্রের কারণে ওই খেলোয়াড়রা তৎক্ষণাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ম্যাচটাও স্থগিত করা হয় তখনই। পরবর্তীতে কনমেবল বোকা জুনিয়র্সকে ওই টুর্নামেন্ট থেকে ডিসকোয়ালিফাইড ঘোষণা করা হয় এবং রিভারপ্লেটকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। আর এর তিন বছর পরে, কোপা লিবের্তাদোরেসের ফাইনালের ওই ঘটনা তো আগেই বলা হলো।
সব মিলিয়ে, লা দোসে এবং লস বোরাচোস দেল ত্যাবলন, দুই আল্ট্রাসই মাঠে যেমন নিজেদের দলকে সমর্থন জানায় সর্বস্ব দিয়ে। কিন্তু মাঠের বাইরে দুটো গ্রুপই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে বারবার। ফুটবল আর অপরাধজগৎ, মোটাদাগে দক্ষিণ আমেরিকার সাধারণ মানুষের জীবনের গল্পটাই যেন প্রতিফলিত হয় ‘লা দোসে’ এবং ‘লস বোরাচোস দেল ত্যাবলন’-এর কাজে-কর্মে।