'আপন' গ্যালারি, না দেখা ক্রিকেট আর রিচার্ড স্টোকস হওয়ার বাসনা
সব থমকে গেছে যেন আপাতত। এ সময়ে প্যাভিলিয়নে প্যাভিলিয়ন সিরিজে আমরা মনে করেছি মাঠে বসে আমাদের দেখা স্মরণীয় ম্যাচের কথা। যেখানে চারপাশে উল্লাস বা স্তব্ধতা যাই থাকুক, ঘোরলাগা মুহুর্তের রেশ ছিল আমাদের।
প্যাভিলিয়ন থেকে ক্রিকেটটা কেমন?
হুল্লোড় করে লাইনে দাঁড়াও, চেকিং পেরিয়ে ঢোকো স্টেডিয়াম। তারও আগে টিকেট কেনার ঝক্কি পোহাও। তারপর স্টেডিয়ামের গ্যালারীতে বসে দেখো দূরের নক্ষত্রদের; তারা ছুটছেন—দৌড়াচ্ছেন—হাঁটছেন—খেলছেন। সীমানা দূরের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালে বা ফিল্ডিং সেরে উঠে গেলে সাজানো সাজঘরে, অথবা আউট হয়ে গ্লাভস খুলে ব্যাট হাতে ফিরতে হলে নয়তো সমস্ত সজ্জা নিয়ে ব্যাটিংয়ে গেলে, খুব কাছ দিয়ে যায় যদি—একটু ডাক, একটু নাম ধরে হাঁক, রক্ত মাংসের মানুষটার দেখা পাওয়া, কয়েক গজ এদিক-সেদিক করে। আর যদি মিলে যায় সুবর্ণ সুযোগ, কলমখানা যদি বাড়িয়ে দেওয়া যায়, একটা অটোগ্রাফ, একটা সাক্ষর, একটা স্মৃতিচিহ্ন; যেখানে হোক-কাগজে-কাপড়ে-ক্যাপে।
চিৎকার, চেঁচামেচি, গান, গালির তুবড়ি। সুর তুলে ডাক পাড়া ক্রিকেটারের নাম। সাআআআকিইইইববব সাআআআকিইইইববব। তাআআআমিইইইমমম তাআআআমিইইইমমম। অথবা অন্য কেউ। মাশরাফি। মাহমুদুল্লাহ। মুশফিকুর। মুস্তাফিজ। লিটন। সৌম্য। রুবেএএএল।
প্লেকার্ড উঁচিয়ে লিখে আনা পছন্দের কিছু- শাবাশ বাংলাদেশ। অথবা- দৌড়া, বাঘ আইলো। চার বা ছয় হলে সমস্বরে উচ্ছ্বাস, লাফঝাঁপ, আনন্দ হিল্লোল। আর উইকেট পতনে নেমে আসা শ্মশ্মানের নীরবতা। ভিনদেশী কেউ যদি ফেভারিট হন- কাছ থেকে তাকে দেখে অবাক বনে যাওয়া। আবেগে কেঁপে উঠা। অথবা সবিস্ময় জিজ্ঞাসা- টিভিতে যে আপনাকে অন্যরকম দেখায়!
ক্রিকেটটা মাঠে বসে কখনো দেখা হয়নি অধমের। জানি না, এতসব অনুভূতির রকম কী! ধরন কেমন! জীবন-যৌবনের অনেকটা সময় গত হলেও স্টেডিয়ামমুখী হইনি। হতে পারিনি। দুর্ভাগ্য? নাকি নিয়তি?
*****
মকসুদ ভাই তখন ক্রিজে। বাসার সামনেই মাঠ। দু’তলার বাসার সামনেটায় লম্বা লাল বারান্দা। শুক্রবারের বিকেল। মাঠে যাইনি। অন্য এলাকার দল খেলতে এসেছে। ওরা আগেও খেলতে এসেছিল, কিন্তু প্রতিবার হেরেছে গো-হারা। এবার বোধয় আটঘাট বেঁধে এসেছে। দলে অচেনা কয়েকজনও দেখতে পাচ্ছি। এই মাঠে সালাউদ্দীন ভাইরা মোটামুটি অপ্রতিরোধ্য। হঠাৎ, কালেভদ্রে এক-দুই ম্যাচ হারা ছাড়া, এমনিতে হারানো কঠিন। লেগ সাইডে কিছুটা মজা পুকুর। মাঠের আকৃতির কারণেই এই মাঠে নিয়মিত খেলা ক্রিকেটাররা যেরকম সুবিধা পান, অন্যরা এসবে অভ্যস্ত হতে পারেন না অনেকসময়। স্বাগতিক হওয়ার পূর্ণ সুবিধা তাই ভোগ করা চলেই।
আরও পড়ুন- ১৪৬ টাকা, কলেজ ফাঁকি আর ঢাকা-ফতুল্লার 'দুঃসাহসিক' ভ্রমণ
শাহআলম ভাই ছিলেন বিল্ডিং ও মাঠের কেয়ারটেকার। তবে খেলতেন তিনিও। সেই শাহআলম ভাই একবার বলেছিলেন- এই মাঠে সালাউদ্দীনের কাছ থেকে ম্যাচ জিতে যাওয়া অসম্ভব।
আসলেও তাই। খেলোয়াড়ি দক্ষতা তো ছিলই, তবে খেলার বাইরের দক্ষতারও কম ভূমিকা ছিল না তাতে। আমাদের ভাষায় ‘কাপঝাপ’ বা ভদ্র ভাষায় যাকে বলে- ঝগড়া। যেভাবেই হোক সালাউদ্দীন ভাই ম্যাচ জিতে ছাড়বেন। সেই পিচ্চি থেকে এই মাঠে দস্যিপনা করছেন তিনি, হুট করে কেউ তার দস্যিরাজের মুকুট কেড়ে নেবে তা তো হয় না!
কিন্তু শুক্রবারের সেই বিকেল ভীষণ অন্যরকম। জুমার পর থেকে তিন-তিনটি ম্যাচ চলছে। একটাতে কোনোক্রমে জিতলেও অন্যটাতে বাজেভাবে হারতে হয়েছে। শেষ ম্যাচ রুপ নিয়েছে অলিখিত ফাইনালে। সেটাও প্রায় হারার পথে। ৪ বলে লাগে ২২ রান। দু’তলার বারান্দা থেকে খেলা দেখছি। যাকে গ্যালারির প্রতিরুপ বলা চলে। মকসুদ ভাই ২ বলে ২ ছয় মেরে জমিয়ে দিয়েছেন ম্যাচ। প্রবল উত্তেজনায় মাঠের সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। বারান্দা থেকে আমার অবস্থাও তেমন। মকসুদ ভাই একটা ওয়াইড পেলেও, পরের বলটা আকাশে ভাসাতে পারলেন না আর। পারলেন না রান তুলতেও। শেষ বলে ৬ মেরেও পরাজিত হতে হলো সেবার। তারপরও ‘নো বল’ ডেকে সালাউদ্দীন ভাইয়ের কিঞ্চিৎ ‘কাপঝাপ’ করার সুযোগ ছিল, কিন্তু সেটাও করেননি তিনি। শৈশবের সেই দু’তলার গ্যালারী-রুপী বারান্দা থেকে দেখা ম্যাচ এতটাই রোমাঞ্চ ও উত্তেজনা ছড়িয়েছিল যে, ভোলা হয়নি এখনও।
মনে আছে, সন্ধ্যার পর রাজীবের সঙ্গে দেখা হলে সে বলেছিল- গালিব, খেলা দেখেছো আজ? পুরো পাকিস্তান-ভারতের মতো ম্যাচ হয়েছে না!
*****
সাকিব আল হাসান অবাক কান্ড ঘটিয়ে দিয়েছেন। পুরোদস্তুর স্পিনার বনে গিয়ে নিউজিল্যান্ডের সাত-সাতজন ব্যাটসম্যান ঘায়েল করে বসেছেন। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অনেকেই চলে গেছে সে ম্যাচ দেখতে, পরদিন ওদের মুখে কত কথা! উত্তেজনার কত রঙ ওদের চোখেমুখে। জ্যাকব ওরাম কত লম্বা! ড্যানিয়েল ভেট্টরিকে দেখলেই ভয় হয়।
দক্ষিন আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ নাকি আসলেই বেশ বড়সড়। দৈত্যকায়। স্বচক্ষে দেখা নয়, শুনেছি বন্ধুদের মুখে। বন্ধুরা অনেকেই ছুটে গেছে সাগরিকা। সাগরপাড়ে যাওয়া হয়নি তবু আমার। ইচ্ছে হয়নি তখনো। মাঠে বসে হাইলাইটস দেখার সুযোগ নেই, অতদূর থেকে বোঝা যায় নাকি কিছু, কচুটা হবে সেখানে গিয়ে, তার চেয়ে বাসায় বসে আয়েশ করে টিভিতে দেখলেই ভালো!
২০১১ বিশ্বকাপ। প্রথমবার ইচ্ছে হলো, ইশ! যদি মাঠে বসে বিশ্বকাপ-ম্যাচ দেখা যেত! সাধ করলেই সব পূরনের সাধ্য হয় কই। হলো না আমারও। ইংলিশ ক্রিকেটকে মাটিতে নামিয়ে এনে অ্যান্ড্রিউ স্ট্রাউস- ম্যাট প্রায়রদের চোখে-মুখে ‘অবিশ্বাস’ উপহার দেন শফিউল, আর টিভিতে তা দেখে জলকেলি খেলে চোখে। অথচ ইতিহাস থেকে আমার দূরত্ব মোটে ৫-৭ কিলোমিটার! অনেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল স্টেডিয়াম থেকে, নিশ্চিত জানি- আমি বেরুতাম না! আগের সপ্তায় ৫৮ রানে অলআউট হলেও তো ভেবেছিলাম উইন্ডিজকে ৫৮’র আগেই অলআউট করা সম্ভব।
আরও পড়ুন- 'ফ্রম সুবর্ণ এক্সপ্রেস টু এমএ আজিজ স্টেডিয়াম'
তারপর আর কখনো ইচ্ছে জাগেনি।
বিপিএলের টিকেট ‘সোনার হরিণ’ নয় মোটেও, পাওয়া যায় চাইলেই। ইনজামুল তো প্রতিবছর বলে, ওর কাছে এতটা-অতটা টিকেট আছে। চাইলে যেতে পারি। কিন্তু ইচ্ছে জাগেনি। সাইফুরা দলবেঁধে বিপিএল দেখতে যায় প্রতিবছর। বেশ আয়োজন করেই যায়। ব্যানার-ট্যানার নিয়ে যায়। ইচ্ছে হয় না আমার।
*****
ইংল্যান্ড যেবার চট্টগ্রাম এলো, তখন সেমিস্টার ফাইনাল চলছে। চট্টগ্রাম ম্যাচটার আগে-পরে বন্ধ ছিল বেশ। সেদিনের মেঘলা আকাশ, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ম্যাচ হয় কি না-হয় সংশয়। দুপুরের দিকে ইনজামুলের ফোন, ‘কয়েকটা টিকেট আছে, তুই যাবি? অথবা কেউ চাইলে আমাকে জানাইস।’
খেলা হবে কিনা সংশয় সঙ্গে করে তখন আমি নানুর বাসার পথে। নানাভাই অসুস্থ। উনাকে না দেখলে যে হয় না। মাঠে যাওয়ার সুযোগ পরেও মিলবে হয়তো, নানাভাইকে দেখতে যাওয়াটা জরুরী।
ম্যাচ পন্ড হলো না, ইনজামুল ওর টিকেট কি করেছিল খবর নেওয়া হয়নি আর। তবে ম্যাচ-শেষে মনে হলো, মাঠে না গিয়ে ভালোই করেছি। হারা-ম্যাচ দেখা কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা হতো না নিশ্চয়!
*****
অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে টেস্টটার সময়কাল স্মৃতিতট থেকে মুছে গেছে। সেবার যাওয়ার ইচ্ছে জেগেও থাকতে পারে। কিন্তু কেন যাওয়া হয়নি মনে নেই। তার আগে-পরে আর কখনো ইচ্ছে হয়েছে বলে মনে পড়ে না। এখন তো ইচ্ছেটাও কেমন ‘একস্তর’ উপরে উঠে গেছে। প্রথমবার মাঠে বসে ম্যাচ দেখবো, যে-ই সে-ই ম্যাচ দেখবো কেন? খুব ইচ্ছে, কোনো ঐতিহাসিক ম্যাচের সাক্ষী হবো। এমন কোনো ম্যাচ, যার গল্প করে যেতে পারবো দিনের পর দিন।
রিচার্ড স্টোকস জীবনে দুটো মাত্র টেস্ট দেখেছিলেন গ্যালারিতে বসে। একটা ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে, অন্যটা দিল্লীর ফিরোজ শাহ কোটলায়। দুই টেস্টের মাঝে ব্যবধান ৪৩ বছর। একটায় ছিলেন ১০ বছরের ছোট্ট বালক, অন্যটায় মধ্য পঞ্চাশের একজন ব্যবসায়ী। কিন্তু এই দুটো টেস্টেই অবাক-কীর্তি চাক্ষুষের সুযোগ হয়েছিল তার। জিম লেকার ও অনিল কুম্বলে নামের দুই জাদুকর দর্শনের সৌভাগ্য হয়েছিল তার।
নিজের ভাগ্যকে অত ‘প্রসন্ন’ মনে করার কারণ নেই কোনো। তবে আশা করতে দোষ কী! বাংলাদেশের কোনো ঐতিহাসিক জয়, অথবা কোনো ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা যেন হয়! কোন পরিমন্ডলে, কোন প্রেক্ষাপটে, কোন অবস্থায়, কোন পরিচয়ে, প্রথম গ্যালারী-দর্শন হবে জানি না, তবে তা যেন ভুলে না যাওয়ার মতোই হয়!
মকসুদ ভাইয়ের তিন ছক্কা যেমন আজো প্রায় দেড় দশক পরও স্পষ্ট মনে করতে পারি, গ্যালারির প্রথম অভিজ্ঞতাও যেন ঠিক তেমনি অনুভূত হয়।
নিয়তি বা ভাগ্য, অদৃশ্য কোনো সুতোর টানে নড়েচড়ে, কে জানে কী হয়! হয়তো আরো বহু বছর পরও আশ্চর্য রহস্যময়তায় হওয়া হলো না স্টেডিয়াম-মুখো। অথবা প্রথম অভিজ্ঞতাটা হলো খুব বাজে, ভুলে যাওয়ার মতো। কিংবা, কিংবা এমনও হতে পারে, হ্যাঁ, হতেও তো পারে—রিচার্ড স্টোকসের সৌভাগ্যটা ভর করে বসল অধমেরই উপর।