করোনাউত্তর ক্রীড়া: 'ইউ হ্যাভ টু ওয়াক অ্যালোন'
বিল শ্যাঙ্কলি বেঁচে থাকলে বোধহয় দেখে দুঃখ পেতেন। লিভারপুলের এই কিংবদন্তী কোচের একটি উক্তি বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে বহু লেখায়। “ কেউ কেউ বলে, ফুটবল জীবন-মৃত্যুর ব্যপার। আমি বলি, ফুটবল তার চাইতেও গুরুতর'', শ্যাঙ্কলির এই কথা আজ মিথ্যা। ফিফার প্রেসিডেন্ট স্বয়ং বলছেন কোন ফুটবল ম্যাচ একটা জীবনের সমতুল্য নয়।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে থমকে গেছে বিশ্ব। থেমে গেছে ফুটবলও। পিছিয়ে গেছে ইউরো, কোপা আমেরিকার মত বৈশ্বিক আসর। পিছিয়ে গেছে অলিম্পিক। অতীতে শুধুই বিশ্বযুদ্ধের গোলাবারুদই পেরেছিল অলিম্পিকের মশাল নেভাতে। এবারে অদৃশ্য এক জীবাণু থামিয়ে দিয়েছে “গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ'।
মানব জীবনের যূথবদ্ধতা, তার একটা প্রতীক হচ্ছে খেলা। স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখা, একটা নির্দিষ্ট প্রতীক বা একটা ক্লাবের সমর্থক হয়ে গলা ফাটানো, জয়ে উল্লসিত হওয়া আর হারে মুষড়ে পরা; এই আবেগের উত্থানপতনই তো একজন বাঁচিয়ে রাখে একঘেয়ে দিনগুলো থেকে। একেকটা খেলায় একেকজন খেলোয়াড়ের উৎকর্ষ আর সেই উৎকর্ষের পেছনে সংগ্রামের গল্পটা তো আসলে মানুষের জীবনযুদ্ধে জয়ী হবারই গল্প। তাই তো লিভারপুল ক্লাবের স্লোগানে যখন উচ্চারিত হয়, “ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন”, তখন এই ক্লাবের প্রতিটি সমর্থক সে পৃথিবীর যে কোন কোণেই থাকুক না কেন, সে মনে করে আমি একা নই। বার্সেলোনা যখন বলে “মোর দ্যান আ ক্লাব” তখন স্ফুলিংগ চমকায় কাতালান জাতিসত্তার স্বাধীনতা আন্দোলনে।
এই সবই কি গল্প হয়ে থেকে যাবে করোনা পরবর্তী সময়ে? হারিয়ে যাবে ডোডো পাখির মতই।
বলা হচ্ছে, ইউরোপ জুড়ে করোনা ভাইরাস মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পেছনে বড় ভূমিকা আছে ফুটবলের। ইতালির বেরগামো শহরের দল আতালান্তা। এবারই তারা প্রথম বারের মত খেলছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ফুটবল আসর উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে। এসি মিলান, ইন্টার মিলানের মত বড় দলকে হটিয়ে লোম্বার্ডির এই অনামী দলটা চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার ম্যাচগুলোর জন্য বেছে নিয়েছিল মিলানের সান সিরোর মাঠ। সেখানে যে খেলা দেখতে পারে ৭৫ হাজারেরও বেশি দর্শক। নিজেদের নিয়মিত মাঠের দর্শক আসন তো মাত্র ২১ হাজার!
প্রথমবারের মত চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলতে এসেই আতালান্তা উঠে গেল নকআউট পর্বে। প্রথম ম্যাচ স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ার সঙ্গে। বেরগামো থেকে ৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মিলানে এলো ৪০ হাজার আতালান্তা সমর্থক। তারা দেখল ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে নিজেদের প্রিয় দলের ৪-১ গোলের বড় জয়। সেই রাতটা তারা উল্লাস করল, মাঠে জয়ের আনন্দে একে অন্যকে আলিঙ্গন করল, স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে উদযাপন চলল পানশালায়। এরপর তারা ফিরে গেল বেরগামোতে। সঙ্গে করে নিয়ে এল করোনা ভাইরাস।
বেরগামোর নগরপিতা, গিওর্গিও গোরি পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে ভিডিও কনফাররেন্সে বলেছেন, “মাঠে ভীড় ছিল, এরপর পানশালাগুলোতে। এটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, সেই রাতে এটা বহু লোকের মধ্যে ছড়িয়েছে।”
এরপর একলাফে বেড়ে গেছে সংক্রমণের মাত্রা। এখনো লোম্বার্ডি প্রদেশেই সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি।
সেই ম্যাচের পর সফরকারী ভ্যালেন্সিয়া দলের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের তিনভাগের একভাগই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। সেই ম্যাচ দেখতে স্পেন থেকে ২৫০০'র বেশি দর্শক এসেছিলেন ইতালিতে। তাদের অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ভেতর আছেন স্পেন থেকে আসা একজন ক্রীড়া সাংবাদিকও।
ফিরে আসি শ্যাঙ্কলির লিভারপুলের কাছে। প্রিমিয়ার লিগ জয়ের অধরা স্বপ্ন পূরণের খুব কাছেই ছিল এবার অলরেডরা। কিন্তু খুইয়ে ফেলেছে ইউরোপসেরার মুকুট। চ্যাম্পিয়নস লিগের সবশেষ আসরের চ্যাম্পিয়ন তারাই, কিন্তু এবারে করোনার প্রকোপে খেলা থেকে যাবার আগে শেষ সপ্তাহের ম্যাচে অ্যানফিল্ডেই লিভারপুল হেরে যায় অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদের কাছে। একই সঙ্গে কি তারা হারিয়ে দিল ইংল্যান্ডকেও?
লিভারপুলের নগর কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা তদন্ত করবে এই ম্যাচ নিয়ে। কর্তৃপক্ষের ধারণা, এই ম্যাচ থেকেই বহুগুণে ছড়াতে পারে করোনা ভাইরাস। লিভারপুল নগর কর্তৃপক্ষ, জনস্বাস্থ্য বিভাগ ও লিভারপুল জন মুরস ইউনিভার্সিটি মিলে খতিয়ে দেখছে, এই ম্যাচ থেকে কতটা ছড়িয়েছে ভাইরাসের বিস্তার। মাদ্রিদের নগরপিতা হোসে লুইস আলমেইদা বলেছেন, “এই সময়ে ৩০০০ সমর্থকের অ্যানফিল্ডে যাওয়াটার কোন মানে হয় না। এটা একটা ভুল হয়েছে।”
বন্ধ হয়ে গেছে ডাচ আর ফরাসি লিগ। পেট্রোডলারের ঝনঝনানি বাড়িয়ে দিয়েছে খেলোয়াড়দের বেতন। বড় বড় ক্লাবগুলো খেলোয়াড়দের বেতন কাটছে। খেলা নেই, আয় নেই। বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে হয়তো বন্ধ দরজার আড়ালে, ফাঁকা মাঠে হবে প্রিমিয়ার লিগ এবং চ্যাম্পিয়নস লিগের পরের ম্যাচগুলো। চটজলদি সূচীতে। তাতে হয়তো সম্প্রচার-সংস্থার লাভ হবে কিন্তু সমর্থকদের জন্য স্রেফ টিভিতে দেখার স্বস্তি। ভবিষ্যতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে কি মানুষ মাঠে যাওয়াই বন্ধ করে দেবে। ঘরে বসেই দেখবে প্রিয় দলের খেলা। ভিডিও কলে সংযুক্ত হয়ে একসঙ্গে উল্লাস। আর মাঠের গ্যালারিতে জার্সি পড়ানো কাকতাড়ুয়া!
বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলেও হয়েছে খেলা। যুদ্ধ শেষে আবার সব ফিরেছে আগের নিয়মে। ডন ব্র্যাডম্যানের জীবন থেকে ঝরে গেছে সোনালী সময়। যুদ্ধে অনেকেই হারিয়েছেন প্রাণ। শান্তির পায়রা ডানা মেলবার পর খেলা গড়িয়েছে মাঠে। কিন্তু এবারের যুদ্ধ তো অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে। যার বাহক মানুষ, শিকারও মানুষ।
ক্রিকেটে এরই মধ্যে লালা কিংবা ঘাম ব্যবহার করে বল ঘষার নিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ঘোষণা আসছে। ফুটবল মাঠেও থুথু ফেলায় শাস্তির বিধান শুরু হতে যাচ্ছে। তারপর হয়তো একে অন্যকে স্পর্শ না করেই খেলতে হবে ফুটবল। গোলের পর আলিঙ্গনও করা যাবে না সতীর্থকে।
যতদিন পর্যন্ত টিকা আবিষ্কৃত না হচ্ছে, ততদিন বোধহয় এই “একলা চলো' নীতিই মেনে চলতে হবে। মানতে হবে সামাজিক দূরত্ব, যে শব্দটা নিজেই একটি বিরোধাভাস! সমাজ মানেই সমষ্টি আর মানুষ সামাজিক জীব। দূরত্ব আসলে কার সঙ্গে?
উত্তর আধুনিকতা মানেই আধুনিকতাকে সেকেলে মনে করে সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার এক নৈরাশ্য। সমস্ত তত্বকথাকে অসার প্রমাণ করা, মানসিক এক বিচ্ছিন্নতা। সেলফোন যেন কারাগারের সেল, সিনেমা হলের যৌথতার চাইতে এখন “নেটফ্লিক্স অ্যান্ড চিল” এর ব্যক্তিগত বিনোদন। পরিবারের সদস্যরা যেন এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এই মানসিক দূরত্বকেই শারিরীক ও সামাজিক দূরত্বে বদলে দিয়েছে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ।
তাই লিভারপুলের “ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন” এখন ভয়ের শোনায়, কারণ সংক্রমণ থেকে বাঁচতে চাইলে “ইউ হ্যাভ টু ওয়াক অ্যালোন” । ৬ ফুট দূরে থেকে থেকে।