• ক্রিকেট, অন্যান্য
  • " />

     

    চলে গেলেন রফিক-রাজ্জাকদের পথিকৃৎ রামচাঁদ গোয়ালা

    চলে গেলেন রফিক-রাজ্জাকদের পথিকৃৎ রামচাঁদ গোয়ালা    

    মোহাম্মদ রফিক, আবদূর রাজ্জাক থেকে সাকিব আল হাসান... বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে বাঁহাতি স্পিনাররা আলাদা করেই জ্বলজ্বল করবেন। আর সেই বাঁহাতি স্পিনে পথিকৃৎ বলা হতো রামচাঁদ গোয়ালাকে। ঢাকার মাঠে দীর্ঘদিন বাঁহাতি স্পিন করে গেছেন, খেলেছেন জাতীয় দলের হয়ে। তার আগে পরে নিজ শহর ময়মনসিংহেও খেলেছেন দাপটের সঙ্গে। আজ ৭৯ বছর বয়সে অনেক ইতিহাস সঙ্গে করে চলে গেলেন তিনি।

    রামঁচাদ গোয়ালা যখন খেলা শুরু করেন, তখন ক্লাব ক্রিকেটে বাঁহাতি স্পিনার খুব বেশি ছিলেন না। বিশিষ্ট ক্রিকেট লেখক ও কোচ জালাল আহমেদ চৌধুরী প্যাভিলিয়নের কাছে স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর, ‘ঢাকায় বসে ঢাকার বাইরের ক্রিকেটারদের মধ্যে যাদের নাম শুনতাম তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। বাঙালি বাঁহাতি স্পিনার তেমন উল্লেখযোগ্য কেউ ছিল না ষাটের দশকে। আবাহনীতে খেলার আগে ময়মনসিংহের টাউন ক্লাবে খেলত। বলা যায় ব্রিলিয়ান্টলিই বলটা করতেন।’

    ঢাকার মাঠে আসার পর গোয়ালা নিজের স্পিন জাদু দেখাতে শুরু করেন। সত্তরের দশকে পড়তি বয়সেই খেলা শুরু করেন কলাবাগানে। এরপর মোহামেডানে হয়ে নাম লেখান আবাহনীতে। সেখানেই দীর্ঘ ১৫ বছর কাটিয়েছেন। এর মধ্যে সুযোগ পেয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলে। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সংক্ষিপ্ত একটা সফরে যায়, তাতে ছিলেন গোয়ালা। রেকর্ডবুক বলছে, তখন তার বয়স ৪২ বছর। ওই সময় আন্তর্জাতিক স্ট্যাটাস পায়নি বাংলাদেশ। সেই ম্যাচগুলো প্রথম শ্রেণি বা লিস্ট এ মর্যাদাও পায়নি। সেটা হলে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি বয়সে অভিষেকের রেকর্ড নিজের করে নিতে পারতেন গোয়ালা। সেবার পশ্চিমবঙ্গের বিরুদ্ধে পাঁচটি ম্যাচের চারটিতেই জিতেছিল বাংলাদেশ। গোয়ালা তাতে রেখেছিলেন বড় অবদান। ১৯৮৫ সালের শ্রীলংকা খেলতে আসে ঢাকায়। তিন দিনের একটা ম্যাচে খেলেছিলেন গোয়ালা, আউট করেছিলেন রানাতুঙ্গেকে। সেই ম্যাচও প্রথম শ্রেণিরও মর্যাদা পায়নি।

    আবাহনীতে সেই সময় সংগঠক হিসেবে ছিলেন বিসিবি পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম। এই বাঁহাতি স্পিনারের কথা বলতে খুলে দিলেন স্মৃতির ঝাঁপি, ‘ উনি কিন্তু ক্যারিয়ার শুরু করেন পেস বোলার হিসেবে। এরপর ৫০ বছর ক্লাবে ঘরোয়া লিগে খেলেছেন। আবাহনীতে তাকে নিয়ে এসেছিলাম আমি, পরে সেখান থেকে জিএমসিসি, লালমাটিয়া ক্লাবে খেলেন। মজার লোক, নান্নু আর গোয়ালাদাকে একই সঙ্গে এনেছিলাম আবাহনীতে। বয়সে অনেক বড় হলেও একেবারে বন্ধুর মতো সবার সাথে মিশতেন গোয়ালাদা। খুবই অমায়িক লোক ছিলেন, খেলা ছাড়ার পরও নিয়মিত যোগাযোগ ছিল আমার সঙ্গে।’

     

     

    এখনকার ইউটিউবে গোয়ালার বোলিংয়ের কোনো ভিডিও পাওয়া যাবে না। তবে জালাল আহমেদ চৌধুরীর স্মৃতিতে ভেসে ওঠে তার অ্যাকশন, ‘উইকেটের কাছাকাছি এসে বাঁমদিকে একটা বাঁক নিতেন। আর্কটা অনেক বড় ছিল। ফ্লাইট ছিল বলে, সেই সঙ্গে আর্মারও দিতেন ভালো। অভিজ্ঞ বোলার ছিলেন, সেটা কাজে লাগাতেন বোলিংয়ে। মানুষ হিসেবে খুব সহজ সরল মানুষ। দীর্ঘদেহী লোক ছিলেন, শরীরের বাঁধুনি ছিল শক্ত। টিমম্যান হিসেবে দারুণ ছিলেন। ঢাকার মাঠে সবার সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল তার।’

    অনেকেই তাকে বাঁহাতি স্পিনে বাংলাদেশের পথিকৃত বলেন। আহমেদ সাজ্জাদুল আলম আরেক ধাপ এগিয়ে তাকে বাংলাদেশে তার দেখা সেরা বাঁহাতি স্পিনারেরই খেতাব দিলেন, আমার দেখা বাংলাদেশে বাঁহাতি স্পিনারদের মধ্যে তিনিই সেরা। আর্ম স্পিনার ছিলেন। যে বুদ্ধিমত্তা, যে চাতুরির সঙ্গে বোলিং করতেন, সেরকম স্পিনার আমি দেখেনি। উচ্চতা ৬ ফুটের মতো ছিল। সব মিলে প্রেরণাদায়ী একজন লোক ছিলেন। স্বল্প  সময়ের জন্য সুযোগটা পেয়েছিলেন জাতীয় দলে।’ কথা বলতে বলতে একটু অতৃপ্তিও ঝরে পড়ল আহমেদ সাজ্জাদুলের কন্ঠে, ‘এই প্রজন্মের কেউ তাকে সেভাবে দেখেনি, অথচ কী দারুণ একজন ক্রিকেটার ছিলেন। আমাদেরই ব্যর্থতা তাকে আসলে নতুন প্রজন্মের সাথে ঠিকমতো পরিচয় করিয়ে দিতে পারিনি।’

    আমিনুল ইসলাম বুলবুল তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, '৫৩ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের সব পর্যায়ে খেলেছেন তিনি। বাঁহাতি স্পিনাররা বাংলাদেশকে যতগুলো ম্যাচ জিতিয়েছে, তাদের মধ্যে এনামুল হক মনি থেকে শুরু করে মোহাম্মদ রফিক, আরাফাত সানি, ইলিয়াস সানি, মোশাররফ রুবেল, তাইজুল ইসলাম এবং আজকের সাকিব আল হাসান; এই যে বড় একটি গ্রুপের স্পিনাররা যুগে যুগে সফলভাবে বোলিং করে আসছে, এর শুরুটা ছিল আমাদের রামচাঁদ গোয়ালা দার।'

    তবে গোয়ালা চলে গেলেও ময়মনসিংহের সার্কিট হাউজের ঘাসে থেকে যাবে তাঁর স্মৃতি। খেলা ছাড়ার পর থেকে কোচিংয়ে জড়িত ছিলেন, ময়মনসিংহে অনেক ক্রিকেটার উঠে এসেছেন তাঁর হাত ধরে। মাহমুদউল্লাহরাও দীক্ষা নিয়েছেন তাঁর কাছ থেকে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বাঁহাতি স্পিনের কিংবদন্তিদের একজন, যে পথে হেঁটেছে পরে আরও অনেকেই।