• পাকিস্তানের নিউজিল্যান্ড সফর
  • " />

     

    র‍্যাঙ্কিংয়ে ইতিহাস : যেভাবে শীর্ষে নিউজিল্যান্ড

    র‍্যাঙ্কিংয়ে ইতিহাস : যেভাবে শীর্ষে নিউজিল্যান্ড    

    টেস্ট র‍্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বরে ওঠার তাৎপর্যটা কী? 

    “আমি আসলে ঠিক জানি না, র‍্যাঙ্কিং কীভাবে কাজ করে, তবে যেটা জানি, একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে এটা নির্ধারণ করা হয়। এটা অর্জন করার মানে হলো, অনেক পরিশ্রম করা-- ম্যাচে, অনুশীলনে। এটা একটা বিশেষ মুহুর্ত”, কেন উইলিয়ামসনের সরল আর অকপট উত্তর। 

    আপনি জানুন বা না, ৬ জানুয়ারি নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে বিশেষ দিন। প্রতিদিন আপনি টেস্ট ক্রিকেটের এক নম্বরে প্রথমবারের মতো ওঠার ইতিহাস গড়বেন না।  

    ****

    ১৯৩০ সালের ১০ জানুয়ারি ক্রাইস্টচার্চের ল্যাঙ্কাস্টার পার্কে নিজেদের প্রথম টেস্ট খেলতে নামলো নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ঠিক পরদিন নিজেদের মাটিতে প্রথম টেস্ট খেলতে নামলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বার্বাডোসের ব্রিজটাউনে। তাদের প্রতিপক্ষও ইংল্যান্ড! 

    নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিল যে ইংল্যান্ড, সেটিকে বলা যায় ‘ইংল্যান্ড এ’। নিউজিল্যান্ড ছিল ‘ছোট’, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে মাত্র ৫টি সিরিজ খেলেছিল তারা। প্রথম টেস্ট জিততে ২৬ বছর লেগেছিল তাদের, তবে সেটি ছিল তাদের ৪৫তম টেস্ট। ১৯৪৬ সালে এসে তাদের সঙ্গে প্রথমবার খেলেছিল অস্ট্রেলিয়া, যে ম্যাচে নিউজিল্যান্ড দুই ইনিংসে অল-আউট হয়েছিল ৪২ ও ৫৪ রানে। অস্ট্রেলিয়া নিজেদের প্রতিবেশীর সঙ্গে এরপরের টেস্টটি খেলেছিল ১০,১৩৬ দিন পর!
     


    ১৮৩৫ সালে সেখানে গিয়ে চার্লস ডারউউইন দেখে এসেছিলেন, ক্রিকেটের ‘বিবর্তন’ ঘটছে সেখানে। মাওরিরাও খেলতেন, ১৮৯৪ সালে নিজেদের ঘরোয়া লিগের পর ১৯০৬ সালে প্রথম শ্রেণির প্রতিযোগিতা প্লাঙ্কেট শিল্ডও শুরু করেছিল তারা। অবশ্য নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটাররা দূর্বল ছিলেন, ২২ জন নিয়েও পেরে উঠতেন না ইংলিশদের সঙ্গে। 

    সেই নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে খেলতে ইংল্যান্ড যে ‘এ’ দল পাঠাবে, তাতে বোধহয় খুব বিস্ময়ের কিছু ছিল না। 

    নিজেদের ইতিহাসের প্রথম টেস্টের ৯০ বছর পর এর শীর্ষে ওঠা-- নিউজিল্যান্ড পাড়ি দিয়েছে দীর্ঘপথ। ইতিহাসে ৭ম দল হিসেবে টেস্ট র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে উঠলো তারা। আয়ারল্যান্ড, আফগানিস্তানকে বাদ দিলে এই অর্জন বাকি আছে শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়ে, বাংলাদেশের। 

    ****

    হাকা-- মাওরিদের যুদ্ধে যাওয়ার আগের নাচ। 

    নিউজিল্যান্ডের রাগবি দল-- অল ব্ল্যাকস তাদের প্রতি ম্যাচের আগে এটি পারফর্ম করে, প্রতিপক্ষের ভয়ে কাঁপুনি ধরানোর একটা কৌশল। 

    ক্রিকেটে এমন কোনো ঐতিহ্য নেই। আর নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলের সঙ্গে তো একটা ‘সরল-সাধাসিধে’ ট্যাগ লেগেই আছে। যদিও মাঠের আগ্রাসনে তারা পিছপা নন। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ফাহিম আশরাফের দিকে বল ছুঁড়ে জরিমানা গুণেছেন কাইল জেমিসন-- যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়, নেইল ওয়াগনারের ক্রমাগত শর্ট বল বা প্রতি উইকেটের পর বুনো উল্লাস-- ব্যাটসম্যান বা প্রতিপক্ষ কেউই পছন্দ করেন না, সেটা করার কথাও নয়--- এ তালিকাও বড় হতে পারে। হাকার রূপে থাকুক বা না থাকুক, আগ্রাসন ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য অংশ-- এটা আসলে আলাদা করে বলার প্রয়োজনও পড়ে না। ব্যাপারটা হলো, আগ্রাসনের রূপও আসলে আলাদা, শুধু দর্শকদের স্লেজিং বা দুয়ো ছাপিয়ে যে প্যাকেজে আছে আরও অনেক কিছু। 

    নিউজিল্যান্ডের তাদের হোমে তৈরি করেছে এমন এক আগ্রাসন-দুর্গ, যা হয়ে পড়ছে অজেয়। অবশ্যই তাদের পারফম্যান্সে হোম-কন্ডিশনের আলাদা দাপট থাকলেও আছে বিদেশে স্মরণীয় পারফরম্যান্সও। 

    **** 

    ২০১৭ সালের মে মাস-- যখন থেকে এখনকার আইসিসি র‍্যাঙ্কিংয়ে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, তখন থেকে দেশের মাটিতে কোনও সিরিজ হারেনি নিউজিল্যান্ড। ২০১৭ সাল শুরুর পর থেকে হেরেছে শুধু একটি। শুধু এই র‍্যাঙ্কিংয়ের সময় নয়, ২০১০ সালের পর থেকেই দেশের মাটিতে মাত্র ৪টি সিরিজ হেরেছে তারা। 

    ২০১৭ সালের মে মাসের পর থেকে দেশ-বিদেশ মিলিয়ে ২৪টি টেস্ট খেলে ১৬টিই জিতেছে নিউজিল্যান্ড, জয়ের হারে তাদের চেয়ে এগিয়ে নেই আর কেউ। দেশের মাটিতে এ সময় ১৬ ম্যাচের একটিতেও হারেনি তারা, ড্র হয়েছে ৩টি। 

    এই সময়ে দেশের বাইরে ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কা, ২০১৫ সালে ইংল্যান্ডে সিরিজ ড্র করেছিল ইংল্যান্ডে। তবে তাদের সবচেয়ে স্মরণীয় পারফরম্যান্সটি এসেছিল ২০১৮ সালে, আরব আমিরাতে এশিয়ার বাইরে কোনো দল হিসেবে ২০০২ সালের পর প্রথমবারের মতো তারা সিরিজ জিতেছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। শ্রীলঙ্কা ও আরব আমিরাত-- দুই সিরিজে নিউজিল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছিলেন আজাজ প্যাটেল-- স্বাভাবিকভাবেই একজন স্পিনার। প্যাটেল তার শেষ টেস্টটি খেলেছেন গত বছরের গ্রীষ্মে। নিউজিল্যান্ড ঝুঁকেছে এরপর মিচেল স্যান্টনারের দিকে। প্যাটেল, স্যান্টনার ছাড়া এ সময়ে নিউজিল্যান্ডের মূল স্পিনার ছিলেন উইল সমারভিল। 
     


    স্বাভাবিকভাবেই নিউজিল্যান্ডের ঘরের দুর্গের মূল শক্তি পেস। ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদির সঙ্গে নেইল ওয়াগনার, এবং সম্প্রতি কাইল জেমিসনের সমন্বয়ের আক্রমণ তাদেরকে করে তুলেছে দুর্দান্ত। কলিন ডি গ্র্যান্ডোমকে ছাপিয়ে স্বীকৃত চার পেসার তাদের এখন। ক্রাইস্টচার্চে পাকিস্তানের বিপক্ষে স্বীকৃত স্পিনার ছাড়াই নেমেছিল নিউজিল্যান্ড, ৪ বছর আরেকটি টেস্ট উইকেট পেয়েছেন অবশ্য উইলিয়ামসন। তবে নিউজিল্যান্ডের এই সময়ে অলরাউন্ড সামর্থ্যও কাজে এসেছে দারুণভাবে, ডি গ্র্যান্ডোম ছিলেন সেখানে ওপরের দিকেই। ভারতের পর ব্যাটসম্যান বোলারদের গড়ের পার্থক্য সবচেয়ে বেশি (যত বেশি গড়, তত ভাল ব্যাটসম্যান, একইভাবে যত কম গড় তত ভাল বোলার-- ফলে ব্যাটিং ও বোলিং গড়ের পার্থক্য যতো বেশি, অলরাউন্ড সামর্থ্য তত বেশি-- এই মানদন্ডে)

    উইলিয়ামসনের ভূমিকা নিশ্চিতভাবেই স্পিনারের নয়, ব্যাটিংয়ে দারুণ একটা সময় কাটাচ্ছেন তিনি। ২০১৭ সালের মে মাসের পর জেতা ম্যাচে তার গড় ৮২-এর ওপরে, দুইয়ে থাকা নামটা একটু অবাক করার মতো-- ক্রাইস্টচার্চে উইলিয়ামসনের রেকর্ড জুটির সঙ্গী হেনরি নিকোলস-- দুজনে জেতা ম্যাচে করেছেন হাজারের ওপর রান। এ দুজনের পর টম ল্যাথাম, রস টেইলরকে পেরিয়ে উইকেটকিপার বিজে ওয়াটলিংয়ের ব্যাটিং-ও দারুণ কাজে এসেছে তাদের। 


    ****

    দুর্দান্ত পেস আক্রমণ, ব্যাটিংয়ে বেশ কয়েকজন ভরসা-- নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে গেছে এক নম্বরে। অবশ্য র‍্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষস্থানে খুব বেশিদিন নাও থাকা হতে পারে তাদের, ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজের ফলের পর বদলে যেতে পারে সে অবস্থান। 

    ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ চালু হওয়ার পর র‍্যাঙ্কিংয়ের সঙ্গে সেটিও একটা বড় ‘প্রাইজ’, নিউজিল্যান্ড সেখানেও আছে ফাইনালে দৌড়েই। পয়েন্ট টেবিলে অস্ট্রেলিয়া-ভারতের পরই তারা। 

    আপাতত অবশ্য র‍্যাঙ্কিং-ই আলোচনায়। যে সিরিজের ওপর নির্ভর করছে নিউজিল্যান্ডের শীর্ষে থাকার সময়কালের ভাগ্য, সেটি দেখবেন কিনা, এমন প্রশ্নেও উইলিয়ামসনের সরল উত্তর ছিল, “হয়তো দেখব, তবে সেভাবে না। মেয়ের ডায়াপার বদলানোর কাজই বেশি করতে হবে। আশা করি ফলটা আমাদের পক্ষে আসবে, তবে এটা তো আমাদের হাতে নেই আর।” 

    নিজেদের হাতে যা ছিল, উইলিয়ামসনের নিউজিল্যান্ড সেটি করেছে এরই মাঝে। ঘরের দুর্গে ভর করে তারা গড়েছে ইতিহাস।