প্রেসিং ঝড়ে বেলজিয়ামের 'স্বর্ণালী প্রজন্ম'কে গুড়িয়ে নেশনস লিগের ফাইনালে ফ্রান্স
তুরিনের মাঠে বসে যারা আজ বেলজিয়াম-ফ্রান্সের খেলা দেখেছেন, খেলার তাল সামলাতে বোধহয় হিমশিম খেয়েছেন অনেকেই; এমনকি টিভি সেটের সামনে যারা দেখেছেন তারাও মজে ছিলেন ম্যাচের দুর্বার ছন্দে। দুই অর্ধের খেলায় একেবারে আকাশ-পাতাল পার্থক্য! প্রথমার্ধে ফ্রান্সের আলসেমির মাশুল গুণতে হয়েছিল চার মিনিটে দুই গোল খেয়ে। বেলজিয়ামের স্বর্ণালী প্রজন্ম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল তাদের প্রথম ইউরোপিয় ফাইনালের। আর তার জন্য ঠেকিয়ে খেলতে হতো মাত্র ৪৫ মিনিট। কিন্তু সবকিছুই লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল ফরাসি প্রেসিংয়ের ঝড়ে। আলিয়াঞ্জ স্টেডিয়ামে আরো একবার বেলজিয়ামের যাত্রা ভঙ্গ হলো সেমিফাইনালে এসে, এবং আবারো ফ্রান্সের হাতেই। নাটকীয়, রুদ্ধশ্বাস এক ম্যাচে বেলজিয়ামকে ২-৩ গোলে হারিয়ে ফ্রান্সের যাত্রা ফাইনালের পথে।
অথচ আগ্রাসী এই ফ্রান্সকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি প্রথমার্ধের বিশ মিনিটের পর থেকে। মাঝমাঠে বেলজিয়ামকে বলের নিয়ন্ত্রণ নিতে দিয়ে উল্টো নিজেরাই ডেকে এনেছে নিজেদের বিপদ। অবশ্য ম্যাচে কিছু বুঝে উঠতে না উঠতেই ইউগো লরিসের সামনে ডি ব্রুইনার আচমকা শট। আঙ্গুলের সামান্য ছোঁয়ায় দারুণভাবে সেভ না করলে ম্যাচের তিন মিনিটেই বিপদের গর্তে পড়ে যেত দিদিয়ের দেশমের দল।
দুই কোচই চেয়েছেন পজেশন ধরে রেখে ঠাণ্ডা মাথায় ফুটবল খেলে ম্যাচ বের করে আনতে। তিনজনের ব্যাকলাইনে খেলা দুই দল শুরু থেকেই সরব দুই উইংয়ে। যদিও বলের আনাগোনা হিটম্যাপে দেখলে দেখা যাবে, নিজেদের অর্ধ থেকে ভারানে লং বল খেলে সেটা পাঠাতে চাচ্ছিলেন এমবাপে-গ্রিজমান-বেনজেমা ত্রয়ীর কাছে। ৩-৪-১-২ ফরমেশনে সাজানো ফ্রান্স দলে অবশ্য শুরু থেকে প্রেস করে খেলেছেন করিম বেনজেমা, প্রথমার্ধে এমবাপে ছিলেন কিছুটা নিষ্প্রভ। অন্যদিকে, ৩-৪-৩ ফরমেশনে খেলা বেলজিয়াম ডিফেন্সের সময় নেমে আসছিল ৫-৪-১ ফরমেশনে। লুকাকুর ক্ষিপ্র দক্ষতার লং রানের কারণে বেলজিয়াম ট্রানসিশন কাউন্টারে ছিল রীতিমত ভয় ধরানো!
ট্যাকটিকাল টেক্সটবুকের তাত্ত্বিক খেলা থেকে দুই দল বের হয়নি প্রথম অর্ধে। আধ ঘন্টা পর ফ্রান্স একটু গা ছাড়া দিয়েছিল, আর সেটাকেই বেলজিয়াম ধরে নেয় সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে। ম্যাচের ৩৬ মিনিটে ডি ব্রুইনার বল লেফট উইং থেকে খুঁজে নেয় ইয়ানিক কারাস্কোকে। কাট করে বক্সে ঢুকে নিচু করে নেয়া শটটা আর দশটা সাধারণ গোল অ্যাটেম্পট নেয়া শটের কাতারেই ফেলে দেয়া যেত। কিন্তু ভুল পায়ে ভর রেখে বোকা বনে যান ফরাসি অধিনায়ক ইউগো লরিস। প্রথম গোল খাওয়ার তাল সামলানোর সময়টাও যে পেল না তারা, ঠিক চার মিনিট পর দ্বিতীয় গোল হজম করে বসে ‘ল্য ব্লুজ’রা। ব্রুইনার থ্রু বল ডামি করে লুকাস আরনান্দেজকে বোকা বানান লুকাকু। তার টপ কর্নারে নেয়া জোরালো শট ঠেকানোর সাধ্য ছিল না লরিসের, আর এমন অসম্ভব অ্যাঙ্গেল থেকে গোল করে নিজেই অবাক বেলজিয়ান স্ট্রাইকার, বেলজিয়াম উপভোগ করছে জয়ের ফুরফুরে বাতাস।
গা এলিয়ে দিয়েই বিপদটা ডেকে আনল তারা। ফ্রান্স যে ভুলটা করেছিল প্রথমার্ধে, ঠিক একই ভুল বেলজিয়াম করলো দ্বিতীয়ার্ধে। এমবাপের পেইস অন্যদের ঘাম ছুটালেও বেলজিয়ান ডিফেন্ডার ডেনায়েরের দৃঢ়তায় তেমন কাজে আসছিল না জায়গামত। তবে ম্যাচের চেহারাই পাল্টে যেতে শুরু করলো ৫৫ মিনিট থেকে ! অ্যালডারওয়াইরাল্ডকে ফাঁকি দিয়ে এমবাপে বলের যোগান দিলেও অবশ্য গ্রিজমান ঠিকমত জায়গা করে মারতে পারেননি। তাল হারিয়ে পড়ে যান বক্সে, চোখে-মুখে হতাশার ছাপও ছিল স্পষ্ট। তবে ঠিক চার মিনিট পরই শুরু হলো অবিশ্বাস্য এক ‘কামব্যাক’।
৬১ মিনিটে মাঠের বাম হাফ স্পেস থেকে বল কাটিয়ে এনে এমবাপে দেন বেনজেমাকে। রিয়ালের ফরোয়ার্ড গত দেড় বছরে রিয়ালকে কঠিন সময়ে দেখিয়েছেন আশার আলো। ৪ জন বেলজিয়ান ডিফেন্ডারের মাঝ থেকে শট নিয়ে বল জালে পাঠানোর সময় ঠিক যেন সেই দৃশ্যগুলোরই পুনরাবৃত্তি! দলকে ম্যাচে ফিরিয়ে বেনজেমার উল্লাসের সঙ্গে চোখে লেগে থাকল তার অনবদ্য গোল।
এদিকে ৬৫ মিনিটে বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে গ্রিজমানকে ফাউল করে বসেন টিলেমান্স। প্রথমে রেফারি পেনাল্টির বাঁশি না বাজালেও ভিএআরের কল্যাণে ফ্রান্স পেয়ে যায় আরো একটি লাইফলাইন। ইউরোর কোয়ার্টারে পেনাল্টি মিসের আক্ষেপ হয়তো এখনো যায়নি এমবাপের। তবে বল সজোরে জালে পাঠিয়ে ঠিকই এবার খেলায় ফিরিয়ে এনেছিলেন ফ্রান্সকে।
ম্যাচের সবচেয়ে বড় ড্রামা বোধহয় জমা ছিল শেষ পাঁচ মিনিটের জন্য। ফ্রান্সের একেক পর প্রেস থেকে অ্যাটাক, অন্যদিকে বেলজিয়ামের কাউন্টার অ্যাটাকের মাঝে পাভাঁর ভুল পজিশনিংয়ের সুযোগ নিয়ে কারাস্কো বল এগিয়ে দেন লুকাকুর দিকে। আলতো এক ট্যাপে বল জালে জড়িয়ে বোধহয় তিনি ভেবেই ফেলেছিলেন বেলজিয়ামকে তিনি নিয়ে যাচ্ছেন ফাইনালের আরো কাছে। কিন্তু বিধিবাম! ইঞ্চি পরিমাণ অফসাইডের কারণে বাতিল হয়ে যায় সে গোল।
দুই মিনিট পর পগবার ফ্রি কিক গিয়ে লাগল বারে। বেলজিয়াম সেবার বেঁচে গেলেও ৮৯ মিনিটে আর হলো না রক্ষা। রাইট উইং ব্যাক থেকে পাভাঁর বাড়ানো নিচু ক্রস বেনজেমা ছেড়ে দিলে বলে শট নেন থিও আরনান্দেজ। কোর্তোয়া তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও পারেননি সে বল জালে জড়ানো থেকে ঠেকাতে। প্রথমার্ধে ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়া সেই ফ্রান্স পরবর্তী ৪৫ মিনিটে শোধ করলো আরো তিন গোল। নাটকীয়তার চূড়ান্তে এসে শেষ বাঁশির শব্দে নেমে এলো উচ্ছ্বাস, আর বেলজিয়ামের জন্য আরেক বিষাদময় রাত। তাদের ‘স্বর্ণালি প্রজন্ম’ আরো একবার বঞ্চিত ইউরোপিয় মঞ্চের ফাইনাল থেকে।