• ইউয়েফা নেশনস লিগ
  • " />

     

    ফিরে আসার গল্প আরো একবার লিখে ফ্রান্স জানিয়ে গেল তাদের শ্রেষ্ঠত্বগাঁথা

    ফিরে আসার গল্প আরো একবার লিখে ফ্রান্স জানিয়ে গেল তাদের শ্রেষ্ঠত্বগাঁথা    

    এভাবেও ফিরে আসা যায়। ডান পায়ের জাদু মন্ত্রে কখনো রংধনুর বাঁকের মত; কিংবা বারবার ব্যর্থ চেষ্টার পসরার মাঝে একবার সফল হওয়ার আনন্দের মত। সান সিরোতে ফ্রান্স আরেকবার লিখল ফুটবলের প্রিয় চিত্রনাট্য- এভাবেও ফিরে আসা যায়, এভাবে বারবার ফিরে আসা যায়। হার না মানা উদ্যম দেখিয়েও লুইস এনরিকের স্পেন হেরে গেল পগবা-লরিসের কাছে, এমবাপের কাছে; ফ্রান্স দলে রেনেসাঁ হয়ে ফিরে আসা বেনজেমার কাছে। ১-২ গোলে ফ্রান্সের জয়ে ইতালির মাটিতে ফুটবলের ইতিহাসে আরেকবার লেখা হলো ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠত্ব।

    আলিয়াঞ্জের সেমিফাইনালের ঝাঁঝ ছিল ফাইনালে এসেও। তুমুল আগ্রাসী স্পেন মনে করিয়ে দিচ্ছিল বেলজিয়ামের কথা, আর ফ্রান্সও তেমন একটা সুযোগ পায়নি পুরো অর্ধে। তবে সুযোগ কাজে লাগানোর ব্যাপারে প্রথমার্ধে সত্যিকার অর্থে দুই দলেরই নেই ভালো কোন চেষ্টা। গোলমুখে ব্যর্থ দুই দল, অন টার্গেটে শট মাত্র একটি, সারাবিয়ার সে চেষ্টা লরিসকে ভয়ে কাঁপন ধরাতে পারেনি। 

    তবে ম্যাচে প্রথম কাঁপন ধরিয়েছেলেন এমবাপে। লাপোর্তের মার্কিং ফাঁকি দিয়ে পগবার বাড়ানো বল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন বিপদ বার্তা নিয়ে। সিমনকেও বের করে এনেছিলেন গোলপোস্ট থেকে কিন্তু তার বাড়ানো বল জালে পাঠানোর মত ছিল না কেউ। এর বাইরে প্রথমার্ধে একেবারেই নিষ্প্রভ ব্যর্থ ছিলেন পিএসজির ফরোয়ার্ড, বল নিজের পায়ে পেয়েও হারিয়েছেন বারবার। আর মাঝমাঠে কান্তের অভাব প্রথমার্ধে ফ্রান্স টের পেয়েছে ভালো মতই। 

    ফ্রান্সের ৩-৫-২ ফরমেশনের বিপরীতে ওয়াইড অ্যাটাকিং ৪-৩-৩ ফরমেশনে দল সাজিয়েছিলেন এনরিকে। মিডফিল্ডে বুস্কেতস ছিলেন খেলার গতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে, সঙ্গে রদ্রি আর গাভির বোঝাপড়াটা ছিল ভালোই। সেমির মত প্রথমার্ধে আলো ছড়িয়েছেন মাত্র ১৭ বছরে পড়া এই গাভি-ই, সর্বোচ্চ পাস রেট ধরে রেখে ফ্রান্সের ব্যাকলাইনকে বের করে আনছিলেন নিজের দিকে, অয়ারজাবাল-সারাবিয়ার জন্য সুযোগ করে দিচ্ছিলেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার। 

    অবশ্য মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও কাজের কাজ কেউই করতে পারেননি স্পেনের উইঙ্গাররা। স্পেনের আক্রমণভাগে গুরুদায়িত্ব একাই বয়ে বেড়াচ্ছিলেন ফেরান টরেস। ১১ মিনিটে সারাবিয়ার জন্য দারুণ বল বানিয়ে দিলেও বাকি সময়টুকুতে কখনো হয়নি বলের সঙ্গে গতির সমন্বয়, আবার কখনো ফ্রান্সের ব্যাকলাইনের কাছে মেনেছেন হার। কিমপেম্বে-ভারানে তাকে রেখেছিলেন কড়া মার্কিংয়ে। 

    তুমুল প্রেসিংয়ে স্পেন অবশ্য ব্লক করে রেখেছিল ফ্রান্সের পাসিং চ্যানেল। কিন্তু নিজেরাও ফাইনাল থার্ডে ছিল অকার্যকর, তাই ম্যাচের প্রথমার্ধ হয়ে পড়েছিল একঘেঁয়ে। প্রথমার্ধ শেষের কয়েক মিনিট আগে ফ্রান্স খেয়ে বসে বড় ধাক্কা। গাভির বাড়ানো বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে চোটে পড়েন ভারানে। গুরুতর হওয়ায় শেষমেষ ছেড়ে যান মাঠ, তার জায়গায় নামেন বায়ার্ন মিউনিখ সেন্টারব্যাক উপামেকানো।

    নিষ্প্রভ প্রথমার্ধ, এটা অনুমিতই যে সব নাটক শেষ ৪৫ মিনিটের জন্য ধরে রাখা, আর হয়েছেও তাই।

    দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে পগবার হলুদ কার্ডটা যেন ‘সুইচ’ এর মত কাজ করলো ফ্রান্সের জন্য। স্পেনের মিডফিল্ড প্রেস ভেঙ্গে বল বের করে আনতে শুরু করলেন পগবা-চুয়ামেনি। শেষের ৪৫ মিনিটে পগবা একাই যেন খেলেছেন দুইজনের খেলা, যেমন নিচে নেমে এসে খেলা ইন্টারসেপ্ট করেছেন; তেমনি সামনে বাড়িয়েছেন বিপদজনক বল। তার শুরু করা এক কাউন্টার থেকে শুরু হলো খেলার ক্লাইম্যাক্স, ঠিক ৬৩ মিনিটে। 

    খেলার পরবর্তী সাত মিনিটকে থ্রিলার সিনেমার চিত্রনাট্য বললে এক অংশও ভুল হবে না। পগবা থেকে বেনজেমার বাড়ানো বল থেকে থেও আরনান্দেজের শট বারের সজোরে লেগে ফিরে এলো, বল স্পেনের দখলে। আজপিলিকুয়েতা থেকে বুস্কেতস- বুস্কেতসের লং বল এলো অয়ারজাবালের পায়ে। সোসিয়াদাদের উইঙ্গারের চেয়েও অনেক শক্তিশালী উপামেকানো তাল রাখতে পারেননি বক্সে, লোয়ার রাইট কর্নারে অয়ারজাবালের শট, স্পেন পেল তাদের প্রতিক্ষিত প্রথম গোল। ম্যাচের বয়স তখন ৬৫ মিনিট।

    ‘কামব্যাক’ কাকে বলে, ফ্রান্স দেখিয়ে এসেছে সেমিফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো ঠিক দুই মিনিটের মাঝে। মাঝমাঠের বাম দিক থেকে পগবার লং বল সরাসরি এমবাপের কাছে, এমবাপে দিলেন বেনজেমাকে। আর বেনজেমা এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের জন্য পুরো সান সিরোকে করে দিলেন নিস্তব্ধ! 

    বক্সের সামান্য ভেতর থেকে রিয়াল ফরোয়ার্ডের ডান পায়ের জাদুর ছোঁয়ায় শূন্যে ভাসল বল, হাত দিয়ে ছুঁয়েও সিমন অসহায় হয়ে শুধু টের পেলেন বল জালে আছড়ে পড়ার মৃদু শব্দে। আর সে শব্দে ভাঙ্গল সব নিস্তব্ধতা, বেনজেমাকে ঘিরে ততক্ষণে পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে উদযাপনের জোয়ার! 

    কিন্তু মূল কাজটা ছিল বাকি। সেজন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো ১৪ মিনিট। পুরো ম্যাচে বলে ভালো নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারলেও এমবাপে সেবার ভেঙ্গে ফেললেন অফসাইড ট্র্যাপ। থেও আরনান্দেজ যখন বল সামনে দিয়েছিলে, এমবাপে ছিলেন অফসাইড পজিশনে। কিন্তু এরিক গার্সিয়ার পায়ে বল লেগে যাওয়ায় বক্সে এমবাপের সামনে শুধুই সিমন। ম্যাচে বারবার ব্যর্থ হয়েও এবার আর ভুল করলেন না এমবাপে। কিছুটা বিতর্কিত মনে হওয়ায় স্পেনের তুমুল প্রতিবাদ অবশ্য কানের তোলার সময় পেলেন না রেফারি অ্যান্থনি টেইলর। ভিএআর চেকের পর এলো গোলের সিদ্ধান্ত, ফ্রান্স পেল এক গোলের লিড।

    ম্যাচের বাকি সময়টুকুতে স্পেন চেষ্টা করে গেছে। আক্রমণে ঢেউ তুলে আছড়ে ফেলেছে ফরাসি ডিফেন্সকে। ৮৭ মিনিটে অয়ারজাবালের ভলি, কিংবা ম্যাচ শেষ হবার ৩০ সেকেন্ড আগেও মারকোস আলোনসোর জোরালো শট ভয় ধরিয়েছিল ফ্রান্স দলে, কিন্তু স্পেনের শেষ চেষ্টাটুকু ঠেকিয়ে দিয়ে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ফরাসি অধিনায়ক ইউগো লরিস। 

    শেষ বাঁশি বাজার পর অবশ্য ফ্রান্স দলের উদযাপনটা হলো স্তিমিত। এত পথ আর বাধা পার হয়ে জেতার এমন অনুভূতিটা তাদের বেশ পরিচিত। দুবারের বিশ্বকাপ আর দুবারের ইউরো জয়ী দলের জন্য এই সাফল্য যেন কাম্যই ছিল, শুধু ছিল সময়ের অপেক্ষা। নেশনস লিগের চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফ্রান্স এবার সে অপেক্ষারও ঘটাল অবসান, আর প্রমাণ করে গেল এখনোও তারাই চ্যাম্পিয়ন, তারাই সেরা। বিশ্বকাপ, ইউরো এবং নেশনস লিগ জেতা বিশ্বের একমাত্র দলও যে তারাই!