• ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
  • " />

     

    ফাইনালে যে পাঁচ কৌশলে নিউজিল্যান্ডকে টেক্কা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া

    ফাইনালে যে পাঁচ কৌশলে নিউজিল্যান্ডকে টেক্কা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া    

    প্রথম ট্রান্স-তাসমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে অনায়াসেই হারিয়ে প্রথম বারের মত অস্ট্রেলিয়ার ট্রফির তাকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপা জায়গা করে নিয়েছে। টস জিতে হয়ত অ্যারন ফিঞ্চের দল অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন, তবে মাঠের ক্রিকেটিয় ও মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়েও কিন্তু কম যাননি তারা। চলুন দেখে আসা যাক ম্যাচের কোন কোন জায়গায়, কোন মুহূর্তে কিউইদের কাছ থেকে ম্যাচ ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে অজিরা।  

    পাওয়ারপ্লেতে দুই দলের ব্যাটিং

    দুবাইয়ের “রিং অফ ফায়ার” অনেকের মতেই টস নির্ভর একটি মাঠ। সেই কথায় দ্বিমত পোষণের উপায়ও খুব একটা নেই; শেষ ১৮ ম্যাচের ১৭টাই রান তাড়া করা দলের জয় অন্তত সেদিকেই ইঙ্গিত করে। তবে এই মাঠে কিন্তু প্রথমে ব্যাট করেই গত মাসেই হয়ে যাওয়া আইপিএল ফাইনাল জিতেছিল চেন্নাই।

    চেন্নাই যেটা করেছে, শুরুতে ব্যাট করে বড় সংগ্রহ করা-সেটাই পারেনি অন্যরা। সেজন্য দরকার ছিল পাওয়ারপ্লে কাজে লাগানো। যে ভুলটা সেমি ফাইনালে করেছিল দুই পরাজিত দল, ফাইনালে করেছে নিউজিল্যান্ড। অবশ্য নিউজিল্যান্ড ভুল করেছে-এই কথাটা বললে কিছুটা হলেও অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের পারফর্ম্যান্সকে খাটো করে দেখা হয়ে যায়। নিউজিল্যান্ড যে পাওয়ারপ্লেতে চড়াও হওয়ার চেষ্টা করবে সেটা ভালই জানা ছিল অস্ট্রেলিয়ানদের। বিশেষত, মার্টিন গাপটিল যে পাওয়ারপ্লেতে কতটা ভয়ানক সেটা বোধহয় অজিদের চেয়ে ভালো কেউই জানে না। তাই তাকে অফ স্টাম্পের বাইরে হাত খোলার মত তেমন একটা জায়গাই দেননি তারা। নিউজিল্যান্ড পাওয়ারপ্লেতে ড্যারিল মিচেলকে হারিয়ে তুলতে পেরেছিল ৩২ রান, যা এবারের আসরে তাদের সর্বনিম্ন। সেখানে তৃতীয় ওভারেই অ্যারন ফিঞ্চকে হারালেও অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং আগ্রাসনে ভাটা পড়েনি বিন্দুমাত্র; মিচেল মার্শতো শুরুই করেছিলেন ছয় দিয়ে! পাওয়ারপ্লেতে দুই দলের ব্যাটিং ভঙ্গিমাই ফাইনালের ভাগ্য নির্ধারণে রেখেছে বড় ভূমিকা।


    উইলিয়ামসনের স্পিন দুর্বলতা?

    ফাইনাল শুরুর আগে নিশ্চয় এই টুর্নামেন্টে কেন উইলিয়ামসনের ব্যাটিং নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিং রুমে পরিকল্পনা, কাটাছেঁড়া সবই হয়েছে। তাই উইলিয়ামসনের ব্যাটিং পরিসংখ্যানের একটা দিক যে তাদের চোখ এড়িয়ে যায়নি, সেটা পরিষ্কার ছিল ফিঞ্চের বোলিং পরিবর্তন ও ফিল্ডিং সাজানোতে। এবারের আসরের সুপার-১২ তে ফাইনালের আগে অন্তত ৫০ বল খেলেছে এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে স্পিনের বিপক্ষে সর্বনিম্ন স্ট্রাইক রেট ছিল উইলিয়ামসনের, তাও মোটে ৮১.৯৪! স্বভাববিরুদ্ধ বলতেই হয়, হয়ত কনুইয়ের সমস্যাটা ভোগাচ্ছিল একটু হলেও। কারণ যেটাই হোক, ব্যাটিং গ্রামারে সবচেয়ে পরিশীলিত প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে তো আর কোনও সুযোগ নেওয়া চলে না। অফ স্পিনার হিসেবে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের বল ঢুকবে ভেতরে; লেগ স্পিনার অ্যাডাম জাম্পাও তার গুগলির পসরা সাজিয়ে বসবেন। অস্ট্রেলিয়াতে জাম্পার দারুণ গুগলিতে যে স্টাম্প খুইয়ে ফিরেছিলেন তা তো উইলিয়ামসন সচরাচর ভুলবেন না। পায়ের ওপর বল উইলিয়ামসনকে গ্লাইড করতে বাধ্য করাই ছিল অজিদের লক্ষ্য; আর যদি জাম্পার লেগ স্পিন বেশি বাঁক খায় তাতেও উইলিয়ামসন হয়ত তাকে সুইপই করবেন। তাই ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্ক্যার লেগ ও ডিপ স্কয়ার লেগে বেশিরভাগ সময়েই স্পিনের জন্য ফিল্ডার রেখেছিলেন ফিঞ্চ।

    কাজেও লেগেছিল তাদের পরিকল্পনা। ম্যাক্সওয়েলের প্রথম ২ বলে ২ রান নিতে পেরেছিলেন তিনি। জাম্পার প্রথম তিন ওভারে যথাক্রমে নিয়েছিলেন ১(২), ৩(৩), ৪(৪) রান। তবে উইলিয়ামসন যেদিন ফর্মে থাকেন সেদিন তো তাকে বেশিক্ষণ আটকে রাখার সাধ্য নেই। ম্যাক্সওয়েলের শেষ ওভারে ৪ বল খেলে ২ ছয়ে নিয়েছিলেন ১২ রান, যার মধ্যে ছিল এক হাত দিয়ে  ডিপ মিড উইকেটের ওপর দিয়ে মারা সেই ছয়টি। জাম্পার পরের ওভারে অবশ্য খেলতে পেরেছিলেন ১ বল, যেখান থেকে একটি সিঙ্গেলের বেশি নিতে পারেননি। ফিঞ্চদের পরিকল্পনা তাই কিছুটা হলেও সফলই বলা যায়; কেননা এই দুজনের জন্যই উইলিয়ামসনের উইকেটে থিতু হতে বেশ সময় লেগে গিয়েছিলো।

    মাঝের ওভারগুলোই নির্ধারণ করল ম্যাচের ভাগ্য?

    জাম্পা-ম্যাক্সওয়েলের কল্যাণে মাঝের ওভারগুলোতে নিশ্চুপ ছিলেন গাপটিল-উইলিয়ামসন। জাম্পার শিকার হয়ে গাপটিল ফিরেছিলেন ৩৫ বলে ২৮ রান করে, যা ৩০+ বল খেলে এই আসরে তার সর্বনিম্ন স্ট্রাইক রেটের ইনিংস। গাপটিল সাধারণত লেগ স্পিনারদের ওপর চড়াও হন; এমনকি অস্ট্রেলিয়ার সাথে তার রেকর্ডও বেশ ভালো। কিন্তু এদিন জাম্পা ছিলেন অনবদ্য। টপ স্পিন আর গুগলির আধিক্যে গাপটিলকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখায় তার প্রিয় স্লগ সুইপ খেলার খুব একটা সুযোগই পাননি তিনি। তাই নিউজিল্যান্ড ১০ ওভার শেষে তুলতে পেরেছিল মোটে ৫৭ রান যেখানে অস্ট্রেলিয়া ১০ ওভার শেষে তুলেছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনাল ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৮২ রান। ৭-১০ ওভারের এই রানখরাই পরে ভুগিয়েছে কিউইদের।

    শটে শৈথিল্য?

    এবারের আসরে ফাইনালের আগে প্রথমে ব্যাট করা দল শট খেলেছে ৫১% আর দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করা দল শট খেলেছে ৫৬%। তবে নিউজিল্যান্ড ১০ম ওভারের আগে শট খেলেছিল মাত্র ৪৩%। এই সময়ের মাঝে তারা ২৭টি ডট গুনেছে। অষ্টম ওভারের চতুর্থ বলে গিয়ে চার মারার আগে ৩২ বলে পায়নি কোনও বাউন্ডারির দেখা। প্রথম দিকে কিউইদের উইকেট বাঁচিয়ে খেলার মানসিকতা দিনশেষে তাদের পিছে ঠেলে দিয়েছে।

    দুই লেগ স্পিনারের তফাত

    কিউইদেরকে মাঝের ওভারগুলোতে বেশ ভুগিয়েছেন জাম্পা। প্রথম ৩ ওভারে দিয়েছিলেন মোটে ১৩ রান, সাথে ফিরিয়েছিলেন গাপটিলকে। সেখানে ইশ সোধির দিকে কিউই অধিনায়ক সেরকম কিছুর জন্যই তাকিয়ে থাকলেও বাঁহাতি ডেভিড ওয়ার্নার তাকে একেবারেই অকেজো করে রেখেছিলেন। সোধির লাইন-লেংথের ছন্নছাড়া হালের প্রমাণ মিলেছে তার ৩ ওভারে দেওয়া ৪০ রানের স্পেলেই। সোধির সাথে ওয়ার্নার যা করেছেন জাম্পার সাথে তার কিছুটা হলেও করতে পারতেন ডেভন কনওয়ে। লাইনআপের প্রথম ৪ জন ব্যাটসম্যান ডানহাতি হয়ে যাওয়াটাও তাই কিউইদের বিপক্ষেই গিয়েছে।

    ওয়ান ট্রিক টু মেনি?

    উইকেটে যে গতি আছে সেটা গত কয়েক ম্যাচেই বুঝে গিয়েছিলেন দুই দলের বোলাররা। ফ্লাডলাইটের নিচে যে বল আরও দ্রুত ব্যাটে আসবে সেটা আঁচ করেই কামিন্স-হেজলউড টানা বল করে গিয়েছিলেন গুড লেংথে। এমনকি মিচেলকে ফেরানো হেজলউডের নাকল বলটাও ছিল গুড লেংথে। তবে স্টার্ক যে ফুল বা ইয়র্কার লেংথের পন্থা থেকে সরে আসবেন না সেটা জানতেন উইলিয়ামসন। তার ৩য় ওভারেও অনায়াসে ১৯ রান নেওয়ার পরে বিস্ময়করভাবে ৪র্থ ওভারে থার্ড ম্যান বৃত্তের ভেতরে রাখার সিদ্ধান্ত নেন ফিঞ্চ। আর প্রথম বলটাও টপ এজ জয়ে সেই থার্ড ম্যান অঞ্চল দিয়েই বাউন্ডারির দড়ি স্পর্শ করে। ফিঞ্চের এই সিদ্ধান্তের জন্য আত্মবিশ্বাস পেয়েই পরে অফ স্টাম্পের ওপর জায়গা বানিয়ে খেলে ঐ ওভারে ২৪ রান নিয়েছিলেন উইলিয়ামসন।

    তবে অজিদের লাইন-লেংথ অনুসরণ করতে গিয়ে বোল্ট ছাড়া কেউই সফল তো হননি, গুড লেংথের বদলে তাদের বেশিরভাগ বল পড়েছে শর্ট লেংথে। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়াতে ক্রিকেট খেলে বেড়ে ওঠা মিচেল মার্শ যে ফ্রন্টফুটেও পুল খেলতে পারেন সেটা বোধহয় কিউইরা ভুলেই গিয়েছিলেন। এমনকি মিলনেকে ফ্রন্টফুটে গিয়ে যেই মাটি কামড়ানো পুল শটে ডিপ মিড উইকেট চার মেরেছিলেন মার্শ, তাতে তো স্বয়ং উইলিয়ামসনও মুগ্ধ হয়ে বলে ফেলেছিলেন, “শট!” তা সত্ত্বেও সাউদি, মিলনে, নিশামদের পরিকল্পনায় আসেনি পরিবর্তন। ম্যাচের পরিস্থিতি বা ব্যাটসম্যানের শক্তির জায়গা পর্যালোচনা না করে কিছুটা গোঁয়ার হয়ে একই লেংথ ধরে রাখাটা কিউইদের নিশ্চিতভাবেই ভুগিয়েছে।