• পাকিস্তানের বাংলাদেশ সফর
  • " />

     

    যে কাজটা নীরবে করে যাচ্ছেন তাইজুল

    যে কাজটা নীরবে করে যাচ্ছেন তাইজুল    

    ‘আনসাং হিরো’ কথাটা ক্রিকেটে খুব চলে।

    কেউ কেউ আছেন, পাদপ্রদীপের আড়ালে থাকাটাই তাদের নিয়তি। ফুটবলে যেমন মেসিদের দ্যুতিতে অনেক সময় আড়ালে চলে যান বুসকেটসরা, ক্রিকেটে পারফর্ম করেও কেউ কেউ আড়ালেই থেকে যান।

    তাইজুল ইসলাম নিজে চান বা না চান, তাঁকে অনেকবারই সেই নিয়তি মেনে নিতে হয়েছে। স্বভাবেও এমনিতে তিনি বেশ অন্তর্মুখী, জাতীয় দলের আরও অনেকের মতো সেই ‘এক্স ফ্যাক্টর’ তাঁর নেই। তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল কন্টেন্ট নেই। আরো অনেক তারকা ক্রিকেটারের মতো তার আলাদা সমর্থকগোষ্ঠী নেই। নিজের কাজটা অনেক দিন ধরেই ঠিকঠাক করে যাচ্ছেন, অথচ তাঁকে নিয়ে কথাই হয় না।

    সেটা না হওয়ার আরেকটা কারণ পাদপ্রদীপের আলোয় না আসা। তাইজুলের সুযোগ আসে কেবল সাদা পোশাকে বাংলাদেশ দল খেললেই। অন্য দুই ফরম্যাটে স্কোয়াডে থাকলেও তাইজুলের মাঠে নামা হয় না খুব একটা। টেস্ট এলেই ডাক পড়ে তার। এজন্য বিরতি হয়ে যায় অনেক লম্বা, আলোচনায় থাকা হয় না সেভাবে। পাকিস্তানের সঙ্গে চট্টগ্রাম টেস্টের আগেই যেমন সর্বশেষ টেস্ট খেলেছিলেন সেই শ্রীলংকার সাথে সাত মাস আগে। সর্বশেষ টেস্ট ইনিংসে তার ৫ উইকেট ছিল, সেটাও বোধ হয় অনেকের মনে নেই। এতো দীর্ঘ বিরতিতে খেলা নিয়েও একটু আক্ষেপ আছে তাইজুলের, চট্টগ্রাম টেস্টের তৃতীয় দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে সেটা গোপন করলেন না। তবে তাইজুল মেনে নিয়েছেন এই ভবিতব্য।

    তাইজুল কথা কম বলেন ঠিক, কিন্তু নিজের কাজটা ঠিকই করে যাচ্ছেন সন্তর্পণে। কোভিড পীড়িত গত বছরে খুব বেশি টেস্ট খেলার সুযোগ পাননি, তার আগের বছর ভালো কাটেনি। গত বছর ড্যানিয়েল ভেট্টোরির সাথে কাজ করে কিছুটা বদল এনেছিলেন অ্যাকশনে। কিন্তু আবার এখন ফিরে গেছেন নিজের পুরনো অ্যাকশনে, চট্টগ্রাম টেস্টে তাতেই এসেছে সাফল্য। আজ যেমন তাইজুলদের বোলিং কোচ সোহেল ইসলাম বললেন, এই অ্যাকশনে বদল আনাটা ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে অনেক বড় ঝুঁকি ছিল তাইজুলের জন্য। সেই সাহস ছিল তার। আবার সাফল্য না আসায় পুরনো অ্যাকশনে ফিরে গেছেন আবার, নিজের ধারটা ঠিকই আছে। এই খবরও বা কয়জন জানেন! 

    তবে তাইজুল ঠিকই একটু একটু নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের টেস্টে সেরা বোলিংয়ের কীর্তি তার ছিল অনেক আগে থেকেই, সেটা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কারও একমাত্র ৮ উইকেট। চট্টগ্রামে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ইনিংস শেষে অন্তত দুবার বাংলাদেশের একমাত্র বোলার হিসেবে সাত উইকেটের কীর্তিও হয়ে গেছে। টেস্টে তার নবমবার ৫ উইকেট হয়ে গেছে, যেখানে বাংলাদেশে শুধু সাকিবই তার চেয়ে এগিয়ে। 

    তবে সাকিব না থাকলেই যেন তাইজুলের বোলিংয়ের ধার বেড়ে যায় আরও। সর্বশেষ শ্রীলংকা সফরের দ্বিতীয় টেস্টে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন, সেই টেস্টে ছিলেন না সাকিব। তিনি তখন খেলছেন আইপিএলে। এর আগে চোটের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে নেই সাকিব, সেখানেও তাইজুল নিলেন ৮ উইকেট। সিলেটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তাইজুলের ক্যারিয়ারের ১১ উইকেটের ম্যাচেও ছিলেন না সাকিব। ক্যারিয়ারে যে নয়বার ৫ উইকেট পেয়েছেন, তার মধ্যে শুধু দুবার আকিব ছিলেন দলে। তাইজুল আজ নিজের ভূমিকাটা ব্যাখ্যা করলেন, ‘সাকিব ভাই থাজকলে রোল একরকম হয়, না থাকলে আরেক রকম হয়। সাকিব ভাই নেই,, তাই তার রোলটা আমাকেই পালন করতে হয়েছে। রান চেকেরও একটা চাপ থাকে, উইকেট নেওয়ারও ব্যাপার থাকে। এই দুইটা ব্যাপারই দেখতে হয়। ’

    আবার তাইজুলের দুর্ভাগ্য, তার আলো ছড়ানোর বেশির ভাগ দিনে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা নিয়েই কথা বলতে হয় বেশি। আজও যেমন তার ৭ উইকেটের কীর্তিটা ভেস্তে যেতে বসেছে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা। এই অভিজ্ঞতা হয়েছে সর্বশেষ শ্রীলংকা সফরের পাল্লেকেলেতেও। সেখানে দ্বিতীয় ইনিংসে তার ৫ উইকেটও ঠেকাতে পারেনি দলের হার। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে সিলেটে তো একটা রেকর্ডই করে ফেলেছিলেন। ১১ উইকেট নেওয়ার পরও পরাজয়ের স্বাদ পেতে হয়েছিল তাইজুলকে। 

    কিন্তু সিলেট তো কেবল একটা উদাহরণ, আলো ছড়িয়েও তাইজুলের আড়ালে চলে যাওয়ার উদাহরণ যে অনেক। ২০১৮ সালেই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে দুই ইনিংস মিলে নিয়েছিলেন ৮ উইকেট, কিন্তু ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় সেবারও জেতা হয়নি। নিজের অভিষেক টেস্টেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন, কিন্তু সেবারও হেরে গিয়েছিল দল। শুধু চার বছর আগে এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ইনিংসে ৮ উইকেট নেওয়ার ম্যাচে শেষ পর্যন্ত হাসিটা ছিল তাঁর মুখে। তবে বল হাতে কাজ শেষ হয়নি তখন, ব্যাট হাতেও রাখতে হয়েছিল অবদান। ম্যাচসেরার পুরস্কারটা উঠেছিল তাঁর হাতে। এর বাইরে ইনিংসে অন্তত ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি আর একবারই আছে, ২০১৫ সালে খুলনায় পাকিস্তানের বিপক্ষে। সেবার অবশ্য ম্যাচ বাঁচাতে পেরেছিল বাংলাদেশ, তবে তামিম-ইমরুলের মহাকাব্যিক জুটিতে আড়ালে চলে গিয়েছিলেন তাইজুল।

    তবে তাইজুল জানেন , এটাই তার নিয়তি। আড়লে থাকা নিয়ে তাই ভাবান্তর নেই তার। তার যে নিজের কাজ করে যাওয়াতেই আনন্দ!