• বুন্দেসলিগা
  • " />

     

    ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার: যেভাবে হলেন জার্মানি ও বায়ার্নের ফুটবল সম্রাট

    ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার: যেভাবে হলেন জার্মানি ও বায়ার্নের ফুটবল সম্রাট    

     

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে কেবল। যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানির ক্ষত শুকায়নি তখনো, জার্মানদের মাথার ওপর আর্থিক সংকট আর অনিশ্চয়তার কালো মেঘ।ফুটবল তখন জার্মানদের কাছে যুদ্ধের বিভীষিকা ভুলে থাকার একটা উপলক্ষমাত্র। মিউনিখের এক ছোট্ট ছেলেও ফুটবলেই সঁপে দিল নিজের মনপ্রাণ। সঙ্গীসাথী কেউ ছিল না অবশ্য, বাড়ির সামনে দেওয়ালটাকেই বানাল পাস দেওয়ার একমাত্র সঙ্গী হিসেবে। দেওয়াল তার কথা শুনত খুব, প্রতিটা পাসই তার কাছে ফিরিয়ে দিত ঠিকমতো। সেই ছেলেটাও বড় হতে লাগল দিনদিন, সেই দেওয়ালের গন্ডি পেরিয়ে তার মাথায় উঠল পুরো জার্মানির তাজ। জার্মানির সম্রাট হিসেবে তাকে চিনল লোকে, এবং এরপর পুরো বিশ্ব।

     

    ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের গল্পটা অবশ্য অন্যরকমও হতে পারত। তার বাবা ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার সিনিয়রের ফুটবল-অনুরাগ ছিল না তেমন, ডাকবিভাগের এই কর্মী ছেলের জন্য চেয়েছিলেন নিশ্চিত ভবিষ্যতের কোনো পেশা। কিন্তু ফুটবল যার সবকিছু, তার নিয়তি তো সেখানেই বাঁধা থাকবে। বেকেনবাওয়ারের নিয়তিই ছিল ফুটবলার হওয়া। বায়ার্ন মিউনিখ আর জার্মানি তার নামের সাথে সমার্থক হয়ে গিয়েছিল ,কিন্তু বেকেনবাওয়ার বড় হয়ে উঠেছিলেন বায়ার্নেরই নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী ১৮৬০ মিউনিখের ভক্ত হিসেবে। কিন্তু তার বায়ার্নে যোগ দেওয়ার পেছনেও আছে একটা মজার ঘটনা। যখন তার বয়স ১২, তখন স্থানীয় ক্লাব এসসি ১৯০৬ এর হয়ে ১৮৬০ মিউনিখের বিপক্ষে একটা ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন। প্রতিপক্ষের ক্রমাগত ফাউলে অতিষ্ঠ হয়ে নালিশ করার পর বেকেনবাওয়ারকে উল্টো চড় মারা হলো মুখে। তখনই ঠিক করলেন, ১৮৬০ নয়, বরং তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবে যোগ দেবেন। জার্মান ফুটবলের ইতিহাসের বাঁকবদলও হয়ে গেল সেখানে।

    বেকেনবাওয়ার যখন বায়ার্নে যোগ দিলেন, তখনও বায়ার্ন আজকের মতো জার্মান ফুটবলের অধীশ্বর হয়ে ওঠেনি। বরং সেই ১৯৬৪ সালে বায়ার্ন ছিল জার্মান লিগের দ্বিতীয় বিভাগে। বেকেনবাওয়ার যোগ দিয়েই ক্লাবকে প্রথম বিভাগে নিয়ে এলেন। এরপর বাকিটা ইতিহাস। বায়ার্ন হয়ে উঠল তার সবকিছু। সেই বায়ার্নকে তিনি এসেই জেতালেন জার্মান কাপ আর পরের বছর কাপ উইনার্স কাপ। ১৯৬৮-৬৯ মৌসুমে প্রথমবারের মতো জেতালেন বুন্দেসলিগা। সেই শুরু, এরপর বায়ার্নকে নিয়ে আরও তিনবার জিতলেন লিগ। যে চ্যাম্পিয়নস লিগ তখন ইউরোপিয়ান কাপ নামে পরিচিত, সেই মুকটও পরলেন তিন বার। বেকেনবাওয়ার তখন বায়ার্নের রাজা। তার ‘দের কাইজার’ বা সম্রাট নামের সাথেও জড়িয়ে আছে বায়ার্ন। তখন ১৯৬৯ সালের জুলাই মাস। ফ্রাঙ্কফুর্টের ভাল্ডস্টাডিওনে জার্মান কাপের  ফাইনালে মুখোখুখি শালকা ও বায়ার্ন। শালকার ফরোয়ার্ড রাইনহার্ড লিবুদাকে সামলানোর দায়িত্ব বেকেনবাওয়ারের ওপর। লিবুদার কাছ থেকে একবার দারুণভাবে বল কেড়ে নিলেন বেকেনবাওয়ার। ওদিকে শালকার সমর্থকেরা মাঠে তুলেছে ‘ভুয়া ভুয়া’ রব। বেকেনবাওয়ার জবাবটা দিলেন মাঠেই, প্রায় ৪০ সেকেন্ড ধরে শালকা সমর্থকেরা যে প্রান্তে ছিলেন সেখানে গিয়ে ড্রিবল করলেন। তারপর বল মাঠের বাইরে পাঠিয়ে নিজের বায়ার্নের ব্যাজটা চাপরে দেখালেন। যেন বললেন, ‘এই মাঠে আমিই রাজা।’ পরদিন জার্মান দৈনিক বিল্ডে ছাপা হলো, কিং অফ ভেস্টফালিয়া লিবুদা হার মানলেন জার্মানির কাইজার(সম্রাট) ফ্রাঞ্জের কাছে। সেই থেকে বেকেনবাওয়ারের নাম হলো কাইজার।

     

     

    বেকেনবাওয়ারকে অনেকেই সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডার বলেন, কিন্তু ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন স্ট্রাইকার হিসেবে। তবে বায়ার্নের হয়ে খেলার পর মাঝমাঠে নেমে আসেন। বল পায়ে তাঁর দখল তার দুর্দান্ত পাসিংয়ের জন্য মধ্যমাঠের ভার তাঁর ওপরেই পড়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন, দলের প্রয়োজনে তাকে আরও নিচে নেমে আসতে হবে। এরপর তিনি শুরু করলেন রক্ষণ ও মধ্যমাঠের মাঝে একটা জায়গায় খেলা, যেটা পরিচিতি পায় লিবেরো হিসেবে। এই লিবেরো পজিশনের শুরুটা ফুটবলে তার হাত ধরেই হয়, ফুটবল ট্যাকটিকসের ইতিহাসে আলাদা করে লেখা থাকবে তার নাম।

     

    ৪.

    বেকেনবাওয়ারকে অবশ্য পুরো বিশ্ব সম্রাট হিসেবে চিনেছে জার্মানির জার্সি গায়ে দেওয়ার জন্যই। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে তার দায়িত্ব ছিল ইংল্যান্ডের ববি চার্লটনকে মার্ক করা। সেই ফাইনালে অবশ্য জার্মানি হারাতে পারেনি ইংল্যান্ডকে, তবে চার বছর পর ইংল্যান্ডকে আরেকটি বিশ্বকাপে হারিয়েছিলেন ঠিকই। ১৯৭০ বিশ্বকাপেই ইতালির বিপক্ষে খেলার সময় নড়ে গিয়েছিল কাঁধের হাড়, সেই ভাঙা হাড় নিয়েই খেলেছিলেন বাকি ম্যাচ। জার্মানির অবশ্য সেই ম্যাচেও জেতা হয়নি, ৪-৩ গোলে হেরে যাওয়া সেই ম্যাচকে শতাব্দির সেরা ম্যাচও বলেন কেউ কেউ। তবে চার বছর পর বিশ্বকাপে আর হারেননি তিনি। ইয়োহান ক্রুইফের নেদারল্যান্ডসের টোটাল ফুটবলের সৌরভে বিশ্ব তখন মাতোয়ারা। কিন্তু বেকেনবাওয়ারের নিখুঁত জার্মানির কাছে হারতে হলো ক্রুইফদেরও। ২০ বছর পর আবার বিশ্বকাপ ফিরে এলো জার্মানিতে। এর মধ্যে জার্মানির হয়ে ইউরোও জেতা হয়ে গেছে তার। তবে জাতীয় দলের অধ্যায়ে যতি পড়ল একটু আগেভাগেই। করসংক্রান্ত নানা সমস্যায় ১৯৭৭ সালে জার্মানি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক কসমসে নাম লেখালেন। সে সময় আবার জার্মানির বাইরের লিগে কোনো ফুটবলারকে জাতীয় দলে না নেওয়ার একটা অলিখিত নিয়ম ছিল। বেকেনবাওয়ার আবার ফিরে এসেছিলেন জার্মানিতে, তবে হামবুর্গের হয়ে পেশাদার ক্যারিয়ারের চোটজর্জর শেষ সময়টা ভুলেই যেতে চাইবেন। জার্মানির হয়ে আবার ফিরলেন, কিন্তু এরপর অন্য ভূমিকায়।

     

    ১৯৮৪ ইউরোর ব্যর্থতার পর জার্মান ফুটবলে দরকার হলো নতুন একজন কোচের। পাদপ্রদীপে আবার বেকেনবাওয়ার। খুব একটা কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা তখনো না থাকলেও ১৯৬৮ বিশ্বকাপে তিনিই জার্মানির হয়ে দাঁড়ালেন ডাগআউটে। দিয়েগো ম্যারাডোনা সেই বিশ্বকাপে অতিমানব না হয়ে দাঁড়াকে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে হয়তো সেবারই কোচ হিসেবে তার শিরোপা জেতা হয়ে যেত। সেবার না হলেও ১৯৯০ বিশ্বকাপে ঠিকই জিতেছিলেন বেকেনবাওয়ার। খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জেতা মাত্র দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন তিনি। কী অদ্ভুত কাকতাল, সেই কীর্তি প্রথম গড়া ব্রাজিলের মারিও জাগালোও মাত্র কদিন আগেই পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তলোকে।

     

    বেকেনবাওয়ার জার্মান ফুটবলের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হয়ে গেছেন তার অনেক আগেই। এমনকি কোচিং ছাড়ার পরও ফুটবল আর বায়ার্নের মায়া ছাড়তে পারেননি। বায়ার্নের সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন, জার্মানিকে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে স্বাগতিক করার পেছনে তাঁর ফুটবল-দূতিয়ালির ছিল বড় ভূমিকা। ফুটবল প্রশাসক হিসেবে সময়টা একেবারে ভালোও যায়নি, একটা সময় দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল তাঁর নাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই প্রমাণ হয়নি তাঁর বিরুদ্ধে।

     

     

    জার্মানি আর বায়ার্নের হয়ে বিশ্বকাপ, ইউরোপ, বুন্দেসলিগা, ইউরোপিয়া কাপসহ এত সব অর্জন, একমাত্র ডিফেন্ডার হিসেবে দুবার ব্যালন ডি অর জয়- বেকেনবাওয়ারের মতো এমন বর্ণাঢ়্য শোকেস খুব কম ফুটবলারেরই আছে। কিন্তু বেকেনবাওয়ারের সবচেয়ে বড় পরিচয় জার্মান ফুটবলের অবিসংবাদিত মুখ হয়ে ওঠা। জার্মানিতে তাঁর প্রভাব এতোটাই, ২০০১ সালে একবার বায়ার্নের খারাপ পারফরম্যান্সের পর চাছাছোলা ভাষায় তাদের সমালোচনা করেছিলেন, বলেছিলেন বায়ার্ন একদল পেনশনভোগীদের ক্লাব হয়ে উঠেছে। সেখান থেকে প্রেরণা নিয়ে দুই মাস পর চ্যাম্পিয়ন হয় বায়ার্ন। কোচ বা খেলোয়াড় বাদ দিলেও প্রশাসক, সংগঠক, বিশ্লেষক- জার্মান ফুটবল মানেই বেকেনবাওয়ার। এজন্যই তিনি জার্মানির সম্রাট, যে মুকুট তাঁর কাছ থেকে হয়তো কেড়ে নিতে পারবে না কেউই।