• নিউজিল্যান্ডের ইংল্যান্ড সফর
  • " />

     

    স্টোকস-ম্যাককালামে যেভাবে ইংল্যান্ডের তুলকালাম

    স্টোকস-ম্যাককালামে যেভাবে ইংল্যান্ডের তুলকালাম    

    খেলোয়াড়েরা খেলবে, টিম ম্যানেজমেন্ট কী?

    এইতো গেল বছরের জুন। জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের সামনে লক্ষ্য ছিল ৭৫ ওভারে ২৭৩ রানের। ওভারপ্রতি প্রয়োজনীয় রান চারের কম, ৩.৬৪। ইংল্যান্ড ম্যাচটা শেষ করেছিল ২.৪২ রানরেটে ব্যাট করে। 

    এবার আসুন চলতি বছরের জুনে। জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের সামনে লক্ষ্য ছিল ২৯৯ রানের, বাকি আড়াই সেশনের মতো, কমপক্ষে ৭২ ওভার। ওভারপ্রতি প্রয়োজনীয় রান চারের বেশি। ইংল্যান্ড ম্যাচটা শেষ করেছিল ৫.৯৮ রানরেটে ব্যাট করে। 

    প্রথম ঘটনাটা ছিল সিলভারউড-রুটের ইংল্যান্ডের। দ্বিতীয়টা ম্যাককালাম-স্টোকসের ইংল্যান্ডের। যে ইংল্যান্ড তাদের আগমনী বার্তা দিয়ে গেল টানা দুই টেস্টে লক্ষ্য তাড়া করে জিতে। 

    ***

    বেন স্টোকসের লড়াকু, আক্রমণাত্মক মনোভাবের কথা সবারই জানা। ব্রেন্ডন ম্যাককালামও তো একই ধাঁচের চিন্তাভাবনায় বিশ্বাসী। ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টের পঞ্চম দিনের পূর্বে ম্যাচ দাঁড়িয়ে ছিল সব ধরনের ফলাফল নিয়েই। নিউজিল্যান্ডের হাতে তিন উইকেট নিয়ে লিডসহ পুঁজি ২৩৮ রানের। পঞ্চম দিনের সকাল-সকাল কিউইদের অলআউট করে ইংল্যান্ড যে লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তা অনুমান করে নিতে কষ্ট হবে না কারোরই। সেটি ম্যাককালাম-স্টোকসের ইংল্যান্ড বলেই! 

    তবে ইংল্যান্ড যেভাবে খেলল, সেটা নিশ্চয়ই কারো কল্পনাজগতেও ঠাই পায়নি। ইনজুরিতে কাইল জেমিসনের বোলিং পায়নি নিউজিল্যান্ড, তবু ৫০ ওভারেই ২৯৯ রান তাড়া করে জেতা অবিশ্বাস্যই বটে! আর জনি বেইরস্টোর ব্যাটিং? সেটা বুঝানোর জন্য ‘অবিশ্বাস্য’ শব্দটাও কম পড়ে যায় হয়তো! শেষ সেশনে ১৬০ রান নিতে ইংল্যান্ডের হাতে ছিল ৩৮ ওভার। স্বীকৃত সাত ব্যাটসম্যানের চারজনেরই ততক্ষণে প্যাভিলিয়নে ফেরা সারা। অথচ ইংল্যান্ডের দরকার পড়লো মাত্র ১৬ ওভার! 

    একেবারে পয়সা উসুল বিনোদেন যাকে বলে! কিন্ত ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টের পঞ্চম দিনে থাকা সতেরো হাজারের মতো দর্শকদের তো আসলে কোন পয়সাই খরচ করতে হয়নি, ফ্রি টিকেট ছেড়েছিল ট্রেন্ট ব্রিজ। এমন 'বিনোদন' যদি মেলে, তবে পয়সা খরচ করতেও কারো আপত্তিই তো থাকবে না অবশ্য!

    নিউজিল্যান্ডকে 'অসহায়' বানিয়ে ফেলার দুই কারিগর!

    স্টোকস আর বেইরস্টোর জুটিতে ওভারপ্রতি রান উঠেছে ৮.৮৭ করে। শতরানের পার্টনারশিপগুলোর মধ্যে এই জুটির রানরেট তৃতীয় সর্বোচ্চ। এ জুটি ড্রেসিংরুমে বসে নিশ্চয়ই উপভোগ করেছেন ইংল্যান্ড কোচ ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। তবে এমন বিধ্বংসী জুটির সঙ্গে কিন্ত এর আগে থেকেই পরিচয় আছে তার। পরিচয় কি, তিনি তো সেরকমই এক জুটির একজন রচয়িতাই আসলে! শতরানের পার্টনারশিপগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানরেট ছিল যে জুটিতে, সেটির একপাশে তো ছিলেন ব্রেন্ডন ম্যাককালামই।  

    ***

    অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০১৬ সালে ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে ম্যাককালাম-আন্ডারসনের জুটি থেকে এসেছিল ১৭৯ রান। বেইরস্টো-স্টোকসেরও এ জুটি থেকে এসেছে সমান রান। তবে ম্যাককালাম বেইরস্টোকে মজা করে খোঁচা দিতেও পারেন এই বলে যে, তাদের জুটিতে বল লেগেছিল ১১টি কম! বেইরস্টো-স্টোকস জুটিতে ১২১ বলে এসেছে ১৭৯ রান। 

    স্টোকস সে জুটিতে শুরু থেকেই আগ্রাসী ছিলেন। ডাউন দ্যা উইকেটে এসে ছয়ের পর রিভার্স সুইপে চার। এমন ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলে স্টোকস আগ্রাসী থেকেছেন তার মতোই। কিন্ত বেইরস্টোর এদিনের ঝড় তো যে কাউকেই আড়াল করে দিবে। টেস্ট ক্রিকেটে রেকর্ড লক্ষ্যতাড়ায় ৯২ বলে ১৩৬ রান। ৪৮ বলে ৪৩ রানে চা-বিরতিতে যান বেইরস্টো, এসে আউট হওয়ার আগে করেন ৪৩ বলে ৯৩ রান! 

    চা-বিরতির পর তৃতীয় ওভার করতে এসে ম্যাট হেনরি লেগ সাইডে বাউন্ডারিতে রেখেছিলেন তিন ফিল্ডার। আগের দুই ওভারের আসা ২৬ রানেই ঝড়ের আভাস পেয়ে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ড, তাই এমন ফিল্ডসেট। হেনরি রাউন্ড দ্যা উইকেটে এসে ছুড়লেন বাউন্সারের পর বাউন্সার, বাইরে ফিল্ডার দেখে বেইরস্টো তা ছেড়ে দিবেন? তাহলে তো আর ‘অবিশ্বাস্য’ কিছু রচনা করা হয় না! বাইরে থাকা ওই ফিল্ডারদের মাথার উপর দিয়ে একই ওভারে দুবার বল গিয়ে পড়লো সীমানার বাইরে! 

    ড্রেসিংরুমে যখন টেস্ট ক্রিকেটের দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান (৫৪ বলে) বসে থাকেন, বস(হেড কোচ) যখন সাদা পোষাকে চার সেঞ্চুরি করেন এক শ বলের কম নিয়ে, তখন বেইরস্টোর এমন ব্যাটিংয়ের সাহস পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না! সেইসাথে ক্যাপ্টেনের মুখ থেকে যখন বেইরস্টো শুনতে পান, ‘মাটিতে মারার কথা ভুলেও ভাবিও না, সোজা গ্যালারিতে মারো…’ তখন তাকে আর আটকায় কে! 

    ***

    কোচ ব্রেন্ডন ম্যাককালাম টেস্ট ইতিহাসেরই দ্রুততম সেঞ্চুরিটা করেছেন মাত্র ৫৪ বলে। বেইরস্টোর সুযোগ ছিল ইংল্যান্ডের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডের মালিকানা হাসিল করার। বেইরস্টো ৬৫ বলে পৌঁছে গিয়েছিলেন ৮৪ রানে। রেকর্ডের একক মালিকানা লাভের জন্য হাতে ছিল ১১ বল। সেই ১৯০২ সালে জোসেপ গিলবার্ট ৭৬ বলে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। ম্যাচশেষে বেইরস্টো জানালেন, রেকর্ডটার কথা জানতেন না তিনি। জানলে হয়তো গিলবার্টের চেয়ে এক বল বেশি নিতেন না বেইরস্টো। দিনটা যে ছিল তার কথামতো সবকিছু হওয়ারই দিন!

    অথচ বেইরস্টোসহ ইংল্যান্ড দলেরই অতীতে ফেলে আসা দিনগুলির বেশিরভাগই ছিল তাদের কথামতো না হওয়ার। এই সিরিজের আগে ১৭ টেস্টে মাত্র ১ জয়, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের পয়েন্ট টেবিলের তলানীতে। বারো মাস আগেই ইংল্যান্ড ৭৫ ওভারে ২৭৩ রানের লক্ষ্য পেয়ে ড্র করেছিল ৭০ ওভারে ১৭০ রান তুলে! এবছরের জুনে ইংল্যান্ড ৭২ ওভারে ২৯৯ রান তাড়া করতে নেমে চতুর্থ উইকেট ৯৩ রানে হারিয়েও জিতেছে ২২ ওভার বাকি রেখেই।  

    উড়ন্ত বেইরস্টোকে আর আটকায় কে!

    রুট-সিলভারউডের অধীনে ড্র করা ওই ম্যাচ নিয়ে রুট বলেছিলেন, পিচে অসমান বাউন্স থাকায় ততটা সহজ ছিল না লক্ষ্য তাড়ায় যাওয়া। সে সাহসটুকু না করার পিছনে ইংল্যান্ডের দুর্দশাও হয়তো কারণ ছিল। স্টোকস-বাটলারবিহীন ব্যাটিং লাইনআপটাও বেশ অনভিজ্ঞও ছিল। তবু তার দলের খেলা শুরু থেকেই বুঝিয়ে দিচ্ছিলো, জয়ের উদ্দেশ্য নেই তাদের। অথচ সেটি ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের অংশ ছিল না বলে পয়েন্ট খোয়ানোরও শঙ্কা ছিল না। 

    আর ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্ট ড্র করতে পারলেই ইংল্যান্ডের সিরিজের সমীকরণে হারের অস্তিত্ব থাকত না। কিন্ত স্টোকস-ম্যাককালামের ইংল্যান্ডের নীতিবাক্য যে বলে- অবস্থা যেমনই হোক, জয়টাই প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য! 

    ***

    স্টুয়ার্ট ব্রড চতুর্থ দিন শেষেই বলে দিয়েছিলেন, নিউজিল্যান্ড যতই করবে, তাতেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। ব্রড-বেইরস্টোরা জানেন এই ইংল্যান্ড কিভাবে খেলতে চায়। এই ম্যানেজমেন্ট তাদের মাথায় তা ঢুকিয়ে দিয়েছে ভালো করেই। স্টোকস ও ম্যাককালাম দুজনেই যে একই চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। সেই ইংল্যান্ড শুরুতে করা ওই প্রশ্নটার উত্তরও দিয়ে দিল। খেলার দায়িত্ব খেলোয়াড়দের ঠিক, তবে সেই খেলার ধরনে ম্যানেজমেন্টের ভূমিকাও কম না। বরং অনেক বেশিই!

    অবশ্য আমাদের এখানে তো ম্যানেজমেন্ট বলতে বোঝায় ভিন্ন কিছুই। যেখানে অধিনায়কই নিজেকে সে টিম ম্যানেজমেন্টের অংশ বলে মানেন না। টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ অনেকবারই দলের ব্যাপারে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে উত্তরে তিনি বলেছেন, ম্যানেজমেন্ট ভালো বলতে পারবে। শোনা যায়, সেই ম্যানেজমেন্টকে নাকি ম্যানেজ করা হয় বাইরে থেকেই! 'ঘরের' সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে 'বাহির'ও!

    এইতো ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে উড়াল দেবার আগে তামিম ইকবালের যে টি-টোয়েন্টি বিতর্কের শুরু হলো, সেটির পরে এক সাক্ষাৎকারে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান বলেছেন, তামিম চাইলেই নাকি টি-টোয়েন্টিতে খেলতে পারবেন। কিন্ত গণমাধ্যমের বরাতে তো খবর পাওয়া গিয়েছিল, টি-টোয়েন্টিতে অধিনায়ক ও কোচের চোখে দলে জায়গা হয় না তামিম ইকবালের। তাহলে বিসিবি সভাপতি যে ওমন নিশ্চয়তা দিয়ে বলে দিলেন? ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত বলেও যে কিছু আছে, সেটি উল্লেখ করলেন না একটিবারও! 

    ওসব যেমন চলে, তেমনই চলবে, চলুক না! আমরা বরং প্রস্তুত থাকি স্টোকস-ম্যাককালাম যুগলবন্দীর সঙ্গে উপভোগ্য এক যাত্রার জন্য!