দেশীয় ফুটবল পেশাদারিত্ব, জেমস বাটলার ও একটি মেকি কান্নার গল্প।
পোস্টটি ৮০ বার পঠিত হয়েছেছবির প্রথম ভদ্রলোককে অনেকেই চিনে থাকবেন। না চিনলেও সমস্যা নাই, আমি চিনিয়ে দিচ্ছি। তার আগে একটা প্রশ্ন রাখি- ২১ নাম্বার জার্সি পরিহিত খেলোয়াড়কে চিনতে পেরেছেন?
ছবির বাম পাশের ব্যক্তি এবং ২১ নাম্বার জার্সি পরিহিত খেলোয়াডের পিছনে দাঁড়িয়ে পর্ববেক্ষকের ভূমিকায় থাকা ব্যক্তিটি একজনই। তিনি লোডভিক ডি ক্রুইফ। আর অনুশীলনরত খেলোয়াড়টি বাংলাদেশ ফুটবলের আক্ষেপ, নাম ওয়াহেদ।
ডি ক্রুইফকে নেদারল্যান্ডস থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছিলো বাংলাদেশ ফুটবলকে বদলে দিতে। অন্তত, মানে ও খেলায় যেন তিনি কিছুটা হলেও পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারেন। ডি ক্রুইফ মানুষ হিসেবে দারুণ, তবে তিনি ম্যাজিক জানেন না। হাটের ধারে বসে ম্যাজিশিয়ানরা যেমন সস্তা ম্যাজিক দেখিয়ে সবাইকে স্তব্দ করে চোখেমুখে মারাত্মক আশ্চর্যান্বিত করেন, ডি ক্রুইফ তার কিছুই জানেন না। তাকে যখন আনা হয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল তখন বরাবরের মতোই ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের তলানিতে। তিনি এসেই সব ঠিকঠাক করে দলকে বিশ্বমানের করে তুলবেন আর দু'হাতে শিরোপা জিতবেন- এমন আশা নিশ্চয়ই কোনো পাগলেও করতোনা। তবে তিনি যে একটা পরিবর্তন নিয়ে আসতে সক্ষম ছিলেন, তাতে কারো সন্দেহও ছিলো বলে মনে হয় না।
কিন্তু পরিবর্তনটা হবে কিভাবে?
খেলাধুলার মান কি শুধু মাঠের খেলাতেই নির্ধারিত হয়, নাকি অন্যান্য অনেক বিষয়ই এখানে জড়িত আছে? আরো স্পষ্ট করে বললে- ব্যায়াম, খাবারদাবার, নিয়মানুবর্তিতা কিংবা প্রতিশ্রুতি। ডি ক্রুইফ দুটো বিষয়ে প্রথমেই নজর দিলেন; প্রথমত, নিয়মিত অনুশীলন আর দ্বিতীয়ত, খাবারদাবারে পরিবর্তন। নিয়মিত অনুশীলন না হয় করা গেলো; কিন্তু ডায়েট মেনে খাবারদাবার? সেটা কি আর বাংলাদেশি ফুটবলাররা মানবেন? তারা মানলেন না। অনুশীলনের আগে পেটভরে গরম ভাত আর ফ্যাট যুক্ত খাবার খেয়ে আসেন তারা। ডি ক্রুইফ বুঝতে পারলেন অন্তত আর যাইহোক, তাদের খাবারদাবার রুটিন তিনি বদলাতে পারবেন না।
এরপরে আসলো অনুশীলনের ব্যাপার। খেলোয়াড়েরা জিমে ঘাম ঝরানোর চেয়ে মনোযোগী বেশি ম্যাচ খেলায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগে যখন ক্যাম্প ডাকতেন কোচ, সঠিক সময়ে ক্যাম্পে আসাটাকে কেউ কেউ খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না। এই যেমন ওয়াহেদ আহমেদের কথাই ধরা যাক; শুরুতেই যাকে আমি বাংলাদেশ ফুটবলের আক্ষেপ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি।
ওয়াহেদ আহমেদ একসময় মোহামেডান কাঁপিয়েছেন। দলকে টানা দ্বিতীয়বার সুপারকাপ জেতানোতে ১৫ গোলের অবদান ছিলো তার। কি দারুণ সময়টাই না পার করছিলেন। ২০১৩ সালে সাফে, পরের বছর এশিয়ান গেমসের জাতীয় দলে জায়গা হলো তার। ডি ক্রুইফ তখন সদ্য এসেছেন। ওয়াহেদকে তিনি হয়তো এক ভিন্ন পরিচয়ে গড়ে তুলতেন। কিন্তু পেট খারাপ, জ্বর- সর্দিকাশি আর শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে ওয়াহেদ বারবারই ডি ক্রুইফের ক্যাম্পে যাওয়ার ডাক অবজ্ঞা করেছেন। কিন্তু এই সময়ে সিলেটের আনাচে-কানাচেতে 'খ্যাপ' খেলে পকেট গরম করলেও নিজের জাত আর প্রতিভা- দুটোরই যে অপচয় করছিলেন ওয়াহেদ তা তিনি কি এখন বুঝতে পারেন?
ওয়াহেদ আহমেদের সাথে আমার ১ম পরিচয় তেমনই এক খ্যাপ ম্যাচে। তিনি খ্যাপ খেলতে এসেছেন সিলেটের গোলাপগঞ্জের এক মাঠে। সে মাঠে মামুন মিয়া, আলফাজ- আরমান কিংবা আমিনুলদের আমি প্রায়ই দেখতাম খেলতে। কিন্তু ওয়াহেদের মতো কেউ ক্যাম্প ফাঁকি দিয়ে খেলতে এসেছেন এমনটি শুনিনি। অথচ ওয়াহেদ ছিলেন একজন প্রলিফিক নাম্বার নাইন। কি তার গতি, খেলার ধরন আর কৌশল। অত্যন্ত মেধাবী, বয়সে তরুণ আর টগবগে শরীর। যখন বল নিয়ে দৌড়াতেন, বেশ লাগতো। জাহিদ হাসান এমিলিকে কেউ কেউ মনে রাখতে চাইবেন, বাংলাদেশের জার্সিতে যার ১৫ টা আন্তর্জাতিক গোল আছে। আমার ধারণা ওয়াহেদ আহমেদ ফুটবলকে যদি সঠিকভাবে ভালোবেসে ধারণ করতে পারতেন, এমিলির নাম কেউ মনে রাখতো না।
অন্যান্য দেশের ফুটবলারদের অভিষেক যেখানে হয় ২৫/২৬ বছর বয়সে, ওয়াহেদ অবসর নিয়ে নিলেন এই বয়সেই! বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে ফুটবলে আসা, আর নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে যুক্তরাজ্যে রেস্তোরা ব্যবসায় নিজেকে উজাড় করে দেয়া! কি আক্ষেপটাই না রেখে গেলেন দেশের ফুটবলের জন্য।
এতো বছর পর ওয়াহেদ আহমেদের জন্য মায়াকান্না করতে লেখা শুরু করি নি। লেখার বিষয় ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। গতকাল থেকে দেখছি দেশের নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়েরা কান্নাকাটি করে মিডিয়া সয়লাব করে ফেলছেন। তাদের দাবি একটাই, যেকোনো মূল্যে কোচ জেমস বাটলারকে সরে ফেলতে হবে। কারণ বাটলার নাকি তাদেরকে মানষিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। এর বিপরীতে 'মেকি কান্না' আর 'ড্যাম কেয়ার' এটিটিউড ছাড়া তারা আর কোনো যুক্তি দিতে পারছেন না।
কিন্তু পরিবর্তনটা হবে কিভাবে?
খেলাধুলার মান কি শুধু মাঠের খেলাতেই নির্ধারিত হয়, নাকি অন্যান্য অনেক বিষয়ই এখানে জড়িত আছে? আরো স্পষ্ট করে বললে- ব্যায়াম, খাবারদাবার, নিয়মানুবর্তিতা কিংবা প্রতিশ্রুতি। ডি ক্রুইফ দুটো বিষয়ে প্রথমেই নজর দিলেন; প্রথমত, নিয়মিত অনুশীলন আর দ্বিতীয়ত, খাবারদাবারে পরিবর্তন। নিয়মিত অনুশীলন না হয় করা গেলো; কিন্তু ডায়েট মেনে খাবারদাবার? সেটা কি আর বাংলাদেশি ফুটবলাররা মানবেন? তারা মানলেন না। অনুশীলনের আগে পেটভরে গরম ভাত আর ফ্যাট যুক্ত খাবার খেয়ে আসেন তারা। ডি ক্রুইফ বুঝতে পারলেন অন্তত আর যাইহোক, তাদের খাবারদাবার রুটিন তিনি বদলাতে পারবেন না।
এরপরে আসলো অনুশীলনের ব্যাপার। খেলোয়াড়েরা জিমে ঘাম ঝরানোর চেয়ে মনোযোগী বেশি ম্যাচ খেলায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগে যখন ক্যাম্প ডাকতেন কোচ, সঠিক সময়ে ক্যাম্পে আসাটাকে কেউ কেউ খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না। এই যেমন ওয়াহেদ আহমেদের কথাই ধরা যাক; শুরুতেই যাকে আমি বাংলাদেশ ফুটবলের আক্ষেপ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি।
লেখার বিষয় ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। গতকাল থেকে দেখছি দেশের নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়েরা কান্নাকাটি করে মিডিয়া সয়লাব করে ফেলছেন। তাদের দাবি একটাই, যেকোনো মূল্যে কোচ জেমস বাটলারকে সরে ফেলতে হবে। কারণ বাটলার নাকি তাদেরকে মানষিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। এর বিপরীতে 'মেকি কান্না' আর 'ড্যাম কেয়ার' এটিটিউড ছাড়া তারা আর কোনো যুক্তি দিতে পারছেন না।
অথচ বাটলারকে তারা চিনতেই পারলো না।
হাডার্সফিল্ড টাউন, ক্যামব্রিজ কিংবা ওয়েস্ট হ্যাম, হ্যালিফ্যাক্স কিংবা ওয়েস্ট ব্রমিচের হয়ে প্রফেশনাল ফুটবল খেলা এই কোচকে তারা পান্তাভাত মনে করে বসে আছেন। ইংল্যান্ডের নামিদামি এতসব ক্লাবে খেলা ও পরে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই মানুষটাকে তারা বদনামি প্রমান করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। তবে এই অধ্যায়ের কাড়ি নাড়ছেন সিনিয়র কিছু খেলোয়াড়, যাদের জাতীয় দলে খেলার মতো মান নাই; কিংবা ভাত নাই।
দেড় ডজন খেলোয়াড়দের মধ্যে কয়েকজনের অভিযোগ মারাত্মক হাস্যরসাত্মক বটে। ঋতুপর্ণা চাকমা নামের এক খেলোয়াড় জানিয়েছেন বাটলার নাকি ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে হস্তক্ষেপ করেন। কারণ তারা বাইরে ঘুরতে, কফি খেতে বেরুন। আবার এক ম্যাচে ভুল পাস দেয়ায় তাকে সাবস্টিটিউট করেছেন বাটলার। ঋতুপর্ণার কাছে প্রশ্ন; মারিও বালোতেল্লির নাম শুনেছেন? আর তার একসময়ের কোচ রবার্তো মানচিনি? শুধুমাত্র প্রেক্টিস সেশনে সতীর্থদের সাথে ফাইজলামি করার কারণে একবার তাকে স্কোয়াডেই রাখা হয়নি; আরেকবার সহজ গোল মিস করেছিলেন অত্যন্ত বাজেভাবে কিন্তু ইচ্ছে করেই। মানচিনি তাকে ৩০ সেকেন্ডের ব্যবধানেই বদলি করেছেন। ফুটবল ইতিহাস ঘাটলে এমন হাজারো ঘটনা পাওয়া যাবে, যেখানে প্লেয়ারদের অপেশাদারি আচরণের জন্য কোচেরা সাতপাঁচ না ভেবে মুহুর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা তার কাছে সঠিক মনে হয়েছে।
আমি ডমেস্টিক লেভেল ফুটবলের কথা বলছি না। এখানে কথা হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ের। একজন জাতীয় দলের খেলোয়াড় কিভাবে এমন বস্তাপঁচা যুক্তি আর অভিযোগ এনে কোচের বিদায় চাইতে পারেন আমার মাথায় ধরেনা। তাও দেশের প্রথম সারির মিডিয়ার সামনে! জেমস বাটলার যখন এসব অভিযোগ শুনে তাদেরকে মিটিংয়ে ডাকলেন, তারা আবার কেউ উপস্থিত হলো না! এই ধৃষ্টতা দেখানোর বয়স, পরিপেক্ষতা এবং ক্ষমতা তাদের কিভাবে হলো সেটাও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। কতটুকু অপেশাদারি আচরণ হতে পারে ফুটবলারদের এমন উদ্যোগ সেটা বিবেচনার বিষয় তো বটেই।
ডি ক্রুইফের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ছিলো বাফুফের। অথচ মাসের পর মাস তার বেতন পরিশোধ করেনি তারা। সারা বছর কাজ নেই, তাই তাকে হলিডেতে পাঠিয়ে দেয়া- কিংবা হলিডে থেকে ফিরে এসে জানানো হলো তার চাকরিটাই চলে গেছে- এমন পেশাদারি আচরণ তো বাফুফেই করেছে! ওয়াহেদ আহমেদ আমার এই লেখা দেখলে নিশ্চয়ই রাগ করবেন, কিন্তু এটা কি অস্বীকার করতে পারবেন তিনি অপেশাদারিত্বের পরিচয় দেন নি বারবার? তার দেখাদেখি তকলিস, ইয়ামিন মুন্না, জনি'রা তো সে পথেই হেঁটেছেন একসময়!
খেয়াল করে দেখুন, পিটার জেমস বাটলার কোচ হিসেবে খারাপ এটা কিন্তু কেউ বলছেন না। তারা বলছেন বাটলার তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও কথা তুলছেন। এখানে একটা উদাহরণ টানা যায়; পেপ গার্ডিওলা একবার মধ্যরাতে হোটেলে খেলোয়াড়দের ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। অদ্ভুতুড়ে এই ঘটনায় তার কাছে জানতে চাওয়া হলো কি এমন হয়েছে যে তাকে খেলোয়াড়দের কক্ষে আসতে হলো এতো রাত করে?
তিনি জানালেন একটা নতুন কৌশল মাথায় এসেছে। সেটাই খেলোয়াড়দের জানাতে ও একবার ঝালিয়ে নিতে এসেছেন মধ্যরাতে! খেলোয়াড়দের সাথে এমন আন্তরিক সম্পর্ক আছে বলেই হয়তো পেপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা কোচদের একজন।
বাটলারকে তাদের মনে ধরছে না ঠিক কি কারণে সেটা বলতে পারছেন না খেলোয়াড়েরা। তবে তারা নিজেরা যে বাটলারের সাফল্যের পথে বাঁধা হয়ে পড়ছেন এটা বুঝতে পারছেন না। জেমস বাটলারকে আসলে তারা চিনতে ভুল করেছেন।
বাটলারও অবশ্য কম যান না, তিনি তো বলেই দিয়েছেন- দল নির্বাচনের জন্য তার কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ খেলোয়াড় আছেন।
এটা স্রেফ একটা মশকরা বৈ কিছু না। একজন আন্তর্জাতিক মানের কোচকে বাজেভাবে হেনস্তা করা।
আসলে এদেশে উন্নয়ন আসলে কেউ চায় না। সবাই সবার অবস্থান থেকে তার সুবিধাটা চায়। সুযোগের অভাবে আমরা সবাই ভালো; সুযোগ না পেলে মুখ হয়ে যায় কালো। সমস্যাটা ডি ক্রুইফ কিংবা বাটলারের নয়- সমস্যাটা আমাদের। আমরা বিষফোঁড়া নিয়ে বাঁচতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করি, কিন্তু এর প্রতিকার করতে চাই না।
- 0 মন্তব্য