দিনো জফ ও একটি স্বপ্ন ছোঁয়ার গল্প
পোস্টটি ৩৩৯২ বার পঠিত হয়েছেস্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার জন্য আপনি ঠিক কতদূর পর্যন্ত যেতে পারবেন?
কালে কালে ফুটবলে আবির্ভাব ঘটেছে অসংখ্য মহাতারকার, যারা খেলাটাকে রাঙিয়ে গেছেন, সবার মন জয় করে নিয়েছেন, পৌঁছে গেছেন অন্য উচ্চতায়। বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন, অসংখ্য ট্রফি দিয়ে পরিপূর্ণ করেছেন তাদের ঝুলি। এর মাঝে আবার এসেছেন কিছু হতভাগা, যারা নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন, কিন্তু কিছু কিছু শিরোপা কখনো ছুঁয়ে দেখা হয়নি। অপ্রাপ্তি নিয়েই শেষ পর্যন্ত ক্ষান্ত দিয়েছেন, বিদায় জানিয়েছেন ফুটবলকে।
কিন্তু এদের বাইরেও আছেন কিছু কিংবদন্তি, যারা লড়াই করে গেছেন দাঁতে দাঁত চেপে। ব্যর্থ হয়েছেন অসংখ্যবার, কিন্তু হাল ছাড়েননি। শিরোপা না জিতে যেন তাঁদের ঘরে ফেরা মানা। বয়সের ভারে আক্রান্ত হয়েছে শরীর, কিন্তু শিরোপা জয়ের নেশা তাঁদের করেছে অদম্য, অপ্রতিরোধ্য। অবশেষে শেষ পর্যন্ত তারা ছুঁয়েছেন নিজেদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য, আরাধ্য শিরোপা জয় করে তবেই ফিরেছেন ঘরে।
১৯৪২ সাল৷ চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিটলারের জার্মানির সাথে হাত মিলিয়ে বিশ্বের বুকে ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মুসোলিনির ইতালি। ফিফা বিশ্বকাপে আগের দুবারই শিরোপা জয় করেছে ইতালি, নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে ফুটবল দুনিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে। অতঃপর সেবছরই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো বিশ্বকাপের চতুর্থ আসর। কিন্তু যুদ্ধের দামামায় কোটি কোটি লোকের জীবন যেখানে শঙ্কায়, সেখানে ফুটবলের কথা কে মনে রাখে?
ঠিক এরকম একটা সময়ে ইতালির উত্তরপূর্ব অঞ্চলের ছোট শহরতলি মারিয়ানো ডেল ফ্রিউলি তে জন্মগ্রহণ করেন দিনো জফ। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলে তাঁর ছিলো বেশ ঝোঁক। তবে কিশোর বয়সে শারীরিকভাবে বেশ ক্ষীনকায় ছিলেন জফ। তাই তাঁর বাবা কখনোই ছেলের ফুটবল ক্যারিয়ার নিয়ে খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না। বাবার পরামর্শে তাই ফুটবলের পাশাপাশি মেকানিকের কাজকর্মও রপ্ত করে ফেলেছিলেন জফ।
বাবার আশঙ্কা প্রায় ফলেই যাচ্ছিলো। ১৪ বছর বয়সে ইতালিয়ান জায়ান্ট জুভেন্টাস ও ইন্টার মিলানে ট্রায়াল দেন জফ। কিন্তু দুই জায়গাতেই উচ্চতা ও গঠনগত কারণে ছিটকে যান। এর পাঁচ বছর পর উদিনেসে প্রথমবারের মতো তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়। এর কৃতিত্ব অবশ্য দিতে হবে তাঁর দাদিকে, যিনি নিয়মিত ডিম খাইয়ে জফকে শারীরিকভাবে দারুণ সবল করে তোলেন, পাশাপাশি তাঁর উচ্চতাও বৃদ্ধি পায় প্রায় ৩৩ সেন্টিমিটার।
১৯৬১ সালে উদিনেসের হয়ে অভিষেক ঘটে জফের। প্রথম সিজনে মাত্র চারটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান জফ। সিজন শেষে দ্বিতীয় বিভাগে অবনমিত হয়ে যায় উদিনিসে। পরের সিজনে দলের ফার্স্ট চয়েস গোলকিপার হয়ে ওঠেন জফ। দারুণ এক সিজন শেষে পুনরায় টপ ফ্লাইটে ফিরে আসে উদিনেসে। তবে এরপর আর সেখানে কন্টিনিউ করার সুযোগ হয়নি তাঁর, লিগের আরেক ক্লাব মনতোভা তাকে টেনে নেয় নিজেদের দলে।
মনতোভা তে চার বছর কাটান জফ, সেইসাথে নিজেকে আরও পরিপূর্ণ করে গড়ে তোলেন। এরমধ্যে এসে পড়ে ১৯৬৬ ফিফা বিশ্বকাপ। তবে সেবারের স্কোয়াডে জায়গা মেলেনি জফের। ওদিকে বিশ্বকাপে ইতালির অবস্থাও ছিলো যাচ্ছেতাই। উত্তর কোরিয়ার কাছে নাকানিচুবানি খেয়ে বিদায় নেয় আসর থেকে। ওদিকে মনতোভায় যাত্রা শেষ করে ক্যারিয়ার টা কে আরও এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে নাপোলিতে পা রাখেন জফ।
অতঃপর ১৯৬৮ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালির জার্সিতে অভিষেক ঘটে তাঁর। সেদিন বুলগেরিয়া কে হারিয়ে তাঁর অভিষেক ম্যাচ টা স্মরণীয় করে রাখে ইতালি। টুর্নামেন্টের বাকি ম্যাচ গুলোতেও নিজের জায়গা অক্ষুণ্ণ রাখেন জফ। অবশেষে ঘরের মাঠে সেবার ইউরোপ সেরার মুকুট মাথায় তোলে ইতালি। রাঙিয়ে যায় দিনো জফের ইতালি যাত্রা।
অভিষেক টুর্নামেন্টেই নির্বাচিত হন টুর্নামেন্ট এর সেরা গোলকিপার। তবে এরপরও আজ্জুরিদের ফার্স্ট চয়েস হতে পারেননি জফ। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে কোচ ফেরুচ্চিও ভালকারেজ্জি আবারও এনরিকো আলবারতোসি কে নিয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করেন। সেবারের আসরে ফাইনালে পৌঁছায় ইতালি, তবে পেলের ব্রাজিলের কাছে ৪-১ গোলে পরাজিত হয়ে রানার্সআপ হয়েই ফিরে আসতে হয়।
ওদিকে নাপোলি ছেড়ে আরেক ইতালিয়ান জায়ান্ট জুভেন্টাসে যোগ দেন জফ। তুরিনের ক্লাব টি তে যোগ দিয়ে দুর্দান্ত কিছু সিজন কাটান। সেসময় ব্যালন ডি অর জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। এ ধারাবাহিক পারফর্মেন্সে ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপে আবারও ইতালির নাম্বার ওয়ান হয়ে ওঠেন দিনো জফ। তবে এবার যাত্রাটা সুখকর ছিলোনা। গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় ইতালি।
বিশ্বকাপ শেষে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান কোচ ভালকারেজ্জি। বিশ্বমঞ্চে ইতালির আধিপত্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তাঁর জায়গায় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন এঞ্জো বিয়ারজোত। ততদিনে দিনো জফও নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। তৎকালীন বিশ্বের সেরা শট স্টোপার হিসেবে নিজেকে পরিণত করেছেন। তুরিনের বুড়িদের হয়ে জিতে নিয়েছেন চারটি সিরি আ টাইটেল। ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপেও নিজেকে আবার নতুন করে চেনালেন জফ। তাঁর নিপুণতায় টুর্নামেন্টে তিনটি ক্লিনশিট পায় ইতালি। তবে শিরোপা ছোঁয়া হয়নি সেবার। রিনাস মিশেল আর ইয়োহান ক্রুইফের টোটাল ফুটবলের কাছে হার মানতে হয় তাদের, সেমিফাইনালে বিদায় নিয়ে ফিরতে হয় ঘরে।
দুবছর পর হৃদয় ভাঙার পুনরাবৃত্তি ঘটলো আবারও। ১৯৮০ সালের ইউরো অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ইতালিতেই। কিন্তু আবার সেই একই গল্প। এবারও সেমিফাইনাল থেকে বিদায় আজ্জুরিরা, আবারও চতুর্থ হয়ে টুর্নামেন্ট শেষ করে তারা। দলের অন্যতম প্রবীণ সদস্য দিনো জফ আবারও ফিরে আসেন শিরোপা জয়ের দ্বারপ্রান্ত থেকে। নিজের সবটুকু উজাড় করেই দিয়েছিলেন, নির্বাচিত হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা গোলকিপার। ইউরোর আসরে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে অপরাজেয় থাকার রেকর্ড গড়েছিলেন (যা ২০১২ সালে নিজের করে নেন ইকার ক্যাসিয়াস)। তারপরও পারেননি। আবারও সব শেষে ভর করলো সেই পুরোনো হতাশা।
অবশেষে আসে ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ। জফের স্বপ্নপূরণের বিশ্বকাপ। বয়স ততদিনে পৌঁছে গেছে চার দশকে। শরীর আর আগের মতো নেন। ভেঙে পড়তে চায় ক্ষণে ক্ষণে। তবে মন তখনও ভেঙে পড়েনি। মনোবল তখনো অটুট, সাথে লড়াই করার অদম্য স্প্রীহা। আর সেই সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যেটা, জয়ের নেশা। অধিনায়কের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে সেবার এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন দলকে।
তবে গ্রুপ স্টেজের দ্বিতীয় রাউন্ডেই অপেক্ষা করছিলো বিরাট পরীক্ষা। ইতালির মুখোমুখি হয় পরাক্রমশালী ব্রাজিল। ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্তে গোললাইন থেকে ব্রাজিলের এক নিশ্চিত গোল রুখে দেন দিনো জফ। বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা ও শ্বাসরুদ্ধকর সে ম্যাচে ইতালি জয় পায় ৩-২ গোলে। ন্যু ক্যাম্পে পোল্যান্ডের বিপক্ষে সেমি ফাইনালেও জফ ছিলেন বরাবরের মতোই অপ্রতিরোধ্য। সেদিন টুর্নামেন্টে নিজের দ্বিতীয় ক্লিনশিট পেয়ে যান জফ। ওদিকে পাওলো রসির জোড়া গোলে সহজ জয় পেয়ে যায় ইতালি।
অবশেষে এগিয়ে আসে ১১ জুলাই। জফের বহুল আকাঙ্ক্ষিত দিন। সেদিন মাদ্রিদের সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ইতালির মুখোমুখি হয় রুমিনিগের পশ্চিম জার্মানি। তবে ম্যাচ টা ছিলো একদমই একপেশে। ৫৭ মিনিটে গোল করে টুর্নামেন্টের গোল্ডেন বুট নিশ্চিত করেন রসি। পরবর্তীতে তারদেলি ও আলতোবেলির গোল ৩-০ তে এগিয়ে যায় আজ্জুরিরা। শেষদিকে পল ব্রেইটনারের গোল শুধুই ব্যবধান কমায়।
বিশ্বকাপ জয় করে ইতালি। অবসান ঘটে দীর্ঘ ৪৪ বছরের অপেক্ষার! দিনো জফের জন্মেরও চার বছর আগে পিওলা, কোলাউসি ও অলিভেইরা রা যা করে দেখিয়েছিলেন, সুদীর্ঘ অপেক্ষার পর তা আবারও করে দেখালেন পাওলো রসি, দিনো জফ রা। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখালেন দিনো জফ। পথের সাথীরা ছেড়ে গেছে বহু আগেই, কিন্তু পা হড়কাননি জফ। হৃদয় ভেঙেছে বহুবার। টানা দুটি বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে বিদায় নিতে হয়েছে সেমিফাইনাল থেকে, ছুঁয়ে দেখা হয়নি স্বপ্ন।
অবশেষে, অবশেষে চল্লিশ বছর বয়সে এসে কীর্তি গড়লেন দিনো জফ। সবচেয়ে বেশি বয়সী ফুটবলার হিসেবে জয় করলেন বিশ্বকাপ শিরোপা। পাশাপাশি আরও একবার নির্বাচিত হন টুর্নামেন্ট সেরা গোলকিপার।
বিশ্বকাপজয়ী ইতালি দলের কোচ এঞ্জো বিয়ারজোত ১৯৮২ বিশ্বকাপের সেরা মুহূর্ত স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, "ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে ও আমার কাছে এলো, এবং কোনো কথা না বলে গালে একটি চুমু এঁকে দিলো। ওই ক্ষুদ্র মূহুর্তটাই ছিলো আমার কাছে বিশ্বকাপের সেরা মুহূর্ত।"
জফ তার লম্বা ক্যারিয়ারে গড়ে গেছেন অসংখ্য রেকর্ড। সবচেয়ে বেশি বয়সে বিশ্বকাপ জেতা ফুটবলার তিনি। সবচেয়ে বেশি বয়সে ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনাল খেলা ফুটবলার তিনি। সিরি আ তে টানা সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা ফুটবলার তিনি। আন্তর্জাতিক ম্যাচে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গোলবার অক্ষুণ্ণ রাখার রেকর্ড তাঁর দখলে। কোয়ালিফাইং রাউন্ড সহ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গোল হজম না করার রেকর্ড তাঁর। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের এক আসরে সবচেয়ে কম গোল (১ টি) হজম করার রেকর্ড তাঁর দখলে (যৌথভাবে)। আরেক ইতালিয়ান জিয়ানপিয়েরো কম্বির পর দ্বিতীয় ফুটবলার হিসেবে গোলরক্ষক-অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ জয় করেন তিনি।
মাঠে দিনো জফ সবসময়ই ছিলেন একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব। নেতৃত্বের সবকটি গুণাবলি তার মধ্যে ছিলো। যেকোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতেন, সতীর্থদের শান্ত রাখতে পারতেন। প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান সর্বদা অটুট থাকতো। সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন আদর্শ ফুটবলার ও আদর্শ অধিনায়ক।
সুদীর্ঘ সাধনায় স্বপ্ন ছোঁয়ার পর অবশেষে ১৯৮৩ সালে ৪১ বছর বয়সে ফুটবল কে বিদায় জানান জফ। দীর্ঘ ২২ বছরের ক্যারিয়ারে কখনো হাল ছেড়ে দেননি। যতবার ভেঙে পড়েছেন, আবারও উঠে দাঁড়িয়েছেন সব বাধা ভুলে। স্বপ্ন পূরণের জন্য দিয়েছেন নিজের পুরোটা, নিজেকে নিয়ে গেছেন খাদের কিনারায়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন, দিনশেষে ঘরে ফিরেছেন বিজয়ীর বেশে।
- 0 মন্তব্য