ম্যান সিটির উত্থান ও ফুটবলে এক নতুন বিপ্লব | পর্ব : ১
পোস্টটি ১২৫০ বার পঠিত হয়েছেপ্রিমিয়ার লিগ কে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সবচেয়ে কম্পিটিটিভ লিগ। লিগের প্রতিটি দলের শক্তিমত্তার ভারসাম্য, বড় বড় বিশ্বসেরা তারকাদের মিলন মেলা, পাশাপাশি প্রতিনিয়ত প্রচুর ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে প্রতিটি দলের ধারাবাহিক শক্তিবৃদ্ধি...সব মিলিয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি দলই প্রতিপক্ষ সবকটি দল কে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা রাখে। তাই এখানে দলগুলোর প্রতিযোগিতা থামেনা কখনোই।
কিন্তু গত এক যুগ ধরে এই অবিশ্বাস্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল লিগে একক আধিপত্য ধরে রেখেছে ম্যানচেস্টার সিটি। এর মাঝে অসংখ্য দল অসংখ্যবার নিজেদের পূর্ণ শক্তির প্রতিফলন দেখিয়ে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে, কিন্তু সিংহাসনের আসন থেকে টলাতে পারেনি তাদের। দীর্ঘ এক যুগ ধরে একছত্র ভাবে রাজত্ব করে যাচ্ছে তারা।
ফুটবল বিশ্বে ম্যান সিটির উত্থান টা মডার্ন ফুটবলের সবচেয়ে চমকপ্রদ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা গুলোর অন্যতম, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ২০০৮ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর ম্যান সিটির মালিকানা হাতে তুলে নেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের ধনকুবের শেখ মনসুর বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের আবু ধাবি ইউনাইটেড গ্রুপ। আর এরই মাধ্যমে সূচনা হয় ম্যান সিটির অগ্রযাত্রার, যা ক্রমেই ফুটবল বিশ্বে সাধন করে এক বিপ্লব।
তবে ম্যান সিটি কিন্তু দেড় যুগ আগেও একটা অপরিচিত অজনপ্রিয় ক্লাব বৈ কিছু ছিলো না। তাদের লড়াইটাও ছিলো শুধু লিগে কোনোরকমে টিকে থাকার জন্য। রেলিগেশনে ধারাবাহিক ভাবে নিচের দিকে নেমে যাওয়া ছিলো নিয়মিত চিত্র। তখন টাইটেল তো দূরের কথা, ফার্স্ট ডিভিশনে নিয়মিত খেলতে পারাও তাদের জন্য ছিলো স্বপ্নের মতো।
তারও ক'বছর আগে যদি ফিরে তাকানো যায়, তাহলে ম্যান সিটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াও কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৬ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সময় টা ম্যান সিটির শুধু ডিভিশন গুলোর মধ্যে ওঠা নামা করতেই কেটে গেছে। তবে প্রথমবারের মতো তারা আশার আলো দেখে ২০০৭ সালে। সেবার থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন শিনাওয়াত্রা ৮১.৬ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে কিনে নেন ম্যান সিটির ৭৫% মালিকানা। সেই সাথে ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত করেন বিশ্ব ফুটবলের জনপ্রিয় মুখ ইংল্যান্ড জাতীয় দলের সাবেক ম্যানেজার এসভেন গোরান এরিকসন কে।
তবে থাইল্যান্ডে তৎকালীন শিনাওয়াত্রার বাজে রেপুটেশন কাল হয়ে দাঁড়ায়। নানা রকম দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন তিনি। যেটার দ্বারা পরবর্তীতে আক্রান্ত হয় ম্যান সিটিও।
এরিকসন বেশ নিপুণতার সাথেই অবশ্য তাঁর কাজ শুরু করেন। পটেনশিয়াল তরুণ প্রতিভার জন্য পুরো ইউরোপ জুড়ে স্কাউটিং শুরু করেন। ৬০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে ধরে আনেন এক গাদা অপরিচিত মুখ। স্কাউটিং এ এরিকসন যে কতটা অভিজ্ঞ তার প্রমাণ মিলেছে বেশ দ্রুতই। বহুবছর পর বেশ নজরকাড়া একটা সিজন কাটায় ম্যান সিটি।
সাবেক কোচ স্টুয়ার্ট পিয়ার্সের জঙধরা ফুটবল থেকে বের হয়ে দৃষ্টিনন্দন খেলা উপহার দিতে থাকে এরিকসনের সিটি। এলানো, মাইকেল জনসন, জিওভানি দের পায়ে পায়ে তৈরি হতে থাকে অসংখ্য চোখধাঁধানো মুহূর্ত। সিটি সে মৌসুমে টপ ফোরেও পৌঁছে গিয়েছিলো বেশ ক'দিনের জন্য। তবে সিজনের শেষ দিকে গিয়ে হঠাৎ এ চমৎকার ছন্দে ভাটা পড়ে। টপ ফোর থেকে নেমে যায় নয় এ, সেই সাথে সিজনের শেষ ম্যাচে মিডলসবোরোর বিপক্ষে ৮-১ গোলে নাকানি চুবানি খেয়ে ঘরে ফেরে। ফলাফল, বরখাস্ত হন এরিকসন।
একবছরের মধ্যে নানারকম মামলায় অভিযুক্ত শিনাওয়াত্রা শেষ পর্যন্ত ম্যান সিটির হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এরপর ক্লাবের সিইও গ্যারি কুক নতুন কোনো ইনভেস্টমেন্ট এর খোঁজে সারা বিশ্ব জুড়ে চষে বেড়াতে শুরু করেন। আর ঠিক সে সময়ই তিনি সন্ধান পান এক প্রকৃত ডিলের, যা ম্যান সিটি কে পুরোপুরি বদলে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে।
আরব আমিরাত রাজ পরিবারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ধনকুবের শেখ মনসুর বিন জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান। তাঁর বরাবরই ঝোঁক দেশ বিদেশে নানারকম ইনভেস্টমেন্টের প্রতি। বিশ্বব্যাপী নানারকম বিজনেসের সাথে তিনি জড়িত। নতুন নতুন চমকপ্রদ ইনভেস্টমেন্ট আইডিয়াতে বরাবরই তিনি ছিলেন দারুণ আগ্রহী। তাঁর কাছে গিয়ে পৌঁছান গ্যারি কুক, আহবান জানান ম্যান সিটির মালিকানা অধিগ্রহণ করার জন্য।
এর আগেও স্পোর্টস ভিত্তিক কিছু ক্ষেত্রে ইনভেস্ট করলেও ফুটবলের মতো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় খেলায় তখনও তিনি নজর দেননি। তাই কুকের সাথে কথা বলে এইটা নিয়ে দারুণ আগ্রহ প্রকাশ করেন শেখ মনসুর। এরপর কোনো বিলম্ব না করে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে থাকসিন শিনাওয়াত্রার কাছে থেকে ম্যান সিটির মালিকানা অধিগ্রহণ করেন করেন এ ধনকুবের।
ম্যান সিটির মালিকানা অধিগ্রহণের জন্য আবি ধাবি ইউনাইটেড গ্রুপ নামে নতুন এক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন শেখ মনসুর। রাতারাতি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্লাব বনে যায় ম্যান সিটি। শুরু থেকেই বিরাট উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করেন দূরদর্শী শেখ মনসুর। ম্যান সিটি কে বিশ্ব ফুটবলের বুকে এক পরাক্রমশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই ছিলো তাঁর মূল লক্ষ্য। তৎকালীন খাবি খেতে থাকা ছোট্ট দল ম্যান সিটি কে নিয়ে শেখ মনসুরের পরিকল্পনাগুলো এতটাই দিবাস্বপ্নের মতো ছিলো যে সেসময় খোদ সিটি ফ্যানরাই সেসব কিছু বিশ্বাস করতে পারেনি।
তবে তাদের আশ্বাস যে কতটা নির্ভরযোগ্য ছিলো তা দ্রুতই প্রমাণ করতে শুরু করে আবু ধাবি ইউনাইটেড গ্রুপ। ক্লাবের প্রতিটি সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম জায়গায় তারা নজর দেওয়া শুরু করে। সার্বিকভাবে ক্লাবের উন্নয়ন সাধন করতে শুরু করে। রাতারাতি বড় বড় সব স্টার সাইন করিয়ে চমক দেখানো তাদের লক্ষ্য ছিলোনা। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো সুষম গতি তে ক্লাবের একটি শক্ত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে ম্যান সিটি কে একটা প্রকৃত বড় ক্লাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
ক্লাব কে দিনকে দিন বদলে দিলেও ক্লাবের রুট কখনো ভুলে যাননি শেখ মনসুর। ক্লাবের ফ্যানদের দিয়েছেন বিশেষ মর্যাদা। তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ও আলোচনার মাধ্যমে তাদের মতামত কে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। ফলে নিজেদের ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা তো কোনোরকম আঘাতপ্রাপ্ত হয়-ই নি, বরং তা আরও মজবুত হয়েছে।
আগের ম্যানেজার এরিকসন কে জায়গা থেকে সরিয়ে শিনাওয়াত্রাই নিয়োগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ ম্যানেজার মার্ক হিউজ কে। ওয়েলস জাতীয় দল ও ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের হয়ে ভালো করার পর হিউজ কে সিটি তে আনেন শিনাওয়াত্রা। তার আন্ডারে দল ভালোই করছিলো। তাই শুরুতেই ম্যানেজার পরিবর্তন করেনি নতুন মালিকপক্ষ। কিন্তু কিছুদিন পর নতুন এক সমস্যা দেখা দিলো। এভারেজ মানের টিম ম্যানেজ করে অভ্যস্ত হিউজ যখন ট্রান্সফার মার্কেটের জন্য বড় অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ পাচ্ছিলেন, তখন সেটা ঠিকভাবে আর ব্যবহার করতে পারছিলেন না। বড় বড় সাইনিং এর ক্ষেত্রে বারংবার ভুল করছিলেন। ফলে তার আন্ডারে ১৮ মাসে মালিকপক্ষ যে অগ্রগতি আশা করেছিলো, সেখানে তাদের বেশ হতাশ করেন হিউজ।
তিনি মোট খরচ করেন প্রায় ২৭০ মিলিয়ন পাউন্ড, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তার একমাত্র পুরো সিজনে সিটি শেষ করে টেবিলের দশে থেকে, যেখানে এর চেয়ে অনেক কম বাজেট নিয়েও এরিকসন একধাপ ওপরে সিজন শেষ করেছিলেন। পরের সিজনেও শুরুর এগারো ম্যাচে সিটিজেনরা জয় পায় মাত্র দুটিতে। তাই সঙ্গত কারণেই দ্বিতীয় সিজনের মাঝামাঝিতে সিটি লিগের ছয়ে থাকা অবস্থায় বরখাস্ত হন হিউজ।
হিউজের স্পেল টা ছিলো একদমই ব্যর্থ। আর এমন বিরাট অঙ্কের বাজেট, যেখানে হিউজ ইচ্ছেমতো খরচ করার পূর্ণ স্বাধীনতা পান, সেখানে সে দল নিয়ে তার জয়ের রেশিও ছিলো মাত্র ৪৭ শতাংশ। তাছাড়া ভিনসেন্ট কোম্পানি ও পাবলো জাবালেতার মতো তার দুর্দান্ত কিছু সাইনিং যারা পরবর্তীতে দুর্দান্ত পারফর্ম করে দলের প্রাণভোমরা হয়ে উঠেন, তাদেরও ভুল জায়গায় খেলিয়ে একদমই পারফর্মেন্স বের করে আনতে পারেননি। বরং হিউজের প্রস্থানের পরপরই তাঁরা নিজেদের স্বরূপ চেনাতে শুরু করেন।
কার্লোস তেভেজ, কোলো তোরে, এমানুয়েল আদেবায়োর ও জোলিওন লেসকটদের মতো তারকাদের নিয়ে গড়া দল নিয়ে প্রকৃতপক্ষেই প্রত্যাশা আরও অনেক বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হিউজ এমন দল নিয়েও প্রত্যাশার ছিটেফোঁটাও স্পর্শ করতে পারেননি। এরপরও সিটি মালিকপক্ষ তাকে সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় সিজনেও একরকম স্ট্রাগল করতে থাকার পর আর রাখতে পারেনি। তার জায়গায় নতুন ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ পান রবার্তো মানচিনি। আর সেই সাথে সিটির সবচেয়ে সমৃদ্ধ একটা অধ্যায়ের সূচনা ঘটে।
দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই দল গুছিয়ে নিতে শুরু করেন এ ইতালিয়ান। কিছুদিনের মধ্যেই সিটি কে এক শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সেই সিজন সিটি শেষ করে পঞ্চম অবস্থানে থেকে, যা প্রকৃতপক্ষে আহামরি কিছুনা। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সিটির খেলায় তিনি যে গতি ও ছন্দ ফিরিয়ে এনেছিলেন, তা পয়েন্ট টেবিল দিয়ে বিচার করা সম্ভব না। সিটির খেলায় এসেছিলো আমূল পরিবর্তন, যা বড় দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার পূর্ব শর্ত। তার আন্ডারেই সিটি প্রথম নির্ভীকভাবে খেলা শুরু করে। দলের মধ্যে জয়ের মনোভাব তৈরি করেন মানচিনি, যা সিটির লেভেল টা কেই রাতারাতি বদলে দেয়।
পরের সিজনে ইয়া ইয়া তোরে, ডেভিড সিলভা, জেরোমে বোয়াটেং, জেমস মিলনার ও আলেকজান্ডার কোলারভের মতো জনপ্রিয় সব তারকা ফুটবলার কে দলে ভেড়ায় সিটি। সেই সিজন দুর্দান্ত কাটে মানচিনির শিষ্যদের। সেবার তারা প্রথমবারের মতো কোয়ালিফাই করে ইউরোপীয় ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর চ্যাম্পিয়নস লিগে। পাশাপাশি ৩৫ বছরের শিরোপা খরা কাটিয়ে ইয়া ইয়া তোরের দুর্দান্ত পারফর্মেন্সে ভর করে স্টোক সিটি কে হারিয়ে ২০১১ সালের এফএ কাপ জয় করে নেয় সিটিজেনরা।
আর এর মাধ্যমে সিটি পদার্পণ করেন তাদের পরবর্তী ধাপে। বছরের পর বছর ধরে দলটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে গাঁথা যে আন্ডারডগ মেন্টালিটি, এইবার অবশেষে সেটা দূর হয়ে যায়। প্রথমবারের মতো সিটি ভাবতে শুরু করে তারা একটা শক্তি, তারা খেলে জেতার জন্য, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য, ট্রফি উঁচিয়ে ধরার জন্য। খেলোয়াড়, সমর্থক বা দলের স্টাফ, সবাই হঠাৎ বুঝতে পারে এ সিটি আলাদা। সিটি আর আগের মতো নেই, আগাগোড়া একদম বদলে গেছে। এ এক নতুন সিটিকে দেখছে তারা, যাদের লক্ষ্য শুধুই জয় করা।
- 0 মন্তব্য