রোনালদিনহোঃ নিভে যাওয়া এক রংমশাল
পোস্টটি ৫৬৭৮ বার পঠিত হয়েছেব্রাজিল। দেশটার নাম উচ্চারণ করতে গেলে সবার প্রথমে যার কথা মাথায় আসে, তার নাম ফুটবল। ফুটবলই তাদের ধ্যান, ফুটবলই তাদের জ্ঞান। ফুটবলে তারা ঘুমায়, ফুটবলে জাগে, ফুটবলে দেখে স্বপ্ন। সেজন্যই হয়তো যুগে যুগে হলুদ-সবুজদের দেশে জন্মান শতসহস্র কিংবদন্তী, মাঠে যারা দুই পা দিয়ে রচনা করে যান কবির হৃদয়ে দোলা-জাগানো কাব্য, ১২০ গজের ক্যানভাসে চিত্রকরের সাতরংয়ে ফুটিয়ে তোলা চিত্র বা সবুজ বীণায় সুরকারের সুমধুর সপ্তসুর। তাদের কেউ মৃত্যুঞ্জয়, কাউকে নিয়ে প্রচুর আশায় বুক বাঁধে সেলেসাওরা, কেউ হয়তো বা হারিয়ে যান কালের গর্ভে। ধীরেই হোক কিংবা হঠাৎ করে, একপর্যায়ে নিভে আসে তাদের অমরত্ব, শ্রেষ্ঠত্বের দীপশিখা।
১৯৮০ সালে ২১ মার্চ, ব্রাজিলের রিও গ্রান্দে ডো সুল স্টেটের পোর্তো অ্যালেগ্রিওতে জন্মেছিলেন এমনই এক রংমশাল। রংমশাল কেন বলছি? মশালের কাজ জ্বলে ওঠা, অন্ধকারে আলো ছড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু তিনি অন্ধকারে শুধু আলো নন, চারদিকে ছিটিয়ে দিতেন লাল-নীল আবীরও, প্রাণহীন পরিবেশে প্রাণ ফিরিয়ে দিতেন এক ঐন্দ্রজালিক পন্থায়। ভরসা আর সৌন্দর্য-এ দুইয়ের এক অপূর্ব সংযোগে হয়ে উঠেছিলেন ঈশ্বরপ্রদত্ত এক বিরল প্রতিভা। সুখে-দুঃখে, আশায়-নিরাশায় সর্বক্ষণ মুখে লেগে থাকা সেই সহজ-সরল, ভুবনভোলানো হাসি দেখে কে বলবে যে এই লম্বা, ঝাঁকড়া চুলের মানুষটি ছিলেন প্রতিপক্ষের ডিফেন্স-দুর্গের কাঁপন? ক্ষিপ্রগতিতে ড্রিবলিং করে সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দেওয়া ডিফেন্ডারদের সেই ত্রাস? বলকে নিয়ন্ত্রণ করতেন নিজের সেই মুখের হাসির মতই নরম পায়ে, কিন্তু তার কাছ থেকে বল কেড়ে নিতে ঘাম ছুটে যেত অন্যদের?
আট বছর বয়সে স্থানীয় ক্লাব গ্রেমিওর ইয়ুথ একাডেমি থেকে যাত্রা শুরু হয় তার, প্রস্ফুটিত হয় ১৩ বছর বয়সে-ঠিক সেই সময়টায়, যখন স্থানীয় এক ক্লাবের বিরুদ্ধে তার দল ২৩-০ গোলে জয়লাভ করে! স্কোরশিটে কাদের নাম উঠেছিল, জানতে চান? উহু, প্রশ্নটা একটু ভুল হয়ে গেল। “কাদের” নয়, শব্দটা হবে “কার”। হ্যাঁ, সবগুলো গোলের একচ্ছত্র মালিক আর কেউ নয়, সেই তেরো বছরের কিশোর! তখনই কি আঁচ করা গিয়েছিল, যে এই ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ একদিন প্রতিপক্ষ দলকে ছারখার করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে? হয়তো বা, যখন ১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে ৪৮ ম্যাচে ২৩ গোল করার পাশাপাশি তিনি মন্ত্রমুগ্ধ করেছিলেন ব্রাজিলের ১৯৯৪ বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক দুঙ্গাকে, তাঁর ক্লাব ইন্টারনেসিওন্যালের বিরুদ্ধে খেলাকালীন তাঁর মাথার উপর দিয়ে বল ফ্লিক করে নিয়ে, দুর্দান্ত ড্রিবলিংয়ে তাঁকে বোকা বানিয়ে। সে ম্যাচ শেষে কার্লোস দুঙ্গা তো বলেই বসেন, রোনালদিনহোর মত এমন স্কিলড খেলোয়াড় তিনি তাঁর জীবনে দেখেন নি!
রোনালদিনহো। আন্তর্জাতিক ও ক্লাব-দুই অঙ্গনের ফুটবলেই সফল এক খেলোয়াড়। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৯৯৯ সালে ব্রাজিলের হয়ে কোপা আমেরিকার শিরোপায় ঠোঁট ছোঁয়ান তিনি, টুর্নামেন্টে একটি গোলও করেছিলেন। ফিফা কনফেডারেশন্স কাপেও শুধু ফাইনাল ম্যাচ বাদে প্রতিটিতে গোল করে গোল্ডেন বুট নিজের করে নিয়েছিলেন তিনি। ২০০২ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের কথাই বা কে ভুলবে? যখন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হাফটাইমের প্রায় শেষের দিকে জাদুকরী অ্যাসিস্ট দিয়ে দলকে ১-১ সমতায় ফিরিয়েছিলেন আর ৫০ মিনিটের মাথায় প্রায় ৪০ গজ দূর থেকে বলকে এক অবিশ্বাস্য কার্ভের গতিপথে জড়িয়েছিলেন ইংল্যান্ডের জালে? সেই বছরই তো ব্রাজিল জিতে নেয় তাদের রেকর্ড ৫ম বিশ্বকাপ। ২০০৫ সালেও জিতে নেন কনফেডারেশন্স কাপ, বনে যান এই টুর্নামেন্টের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা(৯)। ২০০৭ সালে ব্রাজিলের হয়ে কোপা আমেরিকা জয় করেন তিনি, হয়ে ওঠেন ব্রাজিল ভক্তকুলের নয়নের মণি। জাতীয় দলের হয়ে ৯৭টি ম্যাচে ৩৩টি গোল আছে এই কিংবদন্তীর।
এ তো গেল জাতীয় দলের সাফল্যের কথা। ক্লাব লেভেলেই বা তার সাফল্য কম কিসের? গ্রেমিও থেকে শুরু করে পিএসজি, বার্সেলোনা, এসি মিলান, ফ্লেমিঙ্গো, অ্যাটলেটিকো মিনেইরো-খেলেছেন অনেক ক্লাবে কিন্তু বার্সাবয় রোনালদিনহোর কথাটা সবার চেয়ে আলাদা করে না বললেই না। ২০০৩-০৪ এ ক্লাবটিতে যোগদান করে খেলেছিলেন মোট পাঁচটি মৌসুম, এরই মাঝে ২০৭ ম্যাচে করেছিলেন ৯৪টি গোল ও ৭১টি অ্যাসিস্ট। বার্সেলোনার হয়ে জিতেছেন ২টি লা লিগা শিরোপা, ২টি স্প্যানিশ সুপার কাপ এবং একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ইতিহাসের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম একজনের প্রথম গোলেও অ্যাসিস্ট করে মুহূর্তটিকে স্মরণীয় করে রেখেছিলেন তিনি, সেই খেলোয়াড়কে দিয়ে গিয়েছিলেন নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাটন, নিজের মেরুন-নীল ১০ নং জার্সিটি-যা যুগ যুগ ধরে অমর হয়ে থাকবে। এছাড়াও এসি মিলানের হয়ে ২০১০-১১ মৌসুমে তিনি সিরি আ জিতেছিলেন।
কিন্তু ভাগ্য শেষ অব্দি সহায় হয় নি তার। অথবা, নিজের প্রতিভার প্রতি ঠিক সুবিচারটা করে উঠতে পারেন নি তিনি। ক্লাবে হোক কি জাতীয় দলে, বিশ্বকাপ হোক বা লা লিগা-১২০ গজের মাঠটাকে নিজের মত করে রাঙিয়ে দেওয়া, দু’বার ফিফা দ্য বেস্ট এবং একবার ব্যালন ডি’অর জেতা এই খেলোয়াড়ের পতনটা এত দ্রুত আর আকস্মিকভাবে ঘটে যাবে, কেউ ভাবেও নি। নিজের নামের পাশে পরিসংখ্যানকে আরেকটু ভারী করে তোলার অবকাশ ছিল, হয়তো জাতীয় দল বা ক্লাবকে দিতে পারতেন আরো অনেক কিছু। কিছুটা নিজের খেয়ালের বশেই হোক, কিছুটা বা পরিপার্শ্বের অন্যায়ে, একসময় নিভে যেতে হল এই রংমশালকে। অবশেষে, ২০১৮ সালে ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে বুটজোড়া তুলে রাখলেন “গাউচো”। তবে সঙ্গীতে আছে না, “যাও গো, এবার যাবার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও”?
রোনালদিনহো যতদিন ফর্মে ছিলেন, ততদিন রাঙাতে কোনো ত্রুটি রাখেন নি তিনি।
(গত মার্চের ২১ তারিখ রোনালদিনহোর জন্মদিন উপলক্ষে লেখা)।
- 0 মন্তব্য