একজন হীরকব্যূহের রচয়িতা
পোস্টটি ১৭১৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
ব্লগের নীতিমালা
ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
১৯৮৮ সালের কথা। আপনি যদি একজন বার্সেলোনা সমর্থক হন এবং সেসময় আপনার প্রিয় ফুটবল ক্লাবটির অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্বন্ধে যদি জানতে চান, আপনার পক্ষে তা শোনা মোটেও সুখকর হবে না। ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকা দেনা, বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে মনোমালিন্য, স্টেডিয়ামে দর্শকের অভাব-একটি ফুটবল ক্লাবের সাথে যেসকল খারাপ কিছু ঘটতে পারে, তাদের ঠিক কোনটি অনুপস্থিত ছিল? কেবলমাত্র অর্থনৈতিক কারণে দলের ২১ জন খেলোয়াড় এবং তৎকালীন কোচ লুইস আরাগোনেসের ক্লাবের সভাপতি হোসে লুইস নুনিয়েজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ফেটে পড়া, যাকে কি না বার্সেলোনার ফুটবলে “হেস্পিরিয়া ম্যুটিনি” নামে আখ্যায়িত করা হয়, বুঝিয়ে দেয় ১৯৪১-৪২ মৌসুমের পর এটাই ক্লাবের সবচেয়ে বাজে সময়।
এমন টালমাটাল অবস্থায় কাতালানদের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির অস্তিত্ব, অহমিকা, ঐতিহ্য যখন সংকটাপন্ন, ঠিক তখনই বার্সেলোনায় কোচ হিসেবে পদার্পণ করলেন একজন কিংবদন্তি। প্রত্যাবর্তন বললেই হয়তো বা আরো ভালো শোনাবে, এই কিংবদন্তি যে বার্সেলোনায় ১৯৭৩-৭৪ মৌসুমে এসে দূর করেছিলেন বার্সেলোনার ১৪ বছরের লা লিগা শিরোপাখরা! একটি লা লিগা এবং একটি কোপা ডেল রে জিতেই ভক্তদের মনে যে প্রভাব সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন তিনি, তা কখনো ভোলার নয়। এর আগে আয়াক্সে কাজ করেছেন, ডাচ ক্লাবটিকে বানিয়ে দিয়েছেন ইউরোপসেরা। বলাই বাহুল্য, খুব কঠিন একটা সময়ে আগমন ঘটেছিল ভদ্রলোকের। পেরেছিলেন কি তিনি এই অগ্নিপরীক্ষায় উতরে যেতে? অন্তর্দ্বন্দ্ব-বহির্দ্বন্দ্ব সবকিছুতে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যেতে থাকা বার্সেলোনাকে ফিনিক্স পাখির মত পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে?
"গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!
কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!"
নবজাগরণের আভাস পাওয়া গেল প্রথমদিনই, যেদিন তিনি টিমের সবার সামনে একটা ব্ল্যাকবোর্ডে সাজালেন তাঁর ফরমেশন। তিনজন ডিফেন্ডার, চারজন মিডফিল্ডার, দু’জন আউট-অ্যান্ড-আউট উইঙ্গার এবং একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড। তৎকালীন বার্সা মিডফিল্ডার ইউসেবিওর ভাষ্যমতে, “আমরা একে অন্যের দিকে তাকালাম এবং প্রচণ্ড বিস্ময়ের সাথে ভাবলাম, ‘এটা কি?’”
ইউসেবিওদের কৌতূহল আর বিস্ময় নিতান্তই অহেতুক নয়। সে যুগে খেলা হত বনেদি ৪-৪-২ ফর্মেশনে, কিংবা ৩-৫-২ তে। তাদের নতুন কোচ হঠাৎ করে যে নতুন ছক নিয়ে এলেন, তার সাথে কেউ তেমন পরিচিত নয়-স্পেনে তো নয়ই। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, পরবর্তীতে এই ফর্মেশনই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় গোটা ফুটবলে। ভদ্রলোক অবশ্য এই ফর্মেশন তৈরী করতে অনুসরণ করেছিলেন আয়াক্সের হয়ে খেলাকালীন নিজের কোচ রাইনাস মিচেলের ৪-৩-৩ ছকের কিছু আইডিয়া, যার ভিত্তি ছিল “টোটাল ফুটবল” এর ধ্যানধারণা। কিন্তু তাতে যদি তিনি নিজের সৃজনশীলতা আর নিজ দর্শন না মেশান, তাঁর নাম তবে ইয়োহান ক্রুইফ কেন?
প্রথমেই ৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিজের এই যুগান্তকারী ফর্মেশনের সদ্ব্যবহার করে ক্রুইফ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, প্রতিপক্ষের দু’জন ফরোয়ার্ডকে আটকাতে ব্যাকলাইনে চারজন ডিফেন্ডারের ব্যবহার খেলোয়াড়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। । ৩-৪-৩ ফর্মেশনে মাঝমাঠের খেলোয়াড়দের মধ্যে হীরকব্যূহ তথা ডায়মন্ড শেপ রচনা করে পরস্পরের মধ্যে বাড়তি পাসিং লাইন সৃষ্টি করা এবং প্রতিপক্ষের প্রেসিংয়ের বিরুদ্ধে বল নিজেদের দখলে রেখে সামনে অগ্রসর হতে থাকা, প্রতিপক্ষের অর্ধে ৭ বনাম ৮ নিউমেরিক্যাল সুপিরিয়রিটি তৈরী করে ফ্রি স্পেস তৈরী এবং পাসিং ফ্লো চালু রাখা, অন দ্য বলে নিজেদের সীমানার পরিসর বাড়িয়ে দেওয়া আর অফ দ্য বলে মাঠের স্পেসের সংকোচন ঘটিয়ে প্রেস করা, সর্বোপরি প্রতিটি পজিশনের খেলোয়াড়দের ডায়নামিক মুভমেন্ট নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে খেলা চলাকালীন সর্বক্ষণ একে অন্যের পজিশন কভার করতে থাকা-এগুলোই তাঁর অভিনব ফর্মেশনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। তবে মূল ভিত্তিটা ছিল ঐ একই, সেটা টোটাল ফুটবল।
এই সিস্টেমে খেলা বার্সারই মূল চালিকাশক্তি ছিলেন হোল্ডিং মিডফিল্ডার রোলে খেলা পেপ গার্দিওলা। এছাড়াও লিবারো রোনাল্ড কোম্যানের বল-প্লেয়িং অ্যাবিলিটি, ইউসেবিও এবং আমোর-এই দুই ওয়াইড মিডফিল্ডারের ক্রিয়েটিভিটি, মূল স্ট্রাইকার লাউড্রপকে ফাইনাল থার্ডের মূল প্লেমেকার রূপে ব্যবহার করা তথা তাকে ফলস নাইন পজিশনে নামিয়ে আনা-সব মিলিয়েই ক্রুইফ সাধন করেছিলেন এক মহাবিপ্লব। ফলাফল?
প্রথম মৌসুমে ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ(১৯৮৮-৮৯) আর পরেরটায় কোপা ডেল রে(১৯৮৯-৯০) এনে দিলেও ক্রুইফের দর্শনের বিস্তৃতি আর সাফল্য যেন এক ঈষদচ্ছ পর্দার আড়ালেই রয়ে গিয়েছিল। অবশেষে তা প্রকাশে এল পরবর্তী মৌসুমে। ১৯৯১-৯২ মৌসুমে তৃতীয়বারের মত চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনালে ওঠে বার্সেলোনা। তবে না, এবার আর তীরে এসে তরীকে ডুবে যেতে হয় নি। ওয়েম্বলিতে অনুষ্ঠিত ফাইনাল ম্যাচে ১১২ মিনিটের মাথায় সাম্পদোরিয়ার বিপক্ষে রোনাল্ড কোম্যানের সেই অসাধারণ ফ্রি-কিক থেকে করা গোলে বার্সেলোনা প্রথমবারের মত লাভ করে নেয় ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নদের খেতাব। এছাড়াও কোচ হিসেবে পরপর চারটি লা লিগা (১৯৯০-৯১, ১৯৯১-৯২, ১৯৯২-৯৩, ১৯৯৩-৯৪), তিনটি স্প্যানিশ সুপারকাপ (১৯৯১, ১৯৯২, ১৯৯৪) এবং একটি ইউরোপিয়ান সুপারকাপ (১৯৯২) সহ বার্সেলোনার হয়ে মোট এগারোটি শিরোপাজয় করে নেন এই অনন্যসাধারণ ফুটবলশিল্পী। ১৯৯০-৯১ মৌসুমে তাঁর গড়া দল বার্সেলোনার “ড্রিম টিম” নামে সর্বদা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কোচিং ক্যারিয়ারের শেষের দিকে হঠাৎই হার্ট অ্যাটাকে ভোগার পর চিকিৎসকদের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি ১৯৯৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন, তবে একজন ফুটবল বিশ্লেষক এবং সমালোচক হিসেবে তিনি সবসময়ই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গিয়েছিলেন।
আদর্শ, বিশ্বাস, ধ্যানধারণা- এসব দিক দিয়ে সবার চেয়ে আলাদা ছিলেন এই ডাচম্যান। তাঁর চরিত্রের একটা অংশই যেন বলত, “আমার বিপক্ষে পুরো পৃথিবী”। নিখাদ সোনার মত খাঁটি এই মানুষটার কিন্তু ছিল না কোনো অর্থলোভ বা দামি সাইনিংয়ের প্রতি প্রবল আগ্রহ। কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে প্রতিভাকে বিচারের পক্ষপাতী তিনি কখনই ছিলেন না। তিনি প্রায়ই বলতেন, “কেন আপনি অপেক্ষাকৃত একটি ধনী ক্লাবকে হারাতে পারবেন না? আমি কোনদিন কোন টাকার বস্তাকে তো ফুটবল খেলতে দেখিনি!” তাঁর ভাষ্যমতে, “আপনি প্রতিটা পজিশনের জন্য এক একজন সেরা খেলোয়াড়কে আপনার দলে নিয়ে আসতেই পারেন, কিন্তু তা দিয়ে আপনি কেবল সেরা এগারোজন খেলোয়াড়ই পাবেন, সেরা একাদশ বা সেরা দল নয়।“ তাঁর প্রতিটি উক্তি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী, তা বর্তমান সময়ের ফুটবল ক্লাবগুলোর উত্থান-পতন, সাফল্য-ব্যর্থতার সাতকাহন দেখলে স্পষ্টতই অনুধাবন করা যায়।
১৯৪৭ সালের ২৫ এপ্রিল নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামে জন্মগ্রহণ করেন এই হীরকব্যূহের রচয়িতা, পৃথিবীকে বিদায় জানান ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ, দীর্ঘদিন ধরে ভোগাতে থাকা মারণঘাতী ফুসফুসের ক্যান্সারে। আজ তাঁর ৭৫তম জন্মদিনে কামনা থাকুক এটাই-যেন তাঁর আদর্শ, তাঁর শৈল্পিক এবং অভূতপূর্ব ফুটবল-দর্শন যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে তাঁর স্বপ্নের, তাঁর পরম ভালোবাসার ক্লাবটির প্রতিটি খেলোয়াড়-কোচ এবং ভক্তদের হৃদয়ের মাঝে।
- 0 মন্তব্য