নেইমারদের জার্সি কীভাবে হয়ে উঠল রাজনীতির গুটি
পেলে, গারিঞ্চা, সক্রেটিস, জিকো, রোনালদো, রোনালদিনহোর মতো বিশ্বনন্দিত তারকারা ফুটবলের ময়দান কাঁপিয়েছেন ব্রাজিলের হলুদ রঙা জার্সি গায়ে। যার ধারক-বাহক এখন নেইমার-জেসুসরা। হলুদ জার্সিটা ব্রাজিলিয়ানদের গর্বের প্রতীক, যার পরতে পরতে মিশে আছে অনেক আনন্দ-বেদনার কাব্য। যুগ যুগ ধরে এই জার্সিটা গায়ে চাপানোর স্বপ্নে বিভোর ব্রাজিলের অসংখ্য শিশু। এই হলুদ রঙের মোহে আছন্ন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ব্রাজিলের অগণিত ভক্ত-সমর্থকরাও।
কিন্তু এবার এসব ছাপিয়ে ব্রাজিলের ফুটবলীয় জাদুর প্রতীক হয়ে ওঠা জার্সিটা, খোদ ব্রাজিলিয়ানদেরই বিরাগভাজন হয়ে উঠেছে! অনেক ব্রাজিলিয়ান নাগরিক রীতিমতো একে বর্জনের ডাক দিয়েছেন। সাম্বার ছন্দে ফুটবলবিশ্বকে মাতোয়ারা করা দেশের ভক্তরা কেন এমন করছেন? ফুটবলে রঙ ছড়ানো পেলে-রোনালদোদের বিখ্যাত এই জার্সিটা যে এবার রাজনীতির মাঠে রঙ ছড়াচ্ছে; হয়ে উঠেছে ব্রাজিলের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জইর বোলসোনারোর লিবারের পার্টির প্রতীক। এই বোলসোনারো অনেক কারণেই বিতর্কিত ও সমালোচিত। তাই বিশ্বকাপ সামনে রেখেও ব্রাজিলের একাংশ মানুষজন এই জার্সি থেকে মুখই ফিরিয়ে নিয়েছেন।
আগস্ট মাসে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড নাইকির ব্যানারে বের হয়েছে কাতার বিশ্বকাপের জন্য ব্রাজিলের হোম ও অ্যাওয়ে জার্সি। ব্রাজিলের ২০ বছর বয়সী জোয়াও অলিভেরা সেটি কিনতে গিয়ে সম্মুখীন হয়েছিলেন এক বিরূপ অভিজ্ঞতার। হলুদ রঙের এই জার্সি কেনার কারণে দোকানি তাকে মনে করেছিল বর্তমান প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর সমর্থক। কারণ এরপরই ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী প্রার্থী লুলার বিপক্ষে ক্ষোভ ঝাড়তে শুরু করেন সেই দোকানি।
জোয়াও বোলসোনারোকে পছন্দ করেন না, করেন না সমর্থনও করেন না। কিন্তু জার্সি কেনার সময় তাকে ভান করতে হয়েছিল, তিনি বর্তমান সরকারেরই সমর্থক। সংঘাত এড়াতে বাধ্য হয়েই এমনটা করেছিলেন ২০ বছর বয়সী তরুণ জোয়াওকে। পেলে-রোনালদোর সাথে অন্যরা মিলে এই জার্সিকে কেন্দ্রে রেখে গোটা একটা জাতিকে গেঁথেছিলেন এক সুতোয়। অথচ সময়ের পালাবদলে সেই জার্সিই এখন গোটা ব্রাজিলের বুকে টেনে দিয়েছে একটা বিভাজন রেখা, যার মূলে রয়েছে রাজনীতি।
ব্রাজিলের বিখ্যাত এই জার্সিতে কীভাবে রাজনীতির দাগ লাগল? এর উত্তরে ইউনিভার্সিটি অফ ব্রাসিলিয়ার অধ্যাপক গাম্বা তোরেস বলেছেন, এই জার্সির সাথে রাজনীতি জুড়ে গেছে সেই ২০১৪ সালেই। সেবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বামপন্থী দিলমা রুসেফের পদত্যাগের দাবিতে জাতীয় ফুটবল দলের জার্সি পরে অজস্র মানুষ নেমে এসেছিলেন ব্রাজিলের রাস্তায়।
২০১৮ সালে রাজনীতির মাঠে আবারও দেখা গিয়েছিল ব্রাজিলের জার্সি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর রাজনৈতিক র্যালিতেও ছিল ব্রাজিলের জার্সির দাপট, তাঁর সমর্থকরা সেদিন গোটা ব্রাজিলকে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন হলুদ-সবুজ-নীল রঙে। মূলত সেখান থেকেই ব্রাজিলের জার্সি হয়ে উঠেছে বোলসোনারোর ডানপন্থী মতাদর্শী রাজনৈতিক দলের প্রতীক।
ব্রাজিলের রাজনৈতিক রেষারেষি এখন চরমে পৌঁছেছে। জোয়াও নামের সেই তরুণ প্রিয় দলের জার্সি কিনেছেন নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শ গোপন করে। গেল জুলাইয়ে নিজের ৫০তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এক পুলিশ সদস্যের ছোঁড়া গুলিতে মারা গেছেন মার্সেলো আরুদা নামের এক নাগরিক। যিনি ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট লুলার সমর্থক। আর সেই পুলিশ সদস্য ডানপথী বোলসোনারোর পথের পথিক। ৯ সেপ্টেম্বর ৪৪ বছর বয়সী চাকুরে বেনেদিতো কারদোসো প্রাণ হারিয়েছেন সহকর্মীর সাথে রাজনৈতিক বিষয়ে তর্কে জড়িয়ে।
এসবের প্রভাব বিরুপ প্রভাব ফেলেছে ব্রাজিলের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনেও। আরাউহো সুজা নামের এক টেক প্রোগ্রামার বিবিসিকে জানিয়েছেন, ব্রাজিলের জার্সি কেবল ঘরে থাকলেই পরেন তিনি। পাছে কেউ না আবার তাকে বোলসোনারোর সমর্থক ভেবে বসে! তবে তার আশা, যদি সাবেক প্রেসিডেন্ট লুলা আবার নির্বাচিত হলে জার্সির সাথে জুড়ে যাওয়া এই রাজনৈতিক সংকটের অবসান ঘটবে। আর কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হবে না তাদের প্রাণ প্রিয় ফুটবল দলের জার্সি।
লুলাও হারানো সিংহাসন পুনুরুদ্ধারে আত্মবিশ্বাসী। তার সমর্থনে আছেন সংগীতশিল্পী লুডমিলা, গ্র্যামি জয়ী আনিত্তা ও র্যাপার ডিজংগা। তারা এই জার্সি পরেই কনসার্টে উপস্থিত হয়েছেন। সাধারণ মানুষদেরও আহ্বান জানিয়েছেন, যেন প্রতিবাদ হিসেবে যেন তারাও জার্সি পরেন নির্ভয়ে। ক্ষমতাসীন বোলসোনেরার সমর্থকরাও বেশ বিপাকে আছেন এই জার্সি নিয়ে। ৪১ বছর বয়সী আলেসান্দ্রো পাসোস বলেছেন, ‘আমি ডানপন্থী ও দেশপ্রেমিক। হলুদ জার্সি পরে ভোট দিতে যেতে চাই আমি। তবে নির্বাচনের দিন জার্সি পরব কিনা চিন্তায় আছি।’
ফুটবলারদের ভাবনাতেও আছে জার্সি নিয়ে এই বিভ্রাটের কথা। রিচার্লিসন বলেছেন, এসব নিয়ে তর্ক-বিতর্কে জড়ানো মানে নিজেদের জাতীয়তাবাদ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ দেয়া।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল, ২ অক্টোবর। বিশ্বকাপও পরের মাসেই। আসন্ন দিনগুলোতে জার্সি নিয়ে মাতামাতিও বাড়বে বলেই গণমাধ্যমের ধারণা। তবে অধ্যাপক গাম্বা তোরেসের মতে, জার্সির সাথে রাজনীতি সম্পৃক্ততা সরানো উচিত। তার ভাষ্য, ‘জার্সি শুধুই জার্সি। অবশ্যই এর আলাদা মর্ম আছে। কিন্তু দিনশেষে একটা জার্সি কখনো কোনো সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। সরকার আসবে-যাবে। কিন্তু আমাদের দেশ, ফুটবল দল সবসময়ই থাকবে।’