• ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২
  • " />

     

    কোন ট্যাকটিকসে ব্রাজিলকে খেলাবেন তিতে? কীভাবে ব্যবহার করবেন নেইমারকে?

    কোন ট্যাকটিকসে ব্রাজিলকে খেলাবেন তিতে? কীভাবে ব্যবহার করবেন নেইমারকে?    

    ইংরেজিতে ‘প্র্যাগম্যাটিজম’ বলতে একটি শব্দ আছে। বাংলা ভাষায় এর কোনো সরাসরি প্রতিশব্দ নেই। যারা কার্যকর ফলাফলের জন্য বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেয়, তাদেরকে আমরা ‘প্র্যাগমেটিক’ বলে থাকে। আর তাদের মেথডটিই প্র্যাগম্যাটিজম। 

    তিতে ও তার ট্যাকটিসের বর্ণনা দিতে গেলেও এই দুটি শব্দ ব্যবহার করতে হয়। 

    এটা সত্য, বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া সিংহভাগ দলের দর্শনই এরকম। জাতীয় দলের ম্যানেজার হয়ে প্র্যাগম্যাটিক না হয়েই বা উপায় কী। ক্লাব ফুটবলের মতো এখানে তো পছন্দসই প্লেয়ার কিনে নির্দিষ্ট কোনো ঘরানার ফুটবল খেলানো সম্ভব না। কিন্তু তবুও তিতে একদিকে অনন্য। ইতিবাচকভাবে দেখুন বা নেতিবাচকভাবে, তিতেই ব্রাজিলের স্মরণকালের প্রথম প্র্যাগম্যাটিক চিন্তাধারার ম্যানেজার। 

     

    ফলাফলের জন্য সুন্দর ফুটবলকে বিসর্জন দেওয়াকে একসময় ব্রাজিলীয় ভক্তরা অপরাধ হিসেবেই দেখত। কিন্তু যুগ পাল্টেছে। ঘরোয়া ফুটবলের বেহাল দশা এবং দলের সকল ফুটবলার ইউরোপ-কেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ায় ব্রাজিলীয় ফুটবলের স্বতন্ত্রতা যে একসময় নষ্ট হয়ে যাবে, তা এই শতাব্দীর শুরুতেই আন্দাজ করেছিল অনেকে। তবে এই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে কিন্তু ব্রাজিল সহজে মানিয়ে নিতে পারেনি। 

     

    ব্রাজিল সর্বশেষ সাম্বা ফুটবল উপহার দিয়েছে ২০০২ বিশ্বকাপে। এর পর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত, মোট ৭বার কোচ বদল করেছে ব্রাজিলের বোর্ড। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্বে ছিলেন দুঙ্গা। তার প্রতি-আক্রমণ নির্ভর রক্ষণাত্মক ফুটবল ভক্তদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিলেও প্রথম দফায় তাকে চার বছর দায়িত্বে রাখে বোর্ড। দুঙ্গার পর দায়িত্ব নেওয়া মানো মেনেজেসও প্রায় একইরকম খেলাতে শুরু করে। এরপর ভক্তদের শান্ত করতে এবং জাতীয় দলের উপর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পরিচিত মুখ লুইজ ফিলিপ স্কলারিকে নিয়োগ দেয়, যার অধ্যায়ও শেষ হয় শোচনীয়ভাবে।    

     ২০১৬ সালে দায়িত্ব নেন তিতে। তিনি দায়িত্ব নিয়েই শান্ত করেন তরী। অন্যান্য ম্যানেজারদের মতো একটি নির্দিষ্ট দর্শন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা না করে দলে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেন এই অভিজ্ঞ কোচ।  রক্ষণ ও আক্রমণের মধ্যকার ভারসাম্য, ট্যাকটিস ও ব্যক্তি-নির্ভরতার মধ্যকার ভারসাম্য, আধুনিক ইউরোপীয় ফুটবল ও ব্রাজিলীয় সাম্বা ফুটবলের মধ্যকার ভারসাম্য।   

     

    খেলার স্টাইল 

    তিতের পছন্দের ফরমেশন হচ্ছে ৪-১-৪-১। প্রথমদিকে ব্রাজিলকে দেখা যেত প্রতিপক্ষের অর্ধে মাঠের দুই পাশেই ত্রিভুজাকার সমন্বয় তৈরি করতে। ২০১৮ বিশ্বকাপ-পূর্ব সময়ে ডানদিকে উইলিয়ান এবং পাউলিনহোর সঙ্গে দেখা যেত ফুল-ব্যাক দানি আলভেসকে। আর বামে থাকতেন মার্সেলো, নেইমার এবং রেনাতো অগাস্তো। এই দুই ত্রিভুজের ভেতর প্লেয়ারদের নিজেদের মধ্যে দ্রুত বল আদান-প্রদান করতে পারতেন। যার ফলে দলীয়ভাবে বলের দখল ধরে রাখাটা সহজ হতো এবং প্রতিপক্ষ অর্ধে স্পেস তৈরি করাটা সহজ হতো। এই দুই ত্রিভুজের নিচে থাকতেন ক্যাসেমিরো। যার দায়িত্ব এখনো একই আছে। রিয়াল মাদ্রিদের মতো ব্রাজিল দলের ক্যাসেমিরোর কাজ দুই সেন্টার-ব্যাকের একটু সামনে দাঁড়িয়ে সব ধরণের আক্রমণ ব্লক করা। 

     

    ‘১৮ বিশ্বকাপের সময় অবশ্য তিতে কিছুটা রক্ষণশীল হয়ে যান। রক্ষণ নিশ্ছিদ্র রাখার দিকে বেশি মনোযোগ দেন তিনি। যার ফলে দেখা যায় ব্রাজিলের দুই ফুলব্যাক আর উপরে উঠছে না আগের মতো। যে কারণে আক্রমণে দলের সৃজনশীলতা অনেকাংশেই কমে যায়।  

     

    কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ার পর তিতে আবার নতুন রণকৌশলের চিন্তা আঁটতে শুরু করেন। ২০১৯ কোপা আমেরিকাতেও ৪-১-৪-১ ফরমেশন ধরে রাখে ব্রাজিল। কিন্তু এবার দানি আলভেজকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করা শুরু করেন তিতে। আলভেজ রাইট-ব্যাক হিসেবে নামলেও বিল্ড-আপের সময় তিনি পিচের মাঝখানে চলে যেতেন এবং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতেন। পেপ গার্দিওলা যেভাবে ফিলিপ লাম ও কাইল ওয়াকারকে ব্যবহার করেন, অনেকটা সেভাবেই।

    ফুলব্যাকরা মাঝখানে চলে আসায় তিতে দুইজন উইঙ্গারকে বাইরের দিকে রাখতে শুরু করেন। নেইমার আর গ্যাব্রিয়েল জেসুসকে সাধারণত দেওয়া হতো দুই উইঙ্গারের রোল। আর মাঝখানে খেলতেন ফিরমিনো ও কুটিনহো। 

     

    বিশ্বকাপকে সামনে রেখে গত এক বছর ধরেই তিতে বেশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন দল নিয়ে। অনেক নতুন প্লেয়ারকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে এই সময়ের মধ্যে। রাফিনহার মতো দুই-একজন নজর কেড়েছেন। 

     

    এই বিশ্বকাপে রিচার্লিসনকে মূল স্ট্রাইকার হিসেবে খেলাতে পারেন তিতে। আর নেইমার খেলতে পারেন স্ট্রাইকারের ঠিক নিচে দশ নম্বর পজিশনের ফ্রি রোলে। ‘নেইমারকে যারা উইংয়ে খেলায়, তারা গর্দভ,’ এই বাণীর মাধ্যমে সেটিরই ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। আর দুই উইঙ্গার হিসেবে আসবে ভিনিসিয়ুস জুনিয়র ও রাফিনহার নাম। দুইজনই বর্তমানে দুর্দান্ত ছন্দে রয়েছেন। 

    অ্যাটাকের সময় ব্রাজিলের ৪-২-৩-১ হয়ে যেতে পারে ৪-২-৪, তখন নেইমার চলে আসবেন ওপরে। পাকেতা/ফ্রড আর কাসেমিরো মিলে তৈরি করবেন ডাবল পিভোট

     

     

    এই ছবিতে যেরকম দেখা যাচ্ছে, নেইমার নিচে নেমে দুই ফুলব্যাক বা সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারদের কাছ থেকে বল নেবেন।

     

    ব্রাজিলের মতো হাই পজেশন দলের একটা সমস্যা হচ্ছে তারা অঙ্ক সময় লো ব্লক ভাঙতে হিমশিম খায়। কিন্তু এই ব্রাজিল স্লো ব্লকের বিপক্ষে অ্যাটাক করে অন্যভাবে।

    কনমেবলে ব্রাজিলই সব দলের মধ্যে সবচেয়ে কম ক্রস করেছিল। কিছুদিন আগে তউনিসিয়াকে তারা পাঁচ গোল দিয়েছিল প্রীতি ম্যাচে (এই তিউনিসিয়া মাত্রই ড্র করেছে ডেনমার্কের সাথে, ডিফেন্সিভ রেকর্ড দুর্দান্ত)। এখানে নেইমার একটু নিচে নেমে গেলেও কাসেমিরো রাফিনহাকে বেছে নিয়েছেন লং বলের জন্য।

     

    আবার দেখা যাচ্ছে, দানিলো ইনভার্টেড ফুলব্যাক হয়ে মাঝে এসেছেন, রাফিনহা চলে এসেছেন ওয়াইডে। এভাবে বারবার পজিশন বদলে ব্লক ভাঙ্গার চেষ্টা করেছে ব্রাজিল 

     

    যে কারণে রাফিনহাডানে স্পেস ক্রিয়েট করে বল যোগান দিতে পারছেন রিচার্লিসনকে 

     

    তিতে পূর্বে অনেকবার দেখিয়েছেন তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই দল পুনর্গঠন করতে সক্ষম। তিনি এমন একজন কোচ যিনি চাইলেই একটি দলকে নতুনভাবে উদ্ভাবন করতে পারেন। নতুনভাবে উদ্ভাবন করতে পারেন নিজেকেও। তবে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। তার এই প্র্যাগম্যাটিসিজন কি বিশ্বকাপ জেতার জন্য যথেষ্ট?